গল্প পরিচিতি
জহির রায়হানের ‘সময়ের প্রয়োজনে’: অসামান্য সংযোজন

‘কিছুদিন আগে সংবাদ সংগ্রহের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের একটা অগ্রবর্তী ঘাঁটিতে গিয়েছিলাম। ক্যাম্প-কমান্ডার ভীষণ ব্যস্ত ছিলেন। সেই ব্যস্ততার মুহূর্তে আমার দিকে একটা খাতা এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আপনি বসুন। এই খাতাটা পড়ুন বসে বসে। আমি কয়েকটা কাজ সেরে নিই। এরপর আপনার সঙ্গে আলাপ করব।’ এভাবেই শুরু হয়েছে অমর কথাশিল্পী জহির রায়হানের ছোটগল্প ‘সময়ের প্রয়োজনে’।
বহুমুখী প্রতিভাবান জহির রায়হান রচিত ‘সময়ের প্রয়োজনে’ তরুণ মুক্তিযোদ্ধার নোটখাতার বিবরণ। যা গল্পকারে পরিবেশিত একটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্প। সেই তরুণ মুক্তিযোদ্ধার গল্প; যিনি অপারেশনে গিয়ে পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়েন। যার শেষ পরিণতি লেখক বলে যেতে পারেননি। সেই তরুণ মুক্তিযোদ্ধাকে মেরে ফেলা হয়েছিল অথবা বেঁচে গিয়েছিলেন ভাগ্যচক্রে।
গল্পটির মূল কথা হলো—আমরা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ কেন করেছিলাম? আর কেনইবা একসময় যাদের স্বাগত জানিয়েছিলাম, তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলাম ১৯৭১ সালে? অনেকেই হয়তো বলবেন, দেশের জন্য। কিন্তু দেশের সীমানা তো সব সময় এক থাকে না। হাজার বছর আগে এ দেশের সীমানা আজকের বাংলাদেশের সীমানা থেকে আলাদা ছিল। আমরা মূলত মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম সময়ের প্রয়োজনে।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর বাঙালিকে শোষণ করতে শুরু করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হওয়া সত্ত্বেও বাঙালিদের ক্ষমতার মসনদে বসতে দেয়নি তারা। উল্টো নানা টালবাহানা করেছে। ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাঙালির ওপর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। অতঃপর সময়ের প্রয়োজনেই বাঙালিদের ঝাঁপিয়ে পড়তে হয় মুক্তিযুদ্ধে। যাদের একসময় বাঙালিরা ভালোবাসতো; তাদের দেখলেই বাঙালিদের রক্ত গরম হয়ে ওঠে। তাদের দিকে পাগলের মতো গুলি ছুঁড়েছে মুক্তিযোদ্ধারা।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুক্তিযুদ্ধের একটি ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনের সুখ-দুঃখ ও আনন্দ-বেদনার গল্প নিয়েই জহির রায়হানের গল্পটি। গল্পটি একজন মুক্তিযোদ্ধার মানসিক যাত্রা নিয়ে। তিনি যুদ্ধের জন্য এক ক্যাম্পে আসেন, যেখানে যুদ্ধের ভীতিকর দৃশ্য এবং মৃতদেহের উপস্থিতি তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। প্রথমে শোক অনুভব করলেও যুদ্ধের বাস্তবতায় তা যেন স্বাভাবিক হয়ে যায়।
লেখকের ভাষায় বলতে হয়, ‘প্রথম প্রথম কাউকে মরতে দেখলে ব্যথা পেতাম। কেমন যেন একটু দুর্বল হয়ে পড়তাম। কখনও চোখের কোণে একফোঁটা অশ্রু হয়তো জন্ম নিত। এখন অনেকটা সহজ হয়ে গেছি। কী জানি, হয়তো অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে গেছে, তাই। মৃত্যুর খবর আসে। মরা মানুষ দেখি। মৃতদেহ কবরে নামাই। পরক্ষণে ভুলে যাই।’
একদিন লেখক টিলার ওপর দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবেন, কীভাবে সব কিছু পাল্টে গেছে। তিনি শত্রুকে গুলি করার চেষ্টা করেন কিন্তু মৃত্যুর অনুভূতি তাকে কাঁপিয়ে দেয়। ক্যাম্পে ফিরলে পরিবার এবং মাতৃস্নেহের কথা মনে পড়ে। যুদ্ধের ব্যথা ও শোকের মধ্যে তিনি উপলব্ধি করেন, জীবন এবং মৃত্যুর মাঝে মানবিক সম্পর্কের গুরুত্ব অপরিসীম।
যুদ্ধের অন্ধকারে যখন সবার প্রাণ রক্ষার চেষ্টা; তখন লেখকের মনে প্রশ্ন ওঠে, ‘কেন যুদ্ধ?’ তার ভেতরে যুদ্ধের উদ্দেশ্য নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। গল্পটি কেবল যুদ্ধের কাহিনি নয় বরং মানুষের সম্পর্ক, প্রেম এবং অস্তিত্বের সন্ধানে একটি গভীর চেতনা। লেখক বুঝতে পারেন, যুদ্ধের বিভীষিকা সত্ত্বেও মানুষের মধ্যে ভালোবাসা এবং সম্পর্ক কখনো ভাঙে না।
গল্পটি শেষ হয়েছে ঠিক এভাবে, ‘বিরাট আকাশ। একটা লাউয়ের মাচা, কচি লাউ ঝুলছে। কয়েকটা ধানক্ষেত। দুটো তালগাছ। দূরে আরেকটা গ্রাম। সেখানে আগুন জ্বলছে।’ ছোট্ট একটি গল্প যেন পুরো মুক্তিযুদ্ধের কাহিনি ফুটিয়ে তুলেছে। এত নিখুঁত বর্ণনা, এত গভীর বিশ্লেষণ এবং সীমাহীন ভাব উদ্রেককারী লেখা আমৃত্যু মনে থাকবে পাঠকের।
জহির রায়হানের গল্পটি বাংলা সাহিত্যের একটি অসামান্য সংযোজন হয়ে থাকবে। মুক্তিযুদ্ধের গল্প হিসেবে ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। পাঠককে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করবে।
এসইউ/জিকেএস