নাট্যাচার্যের জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি

নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনকে বলা হয় রবীন্দ্রোত্তর কালের শ্রেষ্ঠ নাট্যকার। গভীর চাহনির সহজ মানুষ হিসেবেও তার পরিচিতি আছে বেশ। দেখলেই মনে হত গভীর এক ভাবনায় মগ্ন তিনি। সেই ভাবনাগুলো কত সুন্দর, কত সৃজনশীল তা টের পাওয়া যেত তার রচিত নাটকের চরিত্রে, সংলাপে।
আজ ১৮ আগস্ট সৃষ্টির এই কারিগরের ৬৪তম জন্মদিন। শুভ দিনে তার প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।
জন্ম ও শিক্ষা
১৯৪৯ সালের এই দিনে ফেনীর সোনাগাজী থানার সেনেরখিল গ্রামে জন্ম সেলিম আল দীনের। তার ছিল বর্ণাঢ্য এক শিক্ষা জীবন। পড়াশুনার হাতেখড়ি তার আখাউড়ায় গৃহশিক্ষকের কাছে। এরপর সেনেরখিল প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হন এবং সেখানে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন।
তারপর মৌলভীবাজার বড়লেখার সিংহগ্রাম হাইস্কুল, কুড়িগ্রামের উলিপুরে মহারাণী স্বর্ণময়ী প্রাইমারি স্কুল এবং রংপুর ও লালমনিরহাটের স্কুলে পড়েন। পরে নিজ গ্রাম সেনেরখিলের মঙ্গলকান্দি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এ স্কুল থেকেই মাধ্যমিক পাস করেন ১৯৬৪ সালে।
ফেনী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন ১৯৬৬ সালে। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়ে দ্বিতীয় বর্ষ পর্যন্ত পড়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেন। পরে টাঙ্গাইলের সাদত কলেজ থেকে স্নাতক শেষ করেন এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি করেন। ১৯৯৫ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি লাভ করেন তিনি।
কর্মজীবন
প্রথমে তার কর্মজীবনের শুরু বিজ্ঞাপনি সংস্থা ‘বিটপি’তে কপি রাইটার হিসেবে। পরে ১৯৭৪ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন এবং আমৃত্যু এই বিশ্ববিদ্যালয়েই ছিলেন। তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন।
নাট্য ও সাহিত্য জীবন
নাটকে সেলিম আল দীনের অঙ্কুরোদগম হয়েছিল স্কুল জীবনেই। এভাবে একটু একটু তৈরি হতে থাকে একজন শিল্পীর সৃজনশীল মনন। মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত, জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়ে বিমুগ্ধ তরুণ সেলিম আল দীন কবিতার মাধ্যমেই আত্মপ্রকাশ করতে চাইলেন নিজেকে। কিন্তু কিছুতেই কবিতার ভাষাটি আয়ত্তে আসছিল না তার। এই বেদনা তাকে তাড়িয়ে ফেরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকার সময়েও।
সাহিত্যের কোন শাখাকে পথচলার মাধ্যম হিসেবে বেছে নেবেন, এই টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়েই শুরু হয় নাটকের পথে হাঁটা। শুরু হয় নাটক লেখা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তঃহল নাট্য প্রতিযোগিতার জন্য প্রথম নাটক লেখেন। জীবনের বাকিটা সময় তিনি নাট্য জগতকে সমৃদ্ধ করেছেন।
১৯৭৩ সালে নাট্য নির্দেশক নাসির উদ্দিন ইউসুফের সঙ্গে ঢাকা থিয়েটার প্রতিষ্ঠার পর নাটক লেখার ধারা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি সেলিম আল দীন নিজস্ব এক নাট্যরীতির অনুসন্ধান চালিয়ে যান। প্রসেনিয়ামের গণ্ডিতে বাঁধা ইউরোপিয়ান নাট্য-আঙ্গিক তিনি পরিত্যাগ করেন। খুঁজে বের করলেন বাংলা নাটকের হাজার বছরের পুরনো শিল্পরীতিকে। এ নাট্যরীতি আমাদের একেবারেই নিজস্ব। ছোটগল্প, উপন্যাস বা প্রবন্ধের মতো পাশ্চাত্যের প্রেরণাতাড়িত বিষয় নয়।
ভারতীয় নাট্যশাস্ত্রের নির্যাস ও বাংলা ভাষার মধ্যযুগের সাহিত্যরীতি থেকে পাওয়া শিল্প উদ্দীপনাগুলো, এমনকি শব্দপ্রতিমাকে নতুন করে জাগিয়ে তুললেন নিজের সৃষ্টিকর্মে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করার পর সেলিম আল দীনের উদ্যোগেই ১৯৮৬ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘নাটক ও নাট্যতত্ত্ব’ বিভাগ। একদিকে শিক্ষকতার দায়িত্ব, অন্যদিকে লেখালেখি।
পাশাপাশি চালিয়ে যান আবহমান বাংলার লোকজরীতির অনুসন্ধান। গ্রাম থিয়েটারের হয়ে বাংলাদেশের নানা প্রান্তে ছুটেছেন লোক-নাট্যরীতির সন্ধানে। নিজের নাটকে সেসব প্রয়োগ করে বদলে দেন বাংলানাট্যের ধারা। আশির দশকের মাঝমাঝি সময় থেকে তিনি গান লেখা শুরু করেন। নাটকের গান তো ছিলই। পাশাপাশি আরও অনেক গান লিখেছিলেন। তিনি গানকে বলতেন ‘কথাসুর’।
চলে যাওয়া
২০০৮ সালে হঠাৎ করেই তিনি অসুস্থ হয়ে ঢাকার ল্যাব এইডে ভর্তি হন। কেউ ভাবেন নি চলে যাবেন তিনি। চলে যাবার মত বয়স খুব কিছু হয়ে যায়নি তার। সবার বিশ্বাস ছিল আবার ফিরবেন তিনি। লিখবেন আরও কিছু কালজয়ী নাটক।
কিন্তু ফেরা হয়নি তার। সকল মায়া সাঙ্গ করে ২০০৮ সালের ১৪ জানুয়ারি না ফেরার দেশে পাড়ি দিলেন বাংলা নাটকের অবিসংবাদিত পুরুষ সেলিম আল দীন। যেদিন তিনি মারা যান, দেশের পুরো সংস্কৃতি অঙ্গন সেদিন শোকে স্তব্ধ হয়ে ছিল।
প্রিয় ক্যাম্পাস, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটিতেই অনন্তকালের জন্য ঘুমিয়ে আছেন তিনি।
সৃষ্টি সকল
সেলিম আল দীনের লেখা নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে, ‘সর্পবিষয়ক গল্প ও অন্যান্য নাটক’ (১৯৭৩), ‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন’ (১৯৭৫), ‘বাসন’ (১৯৮৫) ‘মুনতাসির’, ‘শকুন্তলা’, ‘কীত্তনখোলা’ (১৯৮৬), ‘কেরামতমঙ্গল’ (১৯৮৮), ‘যৈবতী কন্যার মন’ (১৯৯৩), ‘চাকা’ (১৯৯১), ‘হরগজ’ (১৯৯২), ‘প্রাচ্য’ (২০০০), ‘হাতহদাই’ (১৯৯৭), ‘নিমজ্জন’ (২০০২), ‘ধাবমান’, ‘স্বর্ণবোয়াল’ (২০০৭), ‘পুত্র’, ‘স্বপ্ন রমণীগণ’ ও ‘ঊষা উৎসব’।
রেডিও ও টেলিভিশন প্রচারিত নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে, ‘বিপরীত তমসায়’ (রেডিও পাকিস্তান, ১৯৬৯), ‘ঘুম নেই’ (পাকিস্তান টেলিভিশন, ১৯৭০), ‘রক্তের আঙ্গুরলতা’ (রেডিও বাংলাদেশ ও বিটিভি), ‘অশ্রুত গান্ধার’ (বিটিভি, ১৯৭৫), ‘শেকড় কাঁদে জলকণার জন্য’ (বিটিভি ১৯৭৭), ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’ (আয়না সিরিজ, বিটিভি ১৯৮২-৮৩), ‘গ্রন্থিকগণ কহে’ (বিটিভি ১৯৯০-৯১), ‘ছায়া শিকারী’ (বিটিভি ১৯৯৪-৯৫), ‘রঙের মানুষ’ (এনটিভি ২০০০-২০০৩), ‘নকশীপাড়ের মানুষেরা’ (এনটিভি, ২০০০), ‘কীত্তনখোলা’ (আকাশবাণী কোলকাতা, ১৯৮৫)।
গবেষণাধর্মী নির্দেশনাগুলোর মধ্যে রয়েছে, ‘মহুয়া’ (ময়মনসিংহ গীতিকা অবলম্বনে, ১৯৯০), ‘দেওয়ানা মদিনা’ (ময়মনসিংহ গীতিকা অবলম্বনে, ১৯৯২), ‘একটি মারমা রুপকথা’ (১৯৯৩), ‘কাঁদো নদী কাঁদো’, ‘মেঘনাদ বধ’ (অভিষেক নামপর্ব)।
এছাড়া ১৯৯৪ সালে ‘চাকা’ নাটক থেকে এবং ২০০০ সালে ‘কীর্ত্তনখোলা’ নাটক থেকে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। ‘একাত্তরের যীশু’ চলচ্চিত্রের সংলাপের রচয়িতাও তিনি।
অর্জন
সেলিম আল দীনের মতো মানুষের সবচাইতে বড় অর্জন মনের মাধুরী মিশিয়ে সৃষ্টির নেশায় মত্ত হতে পেরেছিলেন তিনি। একের পর এক নাটক-নাট্যভাবনাকে ভেঙ্গেছেন তিনি, আবার গড়েছেনও তিনি। জয় করে নিয়েছেন নাট্যাচার্যের খেতাব।
এছাড়াও সেলিম আল দীনের অর্জন করা জাতীয়-আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মাননাগুলো হলো, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৪), ঋষিজ কর্তৃক প্রদত্ত সংবর্ধনা (১৯৮৫), কথক সাহিত্য পুরস্কার (১৩৯০ বঙ্গাব্দ), একুশে পদক (২০০৭), জাতীয় চলচিত্র পুরস্কার (১৯৯৩), অন্য থিয়েটার (কলকাতা কর্তৃক প্রদত্ত সংবর্ধনা), নান্দিকার পুরস্কার (আকাদেমি মঞ্চ কলকাতা ১৯৯৪), শ্রেষ্ঠ টেলিভিশন নাট্যকার (১৯৯৪), খালেকদাদ সাহিত্য পুরস্কার, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৪), মুনীর চৌধুরী সম্মাননা (২০০৫)।
শেষকথা
পৃথিবীতে অনেক গুণী ব্যক্তির সৃষ্টি বুঝতে সময় লেগেছে। সেলিম আল দীনকেও বুঝতে সময় লাগবে। তার কারণ সেলিম আল দীনের ভেতর ছিল সৃষ্টির গভীরতা। গভীর সৃজন বোঝা সময়ের ব্যাপার। এমনটাই ধারণা নাট্য বোদ্ধাদের।
তবে বাংলা নাটকের সমৃদ্ধি আর নিজস্বতা আনয়নে নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের অবদানের পরিচয় নিতে বোদ্ধা হতে হয় না। কেবল নাটকটা পড়তে জানলেই চলে। আজকের সুন্দর এই দিনে যেখানেই থাকুন, যেভাবেই থাকুন ভাল থাকুন আমাদের নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন।
এলএ/এইচআর/আরআইপি