পড়শীর দেখা কী আর অত সহজে মেলে : কাঙালিনী সুফিয়া


প্রকাশিত: ০৯:৪৬ এএম, ০১ অক্টোবর ২০১৬

কাঙালিনী সুফিয়া। বাউলশিল্পে কিংবদন্তি এক নাম। তার কণ্ঠে ‘বুড়ি হইলাম তোর কারণে’ গানটি দেশের সব শ্রেণির শ্রোতাদের মন জয় করেছে। অনেকদিন অসুস্থ ছিলেন। তাই গান থেকেও নিজেকে একটু সরিয়ে রাখতে হয়েছে। এখন অনেকটাই সুস্থ তিনি। আর সুস্থ হয়েই মন দিলেন গানে।

নতুন করে তিনি ফিরলেন তার ভক্তদের কাছে নতুন অ্যালবাম নিয়ে। ‘যাত্রা’র ব্যানারে প্রকাশ হওয়া এই অ্যালবামের নাম ‘মা’। যাত্রার প্রতিষ্ঠাতা কণ্ঠশিল্পী আনুশেহ আনাদিল জানালেন, প্রায় দেড় বছর ধরে এই অ্যালবামের কাজ হয়েছে। তিন দিন ধরে ঢাকার ধুন স্টুডিওতে হয়েছে লাইভ রেকর্ডিং। বৈঠকি গানের আসরের আবহে গানগুলো ধারণ করা হয়েছে। সিডি কিনতে হলে দাম পড়বে ২০০ টাকা। শ্রোতারা চাইলে kangalinisufia.com ওয়েবসাইটে গিয়েও গানগুলো কিনতে পারবেন। অ্যালবাম থেকে উপার্জিত অর্থ সরাসরি শিল্পীকে দেয়া হবে বলে নিশ্চিত করেন আনুশেহ।

গেল ২৯ সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ‘মা’ অ্যালবাম প্রকাশনা অনুষ্ঠানে কাঙালিনী সুফিয়া কথা বলেন জাগো নিউজের সঙ্গে। পাঠকদের জন্য মাটির মানুষ, গানের সোনার মানুষ কাঙালিনী সুফিয়ার আঞ্চলিক কথাগুলো পরিমার্জিত করে দেয়া হলো। সাক্ষাতকার নিয়েছেন লিমন আহমেদ ও ছবি তুলেছেন মাহবুব আলম


kangalini

জাগো নিউজ : লালন সাঁইয়ের ‘বাড়ির পাশে আরশিনগর-সেথায় পড়শি বসত করে’ গানে আপনি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। তা পড়শির দেখা পেলেন?

সুফিয়া : সে পড়শী মনের মাঝে থাকে। খুব আপনার সে। তবু ধরা দেয় না। পড়শীর দেখা কী আর অত সহজে মিলে বাজান! এখনো খুঁজতাছি। মনে হয় না আর এই জনমে পাবো। মরণের পরে জানি পাই তারে।

জাগো নিউজ : কতো বছর ধরে গান করছেন?
সুফিয়া : সে পঞ্চাশ বছরের বেশিই হবে। ১৪ বছর বয়স থেকে গান করি। দিনে দিনে গানই পেশা হয়ে গেলো। গান ছাড়া এখন আর কিছুই ভালো লাগে না।

জাগো নিউজ : অনেক দিন পর আপনার অ্যালবাম প্রকাশিত হলো। কেমন লাগছে?
সুফিয়া : খুব ভালো লাগছে। অনেকদিন অসুস্থ ছিলাম। গান করতে পারবো ভাবিনি। কিন্তু আমার মা জননী আনুশেহ’র জন্য (কাঙালিনী সুফিয়া আনুশেহ আনাদিলকে আনুশিয়া বলে ডাকেন) জন্য এই অ্যালবামটি বের করতে পেরেছি। তিনি নিজে সব ব্যবস্থা করে দিছেন। আমি শুধু গাইলাম। আমার এটাই প্রথম সিডি। আমি এর আগে অনেক ক্যাসেটে গান করেছি। কিন্তু কোনো সিডিতে একক অ্যালবাম নেই। পান্থ কানাইয়ের সঙ্গে একটি অ্যালবামে সিডিতে গেয়েছিলাম। কিন্তু একক কোনো সিডি ছিলো না। এই আক্ষেপ শুনে মা আনুশেহ বললো- ‘তোমার একটা সিডি করে দেব আমি।’ অবশেষে পেলাম। এই অ্যালবামের জন্য আমার মা আনুশেহ অনেক পরিশ্রম করেছে। তার অনেক টাকা-পয়সা গেছে। আমার গানের এমন দিন দেখতেছি- এটা আমার সৌভাগ্য! আর এর সবটুকুই মা আনুশেহ’র অবদান।

kangalini

জাগো নিউজ : অ্যালবামে কয়টা গান আছে?
সুফিয়া : ১১টা গান আছে। আমার নিজের কিছু বাউল গান আছে। লালনের গান আছে। লালনের গান না করলে কী মন ভরে। আহা! সাঁইজির মতো কেউ নয়। আরো আছে। বিজয় সরকারের গান আছে।

জাগো নিউজ : আপনার গায়কীর একটা বিশেষত্ব আছে। আপনি সেটা বুঝতে পারেন?
সুফিয়া : একেকজনের কাছে একেকরকম লাগে। তবে আমি যখন গাই সবকিছু ভুলে যাই। মনে হয় নিজেরে নিজেই চিনি না। গানে টান দিলেই অচিন দেশে চলে যাই। মনে হয় দেহ বুঝি ফানাফিল্লাহ হয়ে যায়।

জাগো নিউজ : অনেকদিন অসুস্থ ছিলেন আপনি। শরীরটা এখন কেমন?
সুফিয়া : আপনাদের দোয়ায় এখন ভালো আছি। হাঁটা-চলা করতে পারি। গান গাইতে পারি। মা আনুশেহ আমার অনেক দেখভাল করেছে।

জাগো নিউজ : চিকিৎসার অভাবে ভুগছিলেন বলে জানিয়েছিলেন। অর্থের সমস্যা ছিলো। সেগুলো কীভাবে মিটলো?
সুফিয়া : আপনারা সাংবাদিকরা পত্রিকায় রিপোর্ট করছেন- ভালো নাই কাঙালিনী সুফিয়া। তাই দেখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধুর কন্যা আমার খোঁজ নিছেন। আমারে সাহায্য করছেন। উনি প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিছেন। উনার বাপের নামের যে হাসপাতাল (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) সেখানে বিনা পয়সায় চিকিৎসা করে দেয়। উনি খুব ভালো মানুষ। গরিবের উপকার করেন। আর আমার মা জননী আনুশেহর কাছে আসলে সেও যখন যা পারে, দেয়। কখনো ৫ হাজার, কখনো ১০ হাজার। কোনো হিসাব নেই। আমি কাঙালিনী দোয়া করি আল্লায় যেন আমার মা জননীরে সবসময় ভালো রাখে।

kangalini

জাগো নিউজ : আপনার গুরু কে? কারো কাছে গান শিখেছেন?
সুফিয়া : আমার গুরু ছিলেন গৌর মহন্ত ও দেবেন খ্যাপা। উনাদের কাছে আমি গান শিখেছি। আর হালিম বয়াতির কাছ থেকেও একটা গান শিখেছিলাম।

জাগো নিউজ : এখন আপনার গানের একটি দল আছে। এরা আপনার সঙ্গে বাদ্য বাজান। কিন্তু আপনার কোনো শিষ্য আছে যারা আপনার গান বা আপনার সাধনাকে ধরে রাখতে পারে?
সুফিয়া : আমার কোনো শিষ্য নাই বাজান। জোর করে তো আর শিষ্য বানানো যায় না। কেউ যদি শিখতে আসে আমি শিখাতে পারবো। অনেকে আমার গান গায় আমি জানি। মাঠে-ঘাটে, টিভিতে-রেডিওতে। সিডিতেও অনেকে গায়। দেখা হলে লম্বা করে সালাম দেয়। কাছে আসে। দুই এক কথা বলে। কিন্তু মা আনুশেহর মতো কেউ না। তার মতো কেউ আমারে ভালোবাসে নাই। আমি তারে নিয়াই খুশি।

জাগো নিউজ : অনেকে তো আপনার গান গেয়ে টাকা উপার্জন করে। তারা কী কখনো দেখা করে বা কোনো সাহায্য দেয়?
সুফিয়া : ওই বললাম, দেখা হলে সালাম দেয়। জিজ্ঞেস করে আছি কেমন। ব্যাস। এইসব নিয়া আমার অবশ্য চিন্তা নাই। আমি চাই সবাই ভালো থাক, ভালো করে গান করুক।

জাগো নিউজ : পঞ্চাশ বছর ধরে গান করছেন। অনেক প্রজন্ম আপনি মুগ্ধ করেছেন। কিন্তু আজকের এই প্রজন্মের সঙ্গে আপনার খুব একটা পরিচয় নেই। তাদের কাছে নিজের অ্যালবামটি কীভাবে তুলে ধরবেন?
সুফিয়া : আমি অতো কঠিন বুঝি না। আমি গানের মানুষ, গান করে স্বাদ পাই। যদি আমার গানে ভালো লাগার মতো কিছু থাকে তবে সবাই শুনবে। আগেও যেমন শুনছে এখনো শুনবে। কারণ, সবারই মা আছে। সবাই মাকে ভালোবাসে। মায়ের গান সবারই ভালো লাগে। আর এখনকার ছেলেমেয়েরা লালনের গানও ভালোবাসে। সবার কাছে বলি- আপনারা আমার একটা সিডি কিনবেন। গান শুনবেন।

এলএ/এবিএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।