চাষীর হৃদয় দেখেছি ভালোবাসায় নত হয়ে


প্রকাশিত: ০৮:১৫ এএম, ১১ আগস্ট ২০১৬
ছবি: মাহবুব আলম

এইসব গল্প বলার উদ্দেশ্য অনেক। স্ত্রী হিসেবে আমি বলবো প্রয়াত চলচ্চিত্রকার চাষী নজরুল ইসলামকে নিয়ে স্মৃতিচারণই মূল। কারণ, হারিয়ে ফেলা প্রিয় মানুষটিকে ভুলে থাকা যায় না। বিশেষ করে আমার মতো জীবনের শেষ বেলার প্রান্তে দাঁড়ানো, দীর্ঘ দিনের সঙ্গী হারানো মানুষের জন্য এ বড় বেদনার। কেবলই চাষীকে ভাবতে ইচ্ছে করে। কেবলই তাকে দেখতে ইচ্ছে করে। তার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে। সেই ভাবনা থেকেই প্রতিদিন চাষীকে নিয়ে লেখি। অদ্ভূত হলেও সত্যি; আজ দারুণ এক বিষয় উপলব্ধি করছি। লেখকরা মৃত মানুষদের সঙ্গে কথা বলতে পারে, দেখতেও পারে। কেননা, লেখকের কাছে তার চরিত্ররা জীবন্ত থাকে সবসময়। স্বামীর স্মৃতিচারণের বাইরেও তবু আরো অনেক কিছু থেকে যায় এইসব গল্পে। আসে চলচ্চিত্র, চলচ্চিত্রের মানুষ, ইন্ডাস্ট্রির বাঁক বদল, রুপালি জগতের মানুষদের আচরণ-সভ্যতা-রুচিবোধ। আসে উত্থান পতনের ইতিহাস। চাষীর বউ হিসেবেই এই ইন্ডাস্ট্রির অনেক কিছুর সাক্ষী হয়েছি, দেখেছি, শিখেছি ও বুঝেছি। সেইসব অভিজ্ঞতারা এই নিঃসঙ্গ দিনগুলোতে বারবার ফিরে আসে মনের মাঝে। আমার গল্পের কেউ নেই আজ। চাষী গেছে সব গেছে। তাই অগোছালো লেখালেখি। সব পাঠকের সঙ্গে অদৃশ্য গল্পবাজি।

chasi

এক.
আমার দেখা সব মানুষের মিছিলে বন্ধু পাগল মানুষ একজনই ছিল ‘চাষী’। আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুর খ্যাতিটাও চাষী আমার কাছে থেকে চুরি করে নিয়েছে আমার মনের অজান্তে। শিশু, নবীন, প্রবীণ সব বয়সের বন্ধুর তালিকা ছিল চাষীর। এমনকি পশু পাখির প্রতিও তার দরদ ছিলো দেখবার মতো বিষয়। তার এই কোমল হৃদয়ের খবর জানতো কাছের সবাই। সেজন্য যেমন গর্ব হতো তেমনি তাকে নিয়ে অনেক বিড়ম্বনার মুখোমুখিও হতে হয়েছে।chasichasi

তাদের মধ্যে উল্লেখ্য হলেন ডাক্তার ফারুক। তিনি ছিলেন কলেরা বিশেষজ্ঞ। যুদ্ধ ও ভয়াবহ বন্যা পরবর্তী বাংলাদেশের প্রধানতম সমস্যা ছিল বিভিন্ন পানিবাহিত রোগ। বিদেশি নানা সংস্থা থেকে বহু ডাক্তাররা আসছেন আমাদের দেশে। আমাদের দেশীয় চিকিৎসকরাও খুব ব্যস্ত। সেই ব্যস্ততার মধ্যেও ডা. ফারুক এই ব্যস্ততার মধ্যে চাষীর সঙ্গে সন্ধ্যায় দেখা না হলে, এক কাপ চা একসঙ্গে না খেলে পাগল হয়ে যেতেন। অন্য দিকে চাষীরও একই অবস্থা। অদ্ভূত এক বন্ধুত্ব। বাংলাদেশে তৎকালীন সমস্যার মোকাবেলার করার জন্য কলেরা বিশেষজ্ঞ ডাক্তার কেন আসলেন। তিনি তার প্রিয় দুটো কুকুরের বাচ্চা ‘স’ ও ‘শেলী’কে  নিয়ে আসেন। কিন্তু দেশের যা অবস্থা আর তার ব্যস্ততা এই নিয়ে দুটোকে লালন-পালন করার মতো সময় তার কাছে নেই। তাই ডা. ফারুকের কাছে সে সহযোগিতা চাইলো। মানুষকে ভালোবাসে এমন মানুষের কাছে সে সকে দিয়ে দিবেন। শর্ত শুধু নাম পরির্বতন করা যাবে না। ডা. ফারুকের কোনো সংসার ছিলো না। ঘর বলতে আমাদের বাড়ি আর তার কাছে ভালো মানুষ বলতে চাষী। ডা. ফারুক তাই নিয়ে এলেন সকে আমাদের গোপীবাগ, ২য় লাইন ঢাকার বাসায়।

চাষী আর আমার বড় মেয়ে মান্নী ইসলাম সকে দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলো। ছোট সংসার। আমাদের একটি মাত্র সন্তান আর একটি মাত্র শোবার ঘর ছিল। দুই পাশে দুটো খাট। আমার মেয়ে মান্নী’র বিছানার নিচে বিশেষ ব্যবস্থা করে স-এর শোবার ব্যবস্থা করা হলো। অচিন দেশের চিকিৎসকের সঙ্গে আসা কুকুরের বাচ্চাটি আমাদের পরিবারের একজন হয়ে গেল। মজার বিষয় হলো, আমাদের দুই বিছানার মাঝখানে চাষীর রাতের খাবার রাখা হতো। আমরা সবাই ঘুমিয়ে গেলেও কুকুরটি জেগে থাকত চাষীর জন্য। কেমন করে যেন চাষী’র আসার আভাস ও বুঝতে পারতো। আগেই ডেকে ডেকে আমাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে দিত। চাষী খাবার খেতে বসলে ও পাশে বসে থাকতো, কিছু দিলে খেতো না। এভাবে পরিবারের আত্মিক বাধঁনে ‘স’ অন্তরীক্ষ হয়ে উঠলো।

chasi

এদিকে ডা. ফারুক হঠাৎ করে আরো একটি বিদেশি কুকুরের বাচ্চা নিয়ে হাজির। এই কুকুরের বাচ্চাটি উলফের উপর কোর্স। ওর নাম ডেজি। আমেরিকান ভদ্র মাহিলা তিনি কলেরা গবেষণা হাসপাতালে লাইব্রেরিয়ান হিসেবে নিয়োজিত আছেন। তার স্বামী বাংলাদেশি। তৎকালীন সামাজিক বাস্তবতায় বাঙালি পরিবারে বিদেশি বউকে সহজে গ্রহণ করার প্রথা বিরল। তার উপর কুকুরের বাচ্চা! কুকুরের বাচ্চা সমেত বিলাতি বউ গ্রহণের প্রশ্নই আসে না! তাই ভদ্র মহিলা সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন ডা. ফারুকের কাছে। আর ডা. ফারুক হাজির আমার বাসায়।

কিন্তু কি আশ্চর্য  প্রথমদিন থেকে কুকুরটা আমার মায়ার খাচায় বন্দি হয়ে গেছে। এর মধ্যে আমি আমার বাবার বাসায় চলে এসেছি। গোপীবাগের চিড়য়া হাউজে। এই বাড়ি সৌন্দর্য্য হলো, সামনে পিছনে বড় বড় বারান্দা। বারান্দার এক পাশে লোহার খাচাঁয় ডেজিকে রাখা হলো। অন্যপাশে থাকে আমাদের প্রিয় ‘স’। এই দুই প্রাণী চাষীর চমৎকার হৃদয়ের সন্ধান পেয়েছিলো। সেই হৃদয় আমি দীর্ঘকাল দেখেছি ভালোবাসা আর শ্রদ্ধায় নত হয়ে।

দুই
প্রতিদিন ফজরের নামাজ পড়েই ভোরের আলো সঙ্গে নিয়ে আমাদের বাড়িতে হাজির হতেন খোকন ভাই। অবশ্য সবাই তাকে এটিএম শামসুজ্জমান নামেই জানে। যেমন অভিনয় করতে পারেন তেমনি গল্পের রাজাও তিনি। ফজরের নামাজ পড়ে সোজা আমাদের বাড়িতে চলে আসতেন, তারপর একসঙ্গে চলতো চা আড্ডা। মানুষটির একটি অদ্ভুত ক্ষমতা আছে বলতে হবে। তিনি গল্প দিয়ে কখনো কান্নাকে জয় করেন, আবার কখনো হাসিকে। আমি আর চাষী তার অনেক বড় শ্রোতা। তবে তাকে নিয়ে আমারো একটা মজার গল্প আছে। আমাদের বাড়ির প্রবেশ দ্বার দুটো ছিল। বড় গেট দিয়ে গাড়ি আসতো আর পকেট গেট ছিলো সাধারণ চলাফেরা জন্য। chasi

একদিন সকালে আমি একটু বেশি ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। যথারীতি খোকন ভাই ফজরের নামাজ পরে আমাদের বাড়ির সামনে হাজির। তিনি যখনই পকেট গেটে ধাক্কা দিয়েছেন, অমনি ‘স’ লাফিয়ে খোকন ভাইয়ের দিকে এগিয়ে যায়। খোকন ভাই ভয় পেয়ে তজবি হাতে দৌড় দেন। পিছনে শিকল হাতে আমাদের বাড়ির কাজের মামা ছুটেন, তার পিছনে চাষী। চাষী গিয়ে ‘স’কে শান্ত করে গলায় হাত দিয়ে আদর করে শিকল পরিয়ে দেয়। ‘স’র পক্ষ থেকে খোকন ভাইয়ের কাছে ক্ষমাও চায় চাষী। খোকন ভাইকে ভিতরে নিয়ে আসে। সে কী রাগ তার।

তারপর শুরু হলো আমাদের চা-চক্র। সেদিন ব্যতিক্রম এক বাস্তব গল্প বললেন খোকন ভাই।
আমার কাছে জানতে চাইলেন প্রখ্যাত নাট্যকারের নাম। তখন কেবল মাত্র সৈয়দ শামসুল হকের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় প্রকাশিত হয়েছে। পাশাপাশি নাট্যাঙ্গনে মামুনুর রশীদ, আব্দুল্লাহ আল মামুন, আলী যাকেররাও সুনামে কাজ করছেন। আমি তাদের নাম বললাম। তিনি হাসলেন, বললেন তাদের আগেও একজন আছেন, তিনি হলেন, আলী ইমাম। এই নামটার সাথে আমার প্রথম পরিচয় হলো, তাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। তিনি আলী ইমাম সম্পর্কে বললেন, এতো বড় নাট্যকার আমাদের এশীয় মহাদেশে কমই এসেছেন। কিন্তু ভাগ্য তাকে এখন অন্নহীন, বস্ত্রহীন, ঘরহীন করেছে। তাকে দেখবার মতো কেউ নেই, আমাদের এই ভুলে যাওযার দেশে।

তিনি আলী ইমামের ‘দুই পয়সার আলকা’ নাটকের একটা ঘটনা বললেন যেখানে খোকন ভাই নিজেও অভিনয় করেছেন। নাটক হচ্ছিল ইঞ্জিনিয়ার ইনিস্টিটিডটে। পুরো হল রুমে দর্শক ভর্তি।  সবাই অপেক্ষা করছে কখন নাটক শুরু হবে। অথচ নায়িকা উপস্থিত নেই। আলী ইমামের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। আমরা ভয়ে নাটক শুরু কলাম। পর্দা উঠল বাঁশির শব্দে। নায়িকা নেই তাই ঘুরে সংলাপ বলছি, দশ মিনিটি হয়ে গেল। হঠাৎ কোথা থেকে যেন নায়িকা বিলকিস বানু মঞ্চে উঠে গেলেন। কোন মেকআপ নেই, পোশাক নেই। নাটক চললো, বিরতি হলো।

আলী ইমাম এসে খুব ধমকালেন বিলকিস বানুকে। বলে রাখা ভালো তৎকালীন নাটকের জগতে এক নক্ষত্র ছিলেন বিলকিস বানু। আলী ইমামের ধমক শুনেও কোনা উত্তর বিলকিস বানু দিলেন না। আবার বাঁশি বাজলো নাটক শুরু হলো। তিনিও নাটকে অংশ নিলেন। করতালির মাধ্যমে একটা সফল প্রযোজনা শেষ হলো। আমার সবাই পোশাক পরিবর্তন করে, প্রথাগত নিয়ম অনুযায়ী চা আর ডাল পুরি খাচ্ছি এমন সময় মাথা নিচু করে বিলকিস বানু আলী ইমাম ভাইয়ের সামনে আসলেন। বললেন, আপনারা যে এতো বকা দিলেন, একবারও শুনতে চাইলেন না কেন আমি দেরি করলাম। আমরা সবাই থমকে গেলাম। সবার চোখ বিলকিস বানুর দিকে। তিনি নিজের পায়ের জুতো খুলে দেখালেন আর বললেন, এই যে মাঠি লেগে আছে এখন, সন্তানটাকে কবরে শোয়াতে দেরি হলো তাই আসতে পারিনি ঠিক সময়ে। নিজের সন্তান তো কবর না দিয়ে আসতে পারিনা। কথাটা শেষ না করতেই কান্নায় তার চোখ জমে গেল। আমরাও চোখের জলকে ধরতে রাখতে পারিনি। আমি আর চাষীও চোখ মুছলাম। দেখলাম খোকন ভাইও কাঁদছেন। সেদিনের সকালটা কাটলো একটু ব্যতিক্রম। যা শুরু হয়েছিল ‘স’কে দিয়ে।

chasi

তারপর অনেকটা সময় কেটে গেছে। আমাদের গল্প বন্ধু খোকন ভাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আমরা নতুন বাড়িতে উঠেছি ৬৬/হাফিজ রোড, সিদ্বেশ্বরীতে। পাশেই থাকেন চলচ্চিত্র সহঅভিনেত্রীরা। আমি আর চাষী রিক্সায় করে বাড়ির সামনে নামলাম। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে যাবো এমন সময় সেই অভিনেত্রী বিলকিস বানুর সাথে দেখা। চাষী বিলকিস বানুকে দেখে থেমে গেল। আমাকে পরিচয় করে দিল বিলকিস বানুর সঙ্গে। আমি বিস্ময় নিয়ে দেখছি আমার সামনে দাঁড়িয়ে সেরা অভিনেত্রী বিলকিস বানু। যে মানুষ অভিনয়ের জন্য জীবনকে তুচ্ছ করেছেন। সেই তিনি জীর্ণ, বস্ত্রহীন, ঘরহীন একজন ফেরারীর মতো দাঁড়িয়ে আছেন। আজ আর কেউ তাকে ম্যাডাম ডাকে না, অটোগ্রাফ চায় না, ইন্টারভিউ নেয় না। পত্রিকার পাতাগুলো আর তাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে না। তার চোখে কত দিনের খাদ্য খিদা কেউ খবর রাখে না!

চাষী তার হাত ধরে প্রায় জোর করেই বাড়িতে নিয়ে আসলো। অনেক কথা হলো। আমি তাকে খাবার দিলাম। তিনি খাবার হাতে নিয়ে নিরবে কাদঁছিলেন। চাষী নানা গল্প বলে তার মন ভালো করতে লাগলো। রাণী দি, সুমিতা দেবীর গল্প বললো। তারপর চাষী বিলকিস বানুকে আমাদের শোবার ঘরে নিয়ে এলো। আলমারি খুলে কাপড় দেখিয়ে দিয়ে বললো, আপনার যা পছন্দ, যে কটা পছন্দ নিয়ে যান। আমি এসে বললাম, আমার কোন দামি শাড়ি নেই, শাড়ি বেশি পড়িও না। আপনার যা পছন্দ নিয়ে যান। তিনি নিজের সাথে নিজে যুদ্ধ করে দুটো শাড়ি নিলেন। চাষী কিছু টাকা তার হাতে দিলেন। বিলকিস বানুর কষ্টের মুখে একটুর জন্য হলো হাসি এলো।

আমার মনের গভীর সত্ত্বা চাষীকে হাজার বার সালাম করলো। চাষী সত্যিকারের একজন শিল্পী মানুষ ছিলো। সে জানতো কিভাবে শিল্পীদের ভালোবাসতে হয়। তার কাছে আমি শিখেছি, কিভাবে মানুষকে ভালো বাসতে হয়। মানুষকে ভালোবাসলে ঈশ্বরকে উপলব্ধি করা যায়।

লেখক: কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার চাষী নজরুল ইসলামের সহধর্মিনী। তিনি চাষী নজরুল ফাউন্ডেশনেরও সভাপতি 

সম্পাদনা : লিমন আহমেদ

এইচআর/এবিএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।