বই আলোচনা
মেঘনার মেয়ে: প্রেমের কবিতায় যাত্রা

খসরু পারভেজ
হাতে এলো গোলাম রববানীর কাব্যগ্রন্থ ‘মেঘনার মেয়ে’। বইয়ের শিরোনামই বলে দেয় এটি একটি প্রেমের কবিতা সংকলন। গ্রন্থের কবিতাগুলোর আলাদা কোনো শিরোনাম নেই। একশটি কবিতাই মেঘনার মেয়েকে নিয়ে লেখা। গোলাম রববানীর প্রথম কবিতার বই এটি। সাধারণত কবিরা প্রেমের কবিতা দিয়েই যাত্রা শুরু করেন। তারুণ্যের সঙ্গে প্রেম অবিভাজিত। কবির তারুণ্য আর প্রেয়সীর প্রতি প্রেমের নিবেদন ভিন্ন ভিন্ন আবহে উপস্থাপিত হয়েছে এ কাব্যে। এ ধরনের কাব্যে সাধারণত আবেগের প্রাবল্য থাকে। গোলাম রববানীর কবিতায় আবেগ আছে, তা অনেকাংশেই সংহত। প্রথম কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দেবো। তিনি লিখেছেন:
‘যদি শক্ত কথা দাও, ভানুসিংহের গল্পগুচ্ছের মতো—
শেষ হয়েও কখনো হবে না—শেষ; পাথর ফুটবে ফুল
একপলকেই টপকাবে পৃথিবীর পাঁচ পাঁচটি চূড়াশৃঙ্গ
মেঘনার মেয়ে তুমি যদি মাটি হও এই মৃত্তিকার বুকে।’
কবি তার প্রেমিকাকে মাটি হতে বলেছেন। প্রেম শুধু দেহসর্বস্ব নয়, তা দেহাতীত; একাধিক কবিতায় তার প্রমাণ মেলে। দ্বিতীয় কবিতায় তিনি লিখেছেন:
‘সে আমার চর্যাপদের মতো প্রেম-সংগীত
তিন নদীর মিলনস্থলে; প্রেমাবেশে-ই করি দিনযাপন
একটুকু সাড়া পেলে, একশো পার্সেন্ট অশ্রু নিয়ে
আমি ভেসে যাব, যাব সাত সমুদ্রের জলে
ইশারায়, বঙ্গোপসাগরের বুক টপকিয়ে।’
মেঘনার মেয়ে কবির মন চুরি করলেও, ডাকাতি করলেও কবি মেনে নিয়েছেন:
‘প্রেমের শুরু, প্রেমের শেষ
বলে কোনো কিছু নেই, যা-ই শুরু তা-ই শেষ
দিন ফেলে দিন, ঋণ চিরদিন
স্বর্গচ্যুতি—স্বর্গে ফেরা;’
(৩ নম্বর কবিতা)
কবির প্রেম যতখানি না ফ্রয়েডিও, তার চেয়ে বেশি প্লেটোনিক। কবির শ্বাসকষ্টের মহৌষধ মেঘনার মেয়েকে বলেন:
‘যদি হঠাৎই দেহঘড়ি থেকে কেটে যায় কাটা।
শুনে নামহারা কোনো লাশের কাছে
তুমি কী আসবে ছুটে?
ওগো মেঘনার মেয়ে। মৃতদেহের দিকে হেলে
ফেলবে কী তুমি—
একফোঁটা দুই ফোঁটা চোখের জলও?
ওগো মেঘনার মেয়ে। সময় থাকতে করে নাও সম্বল।’
(৫ নম্বর কবিতা)
প্রেমিকার কাছে কবির আবেদন যেন চিরায়ত প্রেমের প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে। তিনি বলেন:
‘আমাকে-ই তুমি মনের চাতকে রেখো
শুক্রবারে হৃদয়ে প্রেমের দিন।
...
চাঁদনিতে প্রজাপতির একটি পাখায়
তটিনীর তীরে বুনো হাওয়ায় হাওয়ায়।’
(৬ নম্বর কবিতা)
আরও পড়ুন
প্রেমে বিচ্ছেদ না হলে প্রেমের মর্ম যেন হৃদয়গ্রাহী হয় না। গোলাম রববানীর প্রেমের কবিতায় বিচ্ছেদ পরতে পরতে অনুরণিত। তিনি বলেন:
‘তোমার ভেতরেও কবর, আমার ভেতরেও কবর
তোমার ভেতরে তুমি, আমি আমার ভেতর,
‘জানাজানি হলো না-কেবল, কেবল নষ্টের বীজ
গোষ্ঠীর হৃদয় থেকে ফুটে, বড়ো হয় রোজ।’
(৭ নম্বর কবিতা)
অথবা
‘মেঘলা নদীর মেঘের ওপারে, মেঘের ওপরে মেঘ
মেঘের মধ্যে জানপাখি-২৩ ঝলমলে মেঘবাড়ি
হঠাৎ বৃষ্টিতেই আমি প্রেমবরিষণে ভিজছি।’
(১৬ নম্বর কবিতা)
প্রেয়সীকে কত না উপমায়, কত না অভিধায় অভিহিত করেছেন কবি। তার কাছে মেঘনার মেয়ের পরনে জালালি কবুতরের পালকের মতো ব্লাক এ হোয়াইট ড্রেস, মুঠোর মতো মুক্তির লিফলেট, বদ্ধঘরের খোলা দরজা জানালার মতো, খোলা আকাশের মতো-মাঝেমধ্যে মেঘলোক, কখনোবা সূর্যের প্রখরতা, আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টি, স্বপ্নের সুকন্যা। মেঘনার মেয়ে কবির কাছে রূপসী বাংলার মতো অপরূপ মায়া, ভোরবেলার সোনাঝরা আলো। ভালোবাসার পাণ্ডুলিপি, স্বর্গ-মর্ত্যের হাসি, মেঘদূত। মেঘনার মেয়ের কাছে কবি শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পাশে বাহরাম খান, স্বর্গীয় লাইলির মজনু, শেক্সপীয়রের নাটকের রোমিও, আনারকলির সেলিম, তাজমহলের শাজাহান।
মেঘনার মেয়ে বাস করে কবির স্বপ্নলোকে। তাকে পেয়েও পাওয়া হয় না। কবির আক্ষেপ ঝরে পড়ে কবিতায়। কখনো জেগে ওঠে প্রত্যাশা:
‘একদিন আমাকেও মনে পড়বে তোমারও ঠিক,
সেই দিন তুমি-আমি চলব, বুকে বয়ে নিয়েই
অনন্ত এক অসুখ! গ্রীষ্মের মতো ঘন তাপ ডিঙিয়ে
ফেলে আসবে ফিরফির বাতাসে শীতের গন্ধ
চলো মিষ্টি রোদে বসে আলিঙ্গন করি শীতরৌদ্র’
(৪৪ নম্বর কবিতা)
প্রেমের কবিতা হলেও গোলাম রববানীর কবিতা সমকালীনতা থেকে বিমুক্ত নয়। প্রেম তো শাশ্বত। সেই শাশ্বত প্রেমই গড়ে তোলে সুস্থির সমাজ। কবি তার প্রেমিকাকে বলেন:
‘আমাকে শোনাও তুমি দুর্বৃত্তায়ন আর অন্ধযুগের গল্প
অথচ আমি শুনতে চেয়েছিলাম
জীবনের গল্প।
...
তুমি আমাকে শোনাও কমপ্লিটলি শাটডাউন আর
কারফিউরের কথা
অবরুদ্ধ ঠিকানা অপছন্দ
যদি শোনাতে কোনো গ্রাম্য পাখি ডাকা ভোরের গল্প
কলকল করে বয়ে যাওয়া চিরচেনা নদীর স্বাপ্নিক দিন।’
(৯১ নম্বর কবিতা)
কবিতায় পরিশীলন বলে একটি কথা আছে। গোলাম রববানীর অনেক কবিতায় তার অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। কবিতার সবচেয়ে বড় গুণ তার স্বতঃস্ফূর্ততা। সেই স্বতঃস্ফূর্ততাও কোথাও কোথাও ব্যাহত হয়েছে। মনে হয়েছে গ্রন্থটিতে একশ কবিতা ছাপতেই হবে, এ জন্য জোর করে যেন লেখা হয়েছে অনেক কবিতা।
গোলাম রববানীর সামনে অনেক দীর্ঘ পথ। এই দীর্ঘ পথ তাকে পাড়ি দিতে হবে। কবিতা নিরবচ্ছিন্ন সাধনার ফসল। আশা রাখি তিনি আগামীতে শিল্পনৈপুণ্য মণ্ডিত অনেক কবিতা আমাদের উপহার দেবেন।
‘মেঘনার মেয়ে’ প্রকাশ করেছে সিলেটের বুনন প্রকাশনী। নির্ঝর নৈঃশব্দের প্রচ্ছদ আকর্ষণীয়। বইটির মূল্য ৩০০ টাকা। কাব্যগ্রন্থটি পাঠকনন্দিত হোক, এই প্রত্যাশা রইলো।
লেখক: কবি ও গবেষক।
এসইউ/এমএস