বই পর্যালোচনা

ইভানার চিঠি: অবহেলিত নারীর প্রতিচ্ছবি

সাহিত্য ডেস্ক
সাহিত্য ডেস্ক সাহিত্য ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৪:০৮ পিএম, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪

সৈয়দা ফারজানা হোসাইন

বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের একটি বড় অংশজুড়ে রয়েছে নারীকেন্দ্রিক উপন্যাস। একজন নারী সমাজের সব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে নিজেকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে ‘ইভানার চিঠি’ উপন্যাসটি তারই প্রতিচ্ছবি। পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে নারীকেন্দ্রিক সাহিত্যের সৃষ্টি হয়েছে। যুগ যুগ ধরে বাঙালি সমাজ ব্যবস্থায় নারীরা অবহেলিত। নারীদের কেবল ভোগ্যবস্তু এবং সন্তান উৎপাদনের মাধ্যম বলে ধরে নেওয়া হয়।

একজন নারীকে নারী থেকে ‘মানুষ’ হয়ে ওঠার পেছনে অসংখ্য গল্প থাকে। পাশাপাশি নানা প্রতিবন্ধকতা নারীকে পিছু টানে। রহমান মল্লিকের ‘ইভানার চিঠি’ উপন্যাসটি নারীকেন্দ্রিক। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ইভানা। ইভানার মা রোকেয়া বনেদি পরিবারের মেয়ে। রোকেয়ার বিয়ে হয় বিল্লাল হোসেন নামক পোস্ট অফিসের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর সঙ্গে। বিল্লাল হোসেন প্রথম থেকেই রোকেয়াকে দেখতে পারতেন না। রোকেয়া ভেবেছিলেন সন্তান হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু বিধি বাম। রোকেয়ার কন্যাসন্তান হলে বিল্লাল হোসেন অসন্তুষ্ট হন এবং মেয়ে ইভানাকে মোটেও সহ্য করতে পারেননি।

ইভানা একক কোনো চরিত্র নয় বরং সামগ্রিক বাঙালি নারীর প্রতিচ্ছবি। রোকেয়া, ইভানারা যুগের পর যুগ অবহেলিত হয়ে আসছেন। উপন্যাসে ইভানার বয়স তখন দেড় বছর। ইভানাকে একদিন হঠাৎ করেই বাবার কোলে তুলে দিলেন মা রোকেয়া বেগম। শিশুটির প্রতি এতদিনেও তার কোনো মায়া তৈরি হয়নি। মুহূর্তেই মাত্র দেড় বছরের শিশুটিকে উঠানে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন বিল্লাল হোসেন। সে এক অভাবনীয় দৃশ্য।

দেড় বছরের মেয়ে ইভানা যেমন তার বাবার কাছে অবহেলিত, পরিণত ইভানা তার স্বামীর কাছেও অবহেলিত। এভাবে ইভানারা পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র দ্বারা অবহেলিত হতে থাকে। যদিও আমরা সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে নারীকে স্বাধীন মনে করি, মূলত নারীরা কখনোই স্বাধীন নয়।

ইভানার শৈশব কাটে পিতৃ আদরহীনভাবে। পাশের বাড়ি কাকা ইভানাকে স্নেহ করতেন। একদিন ইভানার কাকা তার জন্য রঙিন বই কিনে নিয়ে আসেন। ইভানা তার মায়ের কাছে লেখাপড়ার প্রথম পাঠ নেয়। কাকার উৎসাহ ও প্রেরণায় সে স্কুলে ভর্তি হয় এবং স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক সব বেলায়ই সে অত্যন্ত ভালো ফলাফল করে।

স্কুলে থাকাকালীন সে ওই বিদ্যালয়ের সিনিয়র ছাত্র ইমরানের সঙ্গে ঘটনাক্রমে পরিচিত হয় এবং একসঙ্গে একটি নাটকে অভিনয়ও করে। ইমরান সব সময় ইভানাকে পড়াশোনাতে উৎসাহ দিতো। ইভানার মেধা ও অধ্যবসায়ের ফলে সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায়। ইমরান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইভানার সঙ্গে দেখা করতে চলে আসে ঢাকায়।

ইমরান ও ইভানার মধ্যে ভালো একটা সুন্দর বোঝাপড়া থাকায় ভালো সময় কাটে তাদের। সারাদিন ঘোরাঘুরি শেষে ইমরান বিদায় নিলে ইভানা ইমরানের প্রতি টান অনুভব করে। যদিও এই টান শেষ পর্যন্ত পরিণতি পায়নি। ইভানা তার পরিবারের ইচ্ছে অনুযায়ী বিয়ে করে হাসান তারেক নামক একজন ডাক্তারকে। বিয়ের প্রথম দিকে তাদের দাম্পত্য জীবন ভালো কাটলেও শেষে তাদের বিচ্ছেদ হয়। কেননা ইভানার স্বামী মাদকাসক্ত। সে ইভানাকে নানাভাবে নির্যাতন করতো। ইভানা তাকে ডিভোর্স দিতে বাধ্য হয়। আপাতত উপন্যাসের কাহিনি অতোখানিই।

ইভানার চিঠি উপন্যাসের কাহিনি অত্যন্ত সাদামাটা। লেখক সচেতনভাবেই উপন্যাসের কাহিনিতে কোনো জটিলতা হয়তো নিয়ে আসেননি। এই সাদামাটা কাহিনির মধ্যেই ইভানার মতো নিম্নবিত্ত ঘরের মেয়ে কীভাবে জীবন সংগ্রাম করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে, লেখক তা যথাযথভাবে তুলে ধরেছেন। ইভানার চরিত্রের মধ্যে আমাদের বাঙালি সমাজের নারীর অবস্থান, জীবন সংগ্রাম, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির বিষয়গুলো তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। উপন্যাসে একজন নিম্নবিত্ত ঘরের মেয়ের শিক্ষা নেওয়ার বিষয় যেমন প্রাধান্য পেয়েছে; তেমনই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার পরও কীভাবে স্বামী কর্তৃক নির্যাতিত হয়, সে বিষয়ও ফুটে উঠেছে উপন্যাসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ হওয়ার পর ইভানা একটি এনজিওতে চাকরি পায়। ইভানা আর্থিকভাবে স্বচ্ছল এবং সে তার পরিবারের দায়িত্ব নিতে সক্ষম হয়। এ সক্ষমতা ও স্বচ্ছলতার পরও তাকে তার স্বামী কর্তৃক নিপীড়িত হতে হয়েছে। যা বাঙালি সমাজে প্রায়ই লক্ষ্য করা যায়।

ইভানার চিঠি উপন্যাসের কাহিনি বিন্যাস যতটা সহজ-সরল ভঙ্গিতে বর্ণিত, উপন্যাসের ভাষা প্রয়োগের ক্ষেত্রেও একই রীতি অবলম্বন করা হয়েছে। উপন্যাসের বেশিরভাগ চরিত্রই শিক্ষিত। সেজন্য উপন্যাসের ভাষা অনেকটাই সাবলীল ও শ্রুতিমধুর। শব্দ চয়নের ক্ষেত্রে লেখক বেশ সচেতন ছিলেন।

উপন্যাস সৃষ্টির ক্ষেত্রে পরিবেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একজন লেখকের জীবনদর্শন তার সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয়; তেমনই উপন্যাসের পরিবেশ তৈরির মধ্য দিয়ে সমগ্র উপন্যাসের সার্বিক অবয়ব ফুটে ওঠে। ইভানার চিঠি উপন্যাসে রহমান মল্লিক গ্রামবাংলার চিরায়িত গ্রামীণ পরিবেশ অঙ্কনের প্রয়াসী ছিলেন। যদিও কেন্দ্রীয় চরিত্র ইভানার বিশ্ববিদ্যালয় পড়াকালীন ও চাকরিকালীন শহরে পরিবেশেও নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছে।

ছোট পরিসরে আঁটোসাঁটো গড়নের সজ্জিত ইভানার চিঠি উপন্যাসে রহমান মল্লিক স্বীয় অনুভূতির পরিস্ফুটন ঘটিয়েছেন! গুটিকয়েক চরিত্র আর গ্রাম্য দুজন কিশোর-কিশোরীর কৈশোরসুলভ আবেগ-অনুভূতির দারুণ এক প্রকাশ ইভানার চিঠি। কৈশোরকালীন ভালো লাগার বিষয়কে লেখক প্রাপ্তবয়স্ক একটি নির্মল ভালোবাসার মার্জিত রূপরেখায় আবদ্ধ করেছেন।

লেখক: প্রভাষক ও পিএইচডি গবেষক।

এসইউ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।