বই পর্যালোচনা
কালু মিয়ার পিএইচডি: সামাজিক ও সৃজনমুখর আখ্যান

শাদমান শরীফ
একটি ভালো বই মানে পাঠকের আরেকটি সমতল একান্ত জগৎ বিনির্মাণ। ভালো পাঠক হতে হলে ভালো মানের বই তার পছন্দের তালিকায় থাকা আবশ্যক। প্রথমে ভালো বইটি খুঁজে পেতে সমস্যা হলেও একটা সময় তাকে বলে দিতে হয় না কোন লেখকের কোন বইটি কেন তাকে পড়তে হবে। সে অবলীলায় পেয়ে যাবে কাঙ্ক্ষিত লেখকের খোঁজ। পাঠক খুঁজে বের করা লেখকের কাজ নয় বরং পাঠকই ভালো বইয়ের নির্যাসটুকু তার অবিরাম প্রচেষ্টায় বের করে নেন। যে বইটি পড়ে পাঠক দ্বিতীয়বার পড়ার ইচ্ছায় উন্মুখ হয়ে থাকেন, সেটিই সেরা বই। পাঠক নয় বরং নিজস্বতার জন্য লেখককে ঠিক করতে হবে কেমন বই তাকে লিখতে হবে। তাকে খেয়াল রাখতে হবে, বইটি যেন হয় রুচিশীল, যথার্থ মানসম্মত। তাকে ভাবতে হবে, তিনি যা লিখছেন; তা লেখার প্রয়োজন কতটুকু।
পাঠকের মধ্যে ভালো লাগা তৈরি করতে পারে এমন একটি বই ‘কালু মিয়ার পিএইচডি’। সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় দুর্দান্ত একটি গল্পগ্রন্থ গল্পকার মনিরুজ্জামান বাবলু আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন। গল্প পড়া আরম্ভ করলে বোঝা যায়, কতগুলো অসহায় মানুষ নিভৃত জীবন যাপনরত মানুষ সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদানবিধুর অসহায়-জর্জরিত হয়ে একটি মাত্র চরিত্রের মাধ্যমে জীবনের বক্ররেখায় আটকে আছে। লেখক মনিরুজ্জামান বাবলু সেই ঘটনাবহ রূপকে তার গল্পের মাধ্যমে ঢেলে সাজিয়ে শব্দে শব্দে তৈরি করেছেন কালু মিয়ার পিএইচডি নামের গল্পগ্রন্থ। পেশায় সাংবাদিক হলেও ছোটবেলা থেকেই লেখালেখি জেঁকে বসে তাঁর ওপর। যেহেতু সাংবাদিকতা করেন, সেহেতু সমাজে ঘটে যাওয়া নানা রকম সমস্যা তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে দর্পণের মতো। আর সে সমস্যাগুলোই মূলত স্থান করে নিয়েছে তার লেখা গল্পগ্রন্থ কালু মিয়ার পিএইচডিতে।
মোট ১৫টি গল্প স্থান পেয়েছে এ গ্রন্থে। ‘কালু মিয়ার শাখা প্রেম’, ‘কালু মিয়ার রেল স্টেশন’, ‘কালু মিয়ার ব্যর্থ হজ্ব’, ‘কালু মিয়ার সাজসজ্জা’, ‘রসু খাঁর বন্ধু কালু মিয়া’, ‘কালু মিয়ার পিএইচডি’, ‘কালু মিয়ার ভালোবাসা’, ‘কালু মিয়ার ধোঁকা’, ‘কালু মিয়ার বরযাত্রা’, ‘কালু মিয়ার জঙ্গি সংগঠন’, ‘কালু মিয়ার মহল্লার কিশোরী’, ‘কালু মিয়ার অবরোধ’, ‘কালু মিয়ার অতিথি বউ’, ‘কালু মিয়ার সমুদ্র জয়’ এবং ‘কালু মিয়া পাঁচ হাজার বছর পর’- এই গল্পগুলো গ্রন্থে স্থান পেয়েছে।
কালু মিয়ার পিএইচডি গল্পগ্রন্থে সমাজ বাস্তবতার প্রকৃত রূপ ফুটে ওঠে। তার গল্প সমসাময়িক ঘটে যাওয়া ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাস্তবতার গতিপথ ধরে সমসাময়িক সমাজের নানাবিধ জীবনধারাকে কাতারবদ্ধ করে। কালু মিয়ার পিএইচডি গ্রন্থটি গল্পকার মনিরুজ্জামান বাবলুর একটি পরিপূর্ণ গল্পগ্রন্থ। লেখক তার অভিজ্ঞতা এবং চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে কেন্দ্র করে গল্পের সেতু সৃষ্টি করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি হয়ে ওঠেন এক পরিযায়ী বিপ্লবী গল্পগুরু। খুব চমৎকার আলপনা করেছেন এই গ্রন্থে। সর্বগ্রাসী কলহ, ভূমি দখল, টেন্ডার, হত্যা, ধর্ষণ, হজ বাণিজ্য, শিক্ষা বাণিজ্য, এমনই অনেক ঘটনাকে উপজীব্য করে গল্পকার এই গল্পগ্রন্থটি সাজিয়েছেন। এতে তিনি পড়েছেন নানা সমস্যার সম্মুখে। তারপরও লেখা থেকে তাকে নিগৃহীত করে রাখা যায়নি।
দুঃসাহসের পরিচয় দিয়ে তিনি সৃষ্টি করেছেন সৃজনশীলতার রাজমহল। গল্পগুলো দারুণভাবে পাঠকের মনে দাগ কাটবে। জীবন বাস্তবতার এক একটি গল্প কালের সাক্ষী হয়ে থাকবে বলে আমি মনে করি। কেননা গল্পকার গল্পগুলো লিখতে গিয়ে অনেক সময় ব্যয় করেছেন। গল্পগুলো লিখতে গিয়ে অনেকটা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। সাজিয়েছেন ছোট ছোট পরিসরে। যা পাঠক একদমে শেষ করতে পারবেন। তবে কিছু কিছু গল্পে এসে দেখা গেছে লেখা শুরু করে যেন শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়েছেন। চাইলেই তিনি আরও দীর্ঘ করতে পারতেন গল্পের পরিসর। একজন পাঠক হিসেবে আমার কাছে মনে হয়েছে গল্পগুলোর চাকা আরও পথ গড়াতে পারত। তাহলে পাঠক গ্রন্থটি থেকে আরও ঋদ্ধ হতেন। সর্বোপরি, গল্পকার পাঠককে ঠকিয়েছেন বলে আমার মনে হয়নি।
কালু মিয়ার পিএইচডি গল্পগ্রন্থের একটি গল্প রসু খাঁর বন্ধু কালু মিয়া। গল্পটি আমাকে চরমভাবে নাড়া দিয়েছে। গল্পটি পড়ে আমি অবাক হলাম, মানুষের চরিত্রের আড়ালে অমানুষ কীভাবে বসবাস করে। এই গল্পগ্রন্থটি না পড়লে বুঝতাম না। কালু মিয়া চরিত্রটি নির্মাণে লেখক যে শিল্পবোধের পরিচয় দিয়েছেন, তা আদতে তার শিল্পসত্তার পরিচায়ক। গল্পগুলো পাঠে যে কোনো পাঠক বুঝতে পারবেন গল্পকার কতটা সাহসিকতার স্বাক্ষর রেখেছেন এর ভেতর। তিনি যে বিত্তশালীদের বিরুদ্ধে কলম চালিয়েছেন এবং কতটা দুঃসাহস দেখিয়েছেন, কীভাবে প্রতিবাদ করতে হয় তা আমাদের শেখালেন গল্পের মধ্য দিয়ে। কালু মিয়া কিংবা রসু খাঁর মতো মানুষরা আমাদের সমাজে মাথা উঁচু করে দিনের পর দিন দাপিয়ে বেড়ায় এবং অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থেকে সমাজকে পরিচালনা করে তা গল্পকার মনিরুজ্জামান বাবলু গল্প আকারে মানুষের চোখের সামনে তুলে এনেছেন।
আমি হলফ করে বলতে পারি, যে কোনো পাঠক গল্পগুলো পাঠান্তে ভাবনার খোরাক পাবেন। কেননা গল্পগুলো কারো না কারো জীবনের ক্যানভাসের তুলির আঁচড়। এই গল্পের রসু খাঁ একজন লেডি কিলার। নারীর সাথে প্রেমের অভিনয় করে তাকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে তার শরীর ভোগ করে। অতঃপর হত্যা করে। আর তারই বন্ধু কালু মিয়ার বুদ্ধিমত্তা চৌকস। সে তার প্রতিষ্ঠানের গরিব মেধাবী ছাত্রীদের ছাত্রী হোস্টেলে না থাকার পরামর্শ দিয়ে সুলভ খরচে তার বিলাসবহুল অট্টালিকায় থাকার সুযোগ করে দেয়। গরিব ছাত্রীরা কালু মিয়ার এ সুযোগ সন্ধানী অফার পেয়ে সহজে রাজি হয়ে যায়। তেমনই একটি চরিত্র লেখক এমনভাবে তুলে ধরেছেন। এ গল্পের নন্দিতার গ্রামের বাড়ি শহর থেকে অনেক দূরে হওয়ায় কালু মিয়া তার থাকার ব্যবস্থা করে তার বিলাসবহুল বাড়িতে। নন্দিতা কয়েকজন বান্ধবীকে নিয়ে একদিন ওঠে কালু মিয়ার বাড়িতে আর সে সুযোগে কালু মিয়া আঁকতে থাকে তার কুমতলবের ছক। এভাবেই এগিয়ে যেতে থাকে গল্প।
বইটির নামকরণও অভূতপূর্ব হয়েছে। একটি চরিত্রের মাধ্যমে পনেরোটি গল্পের পরম্পরাযুক্ত গল্পগ্রন্থ ব্যতিক্রমত্বের দাবি রাখে। বোধ ও শিল্পগুণের কারণে বইটি পাঠকের কাছে গৃহীত হবে বলেই আমার ধারণা। আমি সুদীর্ঘকাল বইটির পাঠকপ্রিয়তা কামনা করছি। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন সিকদার আবুল বাশার। বইটির প্রকাশক গতিধারা প্রকাশনী। মূল্য রাখা হয়েছে ১৫০ টাকা।
এসইউ/এএসএম