পাবনার কবি ও কবিতা: বাংলা সাহিত্যের অমূল্য দলিল

জাগো নিউজ ডেস্ক
জাগো নিউজ ডেস্ক জাগো নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ১২:২১ পিএম, ১৫ আগস্ট ২০২৪

অলোক আচার্য

বাংলাদেশের উত্তরের একটি জেলা পাবনা। প্রাকৃতিক গঠনে এ জেলার সৌন্দর্য বর্ণনাতীত। তেরশ নদীর এই দেশে নদ-নদী, খাল-বিল বিধৌত এই জেলায় শতশত বছর ধরে জন্ম নিয়েছেন বহু প্রতিষ্ঠিত কবি-সাহিত্যিক। এসব সাহিত্যিকের নিরলস সাহিত্যচর্চায় বাংলা সাহিত্য হয়েছে সমৃদ্ধ। আজও সে প্রয়াস অব্যাহত আছে। একটি জেলা বলতে সেই জেলার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা রত্নকে বোঝায়। আবার নিভৃতে সাহিত্যচর্চা করে যাওয়া মানুষের সংখ্যাও কম নয়। যারা হয়তো লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে গেছেন। এই উভয়ের সৃষ্টিতেই সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলা সাহিত্য। যাদের সাহিত্যচর্চায় আজও বাংলা সাহিত্য আলোকিত হচ্ছে। বাংলা সাহিত্যের এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে এ জেলার কবি, গল্পকার, ছড়াকার, প্রাবন্ধিক তাদের সৃষ্টিশীল কাজের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। কবিতা, গল্প, উপন্যাস বা সাহিত্যের যে কোনো আলোচনা কোনো ব্যক্তি, ঘটনা বা স্থান সম্পর্কিত রচিত হতে পারে। তবে সেই সময়ের আবর্তনে সৃষ্টিকর্ম সেই ব্যক্তি বা স্থানে আবদ্ধ থাকে না। এটি ছাড়িয়ে যায় দেশ-কালের সীমানা। জীবনানন্দের বনলতা সেন কোনো এক বনলতাকে নিয়ে লিখলেও সেই বনলতা সেন এখন সব প্রেমিকের চোখে বনলতা।

বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা বা অঞ্চলের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে রয়েছেন বহু সাহিত্যিক। তাদের নামের সাথে সাথে সেই অঞ্চল হয়ে উঠেছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। প্রতিষ্ঠিত লেখক হোক বা নাই হোক; সাহিত্যচর্চা মানেই ভালো কিছু। সেই জেলা সম্পর্কে জানতে হলে জানতে হয় সেইসব মানুষগুলোকে। সুপরিচিত কবি বন্দে আলী মিয়া বা কবি ওমর আলী সবাই বাংলা সাহিত্যের একেকজন নক্ষত্র। সেই অতীতকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত সাহিত্যচর্চার এই ধারা যাদের হাত ধরে চলে আসছে; তাদের সবার সৃষ্টিকর্ম এবং তাদের সম্পর্কে জানার কাজটি সত্যিকার অর্থেই কঠিন। এজন্য একদিকে যেমন প্রয়োজন হয় তীব্র জ্ঞানাকাঙ্ক্ষা, অন্যদিকে সেই জ্ঞানাকাঙ্ক্ষা মেটানোর জন্য প্রয়োজন যুতসই একটি গবেষণাধর্মী গ্রন্থ। যে বইয়ে থাকবে সেই জেলার সেইসব মানুষের কথা, যারা শত শত বছর আগে থেকে বর্তমান পর্যন্ত সাহিত্যচর্চা করছেন। নিঃসন্দেহে কাজটি সহজ নয়।

একটি নতুন প্রজন্ম যারা সাহিত্যচর্চা করতে চান, যারা নিজ জেলা সম্পর্কে জানতে চান এবং যারা জ্ঞান অন্বেষণ করতে চান, তাদের জন্য এ ধরনের একটি গ্রন্থ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এরকম প্রায় দুরহ কাজটিই সম্পন্ন করেছেন একজন সৃষ্টিশীল মানুষ। পাবনা জেলার বহুমূল্য রত্নভান্ডারের খোঁজ একত্রে পাওয়া যায় এই জেলার শিক্ষাবিদ, লেখক এবং কবি আলাউল হোসেনের গবেষণামূলক কাব্যগ্রন্থে। বইটি হলো ‘পাবনার কবি ও কবিতা’। গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালে এবং দ্বিতীয় খণ্ড ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয়। নিঃসন্দেহে গ্রন্থ দুটি সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। গ্রন্থ দুটি পাঠে অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত কবি ও গল্পকার যারা নিয়মিত সাহিত্যচর্চা করেছেন এবং করছেন; আজও যাদের সাহিত্যে আমরা অনুপ্রাণিত হই, তাঁদের সম্পর্কে সহজেই জানতে পারি। তাঁদের লেখা সাহিত্যকর্মও পড়ার সুযোগ আছে উভয় গ্রন্থে। অনেক সাহিত্যিক আমাদের কাছে অনেকটাই অচেনা। তাদেরও কী চমৎকার সৃষ্টি রয়েছে; তা জানতে হলে বই দুটি পড়তেই হবে।

গ্রন্থদ্বয়ে আলাউল হোসেনকে তুলে আনতে হয়েছে আজ থেকে দুই শতাধিক আগে পাবনার চাটমোহর উপজেলার হরিপুর গ্রামে ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে জন্ম নেওয়া কবি প্রসন্নময়ী দেবী এবং তাঁরই সুযোগ্য কন্যা ১৮৭১ সালে একই উপজেলার গুনাইগাছা গ্রামে জন্ম নেওয়া কবি প্রিয়ম্বদা দেবী সম্পর্কে। ‘পাবনার কবি ও কবিতা’ বই থেকেই জানা যায় প্রিয়ম্বদা দেবীর অনবদ্য কবিতা ‘আশাতীত’ সম্পর্কে। কবি লিখেছেন, ‘তোমায় পারি না ধরিতে, পারি না ধরিতে/ মনেতে মিশিয়ে আপনা করিতে/ ওরে আকাশের আলো/ তোমায় পারি না ধরিতে, পারি না ধরিতে/ যতই বাসি না ভালো’। দুইশ বছর আগেও এমন চমৎকার কবিতা রচিত হয়েছে, তা তো অনেকের কাছেই আড়ালে ছিল। যা এই গ্রন্থ আলোর দ্বার উন্মোচিত করেছে।

তাঁর কবিতা সম্পর্কে যেমন এই বই থেকে ধারণা পাওয়া যায়; তেমনই জানা যায় বর্তমানে যারা এ জেলা থেকে সাহিত্যাঙ্গন আলোকিত করছেন তাঁদের সম্পর্কেও। শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্র যে মহাপুরুষের প্রতিষ্ঠিত সৎসঙ্গে আজ মানুষের মিলন মেলা, তাঁর লেখার প্রতিটি শব্দে ছিল মানুষের জীবন দর্শন। মানুষকে জীবনের পথ দেখিয়েছেন তিনি। বিভিন্ন দশকে যারা কবিতা লিখে সাহিত্যাঙ্গনকে পূর্ণ করেছেন, সেই কবিদের পরিচিতি, কবিতার পরিচয় ও গল্প, গল্পকার সম্পর্কে নতুন আগ্রহেরও জন্ম দেয়। এ ধরনের গবেষণাধর্মী গ্রন্থ রচনা করা একটি সাহসী, ধৈর্য এবং চ্যালেঞ্জিং কাজ। আলাউল হোসেন গুরুদায়িত্বটি গ্রহণ করেছেন। দুটি মলাটে প্রখ্যাত কবি ও গল্পকারদের আবদ্ধ করে সাহিত্যপ্রেমীদের জন্য কবি ও গল্পকার এবং তাদের সৃষ্টিকর্মের সাথে পরিচয় হওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন। ‘পাবনার কবি ও কবিতা’ গ্রন্থে ২৪৫ জন কবির কবিতা সংযোজন করা হয়েছে। কবি কৃষ্ণকিশোর রায়ের কবিতা থেকে শুরু করে এ সময়ের তরুণ প্রতিশ্রুতিশীল কবি জুবায়ের দুখুর কবিতা আছে। বইটি কেবল একটি দালিলিক প্রমাণ হিসেবেই গুরুত্বপূর্ণ নয় বরং একইসাথে অনেক গুণী কবির কবিতা সংযোজিত হওয়ায় তরুণ কবিরাও নিজেদের সমৃদ্ধ করতে সক্ষম হবেন।

সময়ের সাথে সাথে সেই জেলায় কবি-সাহিত্যিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। তখন ইতিহাসের সাথে এ গ্রন্থ একটি অমূল্য রত্ন হিসেবেই পরিগণিত হবে। এই নদী বিধৌত জেলাতেই জন্মগ্রহণ করেছেন প্রমথ চৌধুরী, বন্দে আলী মিয়া, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, ওমর আলী, সদ্যপ্রয়াত মাকিদ হায়দার, দাউদ হায়দার, মজিদ মাহমুদসহ বহু গুণি কবি। এখন যারা লিখে চলেছেন, তাদের মধ্যে আগ্রহী পাঠক হয়তো কোনো কবির বহু গ্রন্থ সংগ্রহ করেন এবং সেসব পাঠ করে সেই কবির কবিতা সম্পর্কে জানেন। কিন্তু একটি জেলার কবি বা গল্পকার সম্পর্কে জানতে হলে এ ধরনের বইয়ের সত্যি বিকল্প নেই।

চল্লিশের দশক থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত লিখছেন যারা; সেইসব কবি মণিশ ঘটক, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, বন্দে আলী মিয়া, আব্দুুল গণি হাজারী, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, জিয়া হায়দার, ওমর আলী, মাকিদ হায়দার, দাউদ হায়দার, জাহিদ হায়দার, মোস্তফা সতেজ, মজিদ মাহমুদ, তারেক মাহমুদ, মানিক মজুমদার, আখতারুজ্জামান আখতার, লতিফ জোয়ার্দার, আশরাফ পিন্টু, আলমগীর খান, সৈকত আরেফিনসহ আরও কবি ও ছড়াকার যাদের সম্পর্কে এ গ্রন্থে তুলে ধরা হয়েছে। তাঁদের একসাথে পাঠের এক আলাদা সুখানুভূতি আছে। কারণ সচরাচর তো এমনটা হয় না। দশজন বা বিশজন সম্পর্কে জানা যায় কিন্তু শতাধিক কবি ও ছড়াকার, গল্পকার এবং তাঁদের লেখা একসাথে পাওয়া যায় না। এর বাইরেও কবি বা ছড়াকার রয়েছে অথবা এই গ্রন্থ প্রকাশের পর অনেকেই লিখছেন। পরে এর সংস্করণে তারাও অন্তর্ভুক্ত হবেন। তখন তা হবে আরও সমৃদ্ধ। এভাবে একটি সমৃদ্ধ গবেষণাধর্মী গ্রন্থ প্রজন্মের হাতে থাকবে; যেখান থেকে তারা পাবনা জেলার কবি-সাহিত্যিকদের জানতে পারবেন।

এসইউ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।