প্রীতিলতা চলচ্চিত্রের শুভকামনায়


প্রকাশিত: ০৭:৫৫ এএম, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬
ছবি : মনজুর আলম

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে প্রথম বাঙালি নারী শহীদ। মাত্র ২১ বছরের জীবনে (১৯১১-১৯৩২) তিনি ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করে ইতিহাসকে নন্দিত করে রেখেছেন।

গেল শুক্রবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ছিলো এই বীরকন্যার আত্মাহুতির ৮৪ বছর। এ উপলক্ষে এক স্মরণ সভার আয়োজন করা হয় শুক্রবার বিকাল ৪টা ৩০ মিনিটে হোটেল সোনার গাঁওয়ের ব্যালকনি হলে। সেখানে তাকে স্মরণের মাধ্যমে সম্মান জানানোর পাশাপাশি তাকে নিয়ে www.banglarpritilata.com নামে একটি ওয়েবসাইটের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়।

‘এ সময়েও কেনো প্রীতিলতা গুরুত্বপূর্ণ’ শীর্ষক একটি আলোচনা সভাও অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বক্তব্য রাখেন ভাস্কর-মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষীনি, মডেল-ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেল, সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, কবি কাজী রোজি, নারী আন্দোলনের সংগঠক আয়েশা খানম, সাংবাদিক-সম্পাদক শ্যামল দত্তসহ আরও অনেকেই। সবাই প্রীতিলতাকে নিয়ে নির্মিত হতে যাওয়া চলচ্চিত্রের জন্য শুভকামনাও জানান।

সবাই নিজ নিজ বক্তব্যে প্রীতিলতার জীবন ও তার সংগ্রামকে তুলে ধরেন। ভাস্কর-মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষীনি বলেন, ‘আমার জীবনকে যে ক’জন নারী অদৃশ্যভাবে আজকের এই মঞ্চে আসতে সাহস দিয়েছেন প্রীতিলতা তাদের অন্যতম। ৮৪ বছর হয়ে গেল আমরা তাকে হারিয়েছি; তবু তার জীবন উৎসর্গ করার যে মহাত্ম, তাকে চর্চার যে প্রয়োজনীয়তা- একচুল কমেনি। বরং নারীদের জন্য ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠা এই পৃথিবীতে প্রীতিলতার আদর্শকে ধারণ করার বিকল্প কিছু নেই। এটা খুবই আনন্দের ব্যপার আমাদের তরুণ প্রজন্ম এই বিপ্লবী নারীকে মনে রেখেছে। তাকে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহী হয়েছে। আমি তাদের জন্য শুভকামনা রেখে গেলাম।’

সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেন, ‘প্রীতিলতা বাংলার নারীদের সাহসের জায়গা। মাত্র ২১ বছরের জীবন ছিলো তার। ছোট্ট এই সময়টাতেই তিনি অনেক কিছু করে দেখিয়েছেন। তিনি ছিলেন ভালো একজন ছাত্রী। ইডেন কলেজ থেকে অনার্সে প্রথম হয়েছিলেন। খুব ভালো বেহালা ও বাঁশি বাজাতেন। চট্টগ্রামের একটি অঁজপাড়াগায়ের স্কুলের হেডমাস্টার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। তার থেকেও বড় বিষয়, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যেখানে নারীদের এড়িয়ে চলতেন বিপ্লবীরা সেখানে তিনি পুরুষদের চেয়েও বেশি সাহস ও সাফল্য দেখিয়েছিলেন। ব্রিটিশ আমলে চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে ছিলো ইউরোপিয়ান ক্লাব। এই ক্লাবটিতে একটি সাইনবোর্ড লাগানো ছিলো যাতে লেখা ছিলো ‘কুকুর এবং ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ’। প্রীতিলতা সেই ক্লাবটি আক্রমণ করেছিলেন। প্রথমে সেখানে হামলা চালাতে গিয়ে পুরুষরা ব্যর্থ হয়েছিলেন। পরে মাস্টার দা সূর্যসেনের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ১৫ জন সঙ্গীসহ সফল হামলা চালান প্রীতিলতা এবং ধরা পড়েন। সেখানেই তিনিই সায়ানাইড খেয়ে জীবন বিসর্জন দেন। এমন নারীর আদর্শ চিরকালই নারীদের অনুপ্রাণীত করবে। আমি প্রীতিলতাকে নিয়ে ১৯৮২ সালে একটি উপন্যাস লিখেছিলাম। সেই সময় অনেক পড়েছি তাকে নিয়ে। অনেক জায়গায় ঘুরেছি প্রীতিলতার নাম জড়ানো এমন সব স্থানে। আমি অবাক হয়েছি এই বিপ্লবীর জীবন পর্যবেক্ষণ করে। যারা প্রীতিলতাকে নিয়ে ছবি নির্মাণ করতে যাচ্ছেন আমি তাদের সাধুবাদ জানাই এবং তাদের সঙ্গে আছি।’

অনুষ্ঠানে প্রীতিলতাকে নিয়ে কবি ও সাংসদ কাজী রোজি একটি কবিতা পড়ে শোনান। সংগ্রামী চেতনায় উদ্দীপ্ত সেই কবিতায় তিনি প্রীতিলতাকে বাংলার স্বাধীনতা অর্জনে অগ্রনী শহীদ বিপ্লবী হিসেবে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানান।

প্রীতিলতাকে নিয়ে মডেল-ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেল বলেন, ‘আমার জীবনে এই বিপ্লবী অনেকটা জায়গা দখল করে আছেন। যখন আমি ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে কাজ শুরু করি তখন নারী বলে অনেকেই আমাকে সরে যেতে বলেছে, থেমে যেতে বলেছে। কিন্তু প্রীতিলতার মতো নারীরা আমাকে সাহস দিয়েছেন। আঙুল দিয়ে বুঝিয়েছেন, তোমাকে সামনেই যেতে হবে। প্রথা ভাঙাই বিপ্লবীর নিয়ম। আমি মনে করি প্রীতিলতার আদর্শ ও তার আত্মাহুতি চিরকাল অম্লান রইবে। বিশেষ করে নারীদের কাছে তিনি অনুপ্রেরণার বিশাল সাম্রাজ্য। প্রীতিলতার কোনো কাল নেই, ক্ষয় নেই। আমি খুবই আনন্দিত তাকে নিয়ে নির্মিত ছবিটিতে পোষাক পরিকল্পনায় থাকবো। অনেকেই হয়তো জানেন না, প্রীতিলতা ছিলেন একজন ফ্যাশন প্রিয় নারী। তার শাড়ি পড়ার ধরণ, ব্লাউজের স্টাইল সেই প্রমাণ দেয়। আমি চেষ্টা করবো প্রীতিলতার সময়টাকে মাথায় রেখে কাজ করতে।’

নারী সংগঠক আয়েশা খানম বলেন, ‘প্রীতিলতা আমাকে অনুপ্রাণীত করেছে। কালে কালে অনেক নারীকে সাহসী করে তুলেছে। এই বিপ্লবীর জীবন পাঠ্যসূচিতে রাখা উচিত। সব প্রজন্মেই তাকে ছড়িয়ে দেয়া উচিত।’

প্রীতিলতা ট্রাস্টের উপদেষ্টা ও সাংবাদিক-সম্পাদক শ্যামল দত্ত তার বক্তব্যে বলেন, ‘আজ খুব বেদনা নিয়ে দেখতে হচ্ছে আমাদের মা-বোনেরা নিষিদ্ধ সব জঙ্গি সংগঠনগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে। অথচ এটা আমাদের ইতিহাস নয়, পরিচয় নয়। আমাদের নারীদের পরিচয় প্রীতিলতা, বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল, জাহানারা ইমামেরা। দেশের নারীদের সঠিক পথে রাখতে, ন্যায়ের পথে রাখতে প্রীতিলতার জীবন ও সংগ্রামকে তাদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। সেক্ষেত্রে চলচ্চিত্র হতে পারে দারুণ মাধ্যম। আমি প্রীতিলতা চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত সকলকে অভিবাদন জানাই। আমি তাদের সঙ্গে হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা নিয়েই আছি।’

বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব ছিলেন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা। পলাশীর যুদ্ধে তার পরাজয় ও মৃত্যুর পরই ভারতবর্ষে ইংরেজ-শাসনের সূচনা হয়। সেই ইংরেজ শাসনের জুলুম, অত্যাচার, হত্যা, মিথ্যা, মামলাসহ নানান নিপীড়নের বিরুদ্ধে নিজ জন্মভূমিকে স্বাধীন করার জন্য প্রথম যে বীর বাঙালি নারী প্রাণ দিয়েছিলেন তার নাম প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।

এই প্রীতিলতার জীবন কাহিনি নিয়ে স্বনামে নির্মাণ হচ্ছে একটি চলচ্চিত্র। গোলাম রাব্বানীর চিত্রনাট্য ও সংলাপে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করছেন রাশিদ পলাশ। এ চলচ্চিত্রের কসটিউম ডিজাইনার হিসেবে কাজ করছেন বিবি রাসেল। পান্ডুলিপি উপদেষ্টা হিসেবে আছেন সেলিনা হোসেন ও মাতিয়া বানু শুকু।

বর্তমানে চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্য এবং প্রি-প্রোডাকশনের কাজ চলছে। শিগগিরই ছবির অন্যান্য চরিত্রের অভিনয়শিল্পীদের নাম ঘোষণা করা হবে বলে জানালেন পরিচালক। এই ছবির সঙ্গে প্রীতিলতা ট্রাস্টও যুক্ত রয়েছে।

এলএ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।