আল মাহমুদের সোনালি কাবিন: সৃষ্টিতে বিস্ময়

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ সালাহ উদ্দিন মাহমুদ , লেখক ও সাংবাদিক
প্রকাশিত: ০৬:৫২ পিএম, ২৯ আগস্ট ২০২৪

পঞ্চাশের দশকের অন্যতম অনন্য সাধারণ কবি আল মাহমুদ (১১ জুলাই ১৯৩৬-১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯)। তিনি চলে গেছেন বসন্ত-ভালোবাসার আবেশ গায়ে মেখে। তিনি আসবেন না কখনো সৌম্য দৃষ্টি নিয়ে। লোকান্তরের পথে তাঁর অবিরাম যাত্রা এখন। যে যায়-সে যায়, তবে তাঁর সৃষ্টিকর্ম তো রয়ে যায়। কর্মই তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছে পাঠকের মাঝে। খড়ের গম্বুজের আড়ালে হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে তাঁকে।

বলতে দ্বিধা নেই, আল মাহমুদ বাংলা সাহিত্যে কালজয়ী অধ্যায় সৃষ্টি করেছেন। তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। কবি আল মাহমুদকে যতই পড়বেন; মনে ততই বিস্ময় জাগবে। তাঁর উপন্যাস, গল্প, কবিতা ও আত্মজীবনীতে এক অপার বিস্ময় খেলা করে। সব আলোচনা বাদ দিয়েও যদি একটি গ্রন্থ আলোচনা করা হয়; তা-ই যথেষ্ট তাঁর জন্য। সেটি তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘সোনালি কাবিন’।

কবি আল মাহমুদের বিখ্যাত ও বহুলপঠিত কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে ‘সোনালি কাবিন’। গল্প ও উপন্যাসে সফলতা পেলেও কবিতাই তাঁকে পরিচিতি এনে দিয়েছে। সোনালি কাবিন আল মাহামুদের সনেট জাতীয় কাব্য, যা ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয়। আল মাহমুদ যেসব সাহিত্য রচনা করেছেন, তার মধ্যে সোনালি কাবিন তাঁকে বেশি পরিচিতি দিয়েছে। এতে মোট ১৪টি সনেট এবং ৪১টি কবিতা আছে।

তাঁর সব সাহিত্যকর্ম বাদ দিলেও শুধু সোনালি কাবিনের জন্যই অমর হয়ে থাকবেন। সোনালি কাবিন তাঁর অমরত্বের সাক্ষী হয়ে থাকবে। যুগ যুগ ধরে সনেটের স্বাদ, কবিতার আস্বাদন গ্রহণ করবে পাঠক। সাহিত্যবোদ্ধারাও কবিতা প্রসঙ্গ এলে প্রথমেই মুখে আনবেন সোনালি কাবিনের নাম। তিনি আধুনিক বাংলা কবিতাকে নতুন আঙ্গিক, চেতনা ও বাকভঙ্গিতে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। একজন নগণ্য পাঠক হিসেবে আমার এমনটিই মনে হয়। সে যা-ই হোক, সোনালি কাবিন সম্পর্কে কবি আল মাহমুদ বলেছেন, ‘একদা প্রেমের কবিতা লেখার ইচ্ছাতেই আমি ‘সোনালি কাবিন’-এর সনেটগুলো লিখে ফেলি’। শুধু কি প্রেম? তাঁর সনেটে প্রেমের পাশাপাশি উঠে এসেছে বিরহ, বিপ্লব, দ্রোহ এবং মানবতাবাদ। শব্দে উঠে এসেছে মুসলিম ঐতিহ্য, হিন্দু পুরাণ, খ্রিষ্টীয় আচার-অনুষ্ঠান।

‘সোনালি কাবিন’ প্রকাশের ৫০ বছর পূর্তি হয়েছে। এই ৫০ বছরেও বইটি সমানভাবে সমাদৃত হয়েছে। খবরটি একজন কবির জন্য সবচেয়ে বড় পাওয়া। কবি বলেছেন, ‘সনেটগুলো যখন লিখি, তখন প্রবল এক ঘোরের মধ্যে ছিলাম’। কবি সনেটগুলো লেখার সময় যেমন ঘোরের মধ্যে ছিলেন; তেমন পাঠকও সনেটগুলো পাঠ করার সময় ঘোরের মধ্যে পড়ে যান। এমনকি পাঠ শেষেও ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারেন না। কেমন মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে সোনালি কাবিনের গুণগান।

সোনলি কাবিনের সনেটগুলো পাঠককে সত্যি বিমোহিত করে। এর শব্দচয়ন, বাক্যগঠন, পর্ববিন্যাস সত্যিই মনে রাখার মতো। তাই তো প্রথম সনেটেই তিনি লিখলেন, ‘সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়ো না হরিণী
যদি নাও, দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দু’টি।’ তাঁর কাবিনবিহীন হাত দুটি যেন সোনায় সোনায় ভরে উঠলো। প্রথম সনেট জন্মের উত্তেজনায় তিনি লিখে ফেললেন আরও ছয়টি সনেট। যে উত্তেজনা পরে সংক্রমিত হয়েছে পাঠকের অন্তরেও। কবি যখন বলেন,
‘তুমি যদি খাও তবে আমাকেও দিও সেই ফল
জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে পরস্পর হবো চিরচেনা
পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয় না কবিরা;
দারুণ আহত বটে আর্ত আজ শিরা-উপশিরা।’
কবি মূলত প্রথমেই এক টানে সাতটি সনেট লিখে ফেলেছিলেন। এরপর লিখেছেন আরও সাতটি। ফলে প্রথমত মোট ১৪টি কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয় সোনালি কাবিনে। কিন্তু আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে, পরে তিনি অনেক চেষ্টা করেও এই ১৪টির বেশি সনেট লিখতে পারেননি। তখন কবির কাছে মনে হয়েছিল, এটি হয়তো কোনো দৈব ব্যাপার হতে পারে।

কবিতার কথাগুলো দৈববাণী না হলেও কবি হয়তো দৈবক্রমেই পেয়েছিলেন। যা তাঁকে বাংলা সাহিত্যে অমর করে রাখবে। শুধু পঞ্চাশ বছর নয়; সোনালি কাবিন পঠিত হবে অনন্তকাল। কেননা সোনালি কাবিন লেখার জন্য তিনি সনেট নিয়ে অনেক পড়াশোনা করেছেন। সনেটের নিয়ম অনুসারে প্রথমে আট, পরে ছয় লাইনের এই ফর্মের প্রথম রূপ দিয়েছিলেন পেত্রার্ক। কিটসও লিখেছেন একই ধারায়। বাংলা ভাষায় অনেকে লিখেছেন। মাইকেল মধুসূদন দত্তের সনেটও চৌদ্দ মাত্রার। এর অনেক পরে কবি আল মাহমুদ লিখলেন ‘সোনালি কাবিন’। প্রথমে মাত্র ১৪টি সনেট নিয়ে কলকাতায় পকেট সাইজের সোনালি কাবিন প্রকাশ হয়। পরে সোনালি কাবিনের চৌদ্দটি সনেট ছাড়াও মোট একচল্লিশটি কবিতা নিয়ে ‘সোনালি কাবিন’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এরমধ্যে একটি কবিতা ‘সোনালি কাবিন’ এবং এই কাব্য শিরোনামে বইটির নামকরণ করা হয়।

আরও পড়ুন

তাঁর কবিতায় নদী-সন্ত্রস্ত পীড়িত গ্রাম্য জীবনের বাকপ্রতিমা উজ্জ্বল হয়ে ফুটে ওঠে। কয়েকটি পঙক্তি পাঠে আমরা তা উপলব্ধি করতে পারবো:
১. নদীর চরের প্রতি জলে-খাওয়া ডাঙার কিষাণ
২. ফাটানো বিদ্যুতে আজ দেখো চেয়ে কাঁপছে ঈশান
৩. ঝড়ের কসম খেয়ে বলো নারী, বলো তুমি কার?
৪. গাঙের ঢেউয়ের মতো বলো কন্যা কবুল, কবুল
৫. লাঙল জোয়াল কাস্তে বায়ু ভরা পালের দোহাই
৬. বর্গীরা লুটেছে ধান নিম খুনে ভরে জনপদ
তোমার চেয়েও বড় হে শ্যামাঙ্গী, শস্যের বিপদ।
৭. রাতের নদীতে ভাসা পানিউড়ী পাখির ছতরে
শিষ্ট ঢেউয়ের পাল যে কিসিমে ভাঙে ছলছল
৮. ক্ষুধার্ত নদীর মতো তীব্র দুটি জলের আওয়াজ—
তুলে মিশে যাই চলো অকর্ষিত উপত্যকায়
৯. নদী সিকস্তী কোনো গ্রামাঞ্চলে মধ্যরাতে কেউ
যেমন শুনতে পেলে অকস্মাৎ জলের জোয়ার
১০. মঙ্গল কুলোয় ধান্য ধরে আছে সারা গ্রামবাসী
উঠোনে বিন্নীর খই, বিছানায় আতর, অগুরু।
১১. বৃষ্টির দোহাই বিবি, তিলবর্ণ ধানের দোহাই
দোহাই মাছ মাংস দুগ্ধবতী হালাল পশুর
সোনালি কাবিন কি কেবলই নদী আর গ্রাম্য জীবনের বিবরণ? এর গভীরে খেলা করছে ইতিহাসের চেতনা। শুধু প্রেম নয়; ফুটে উঠেছে বিপ্লবও।

তাই তো খোন্দকার আশরাফ হোসেন তাঁর ‘আল মাহমুদের সোনালি কাবিন’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘পল্লীজীবনের পশ্চাৎপট ‘সোনালি কাবিন’-এর ঔজ্জ্বল্যের নিদান হলেও আল মাহমুদ লৌকিক সারল্যকে পরিহার করেছেন সযত্নে, অন্যথায় বিপদ ছিল তার জসীম উদ্দীন হবার। এর কারণও স্পষ্ট: মাহমুদের প্রতিপাদ্য গ্রামজীবন নয়, তার প্রতিপাদ্য ইতিহাসচেতনার আলোকে সম্ভাব্য বিপ্লবের আশাবাদ। শোষণহীন, ‘সম্পদের সুষম বণ্টন’ সমন্বিত সমাজের স্বপ্ন এই কবিতার নাভিকেন্দ্রে; প্রেমিকাকে নিবেদন শুধু বাগভঙ্গির একটি চমকদার খোলস। মুনশিয়ানার সাথে এই প্রতারণা করতে চেয়েছেন আল মাহমুদ এবং সফল হয়েছেন। ‘সোনালি কাবিন’ মূখ্যত প্রেমের কবিতা নয় বলেই কবি নায়ককে ইতিহাস ও সমকালের পাঁচালিকারও হতে হয়েছে, সাতকাহন গাইতে হয়েছে গৌরবদীপ্ত এক জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক পতন ও বঞ্চনার।’

সোনালি কাবিনের সনেট প্রসঙ্গে কবি বলেছেন, ‘লেখার পরই মনে হয়েছিল, সনেটগুলো বাংলা সাহিত্যে আমাকে অমরতা এনে দেবে। আজ দেখি, আমার ধারণা বেঠিক নয়, আশ্চর্যজনকভাবে সফল হয়েছে সনেটগুলো!’ কবির ধারণাই সত্যি হয়েছে। ঈর্ষাতীতভাবে সফল হয়েছে তাঁর সৃষ্টিকর্ম। যদিও কেউ কেউ ঈর্ষান্বিত হয়ে থাকবেন; কিন্তু আল মাহমুদের ‘সোনালি কাবিন’র মতো সনেট আগামী কয়েক যুগেও সৃষ্টি হবে না। হলেও তা এখনই কেউ বলে দিতে পারবেন না। কারণ সে সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। কারণ যারা কবিতায় ছন্দকে অবহেলা করেন; তারা তো কোনোভাবেই পারবেন বলে মনে হয় না। একটু খেয়াল করে দেখবেন, সোনালি কাবিনের কোথাও এতটুকু ছন্দপতন নেই। মাত্রার বাড়াবাড়ি নেই। কী এক মধুর তালে দামি অলঙ্কারে সাজিয়েছেন তিনি কবিতার শরীর।

সোনালি কাবিনে তিনি খুব সাহসের সঙ্গে ‘কাবিন’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তাঁর আগে বাংলা কবিতায় শব্দটির ব্যবহার তেমনভাবে কেউ করেননি। যে শব্দটি মুসলিম বিবাহের সঙ্গে অর্থাৎ ধর্মীয় আচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ফলে সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু একইসঙ্গে তিনি নর-নারীর চিরায়ত সম্পর্ক, সমাজতান্ত্রিক সাম্যব্যবস্থা, স্বজাত্যবোধের কথাও বলেছেন। তাঁর ভাষার গভীরতা মাটি মাতৃকাকেন্দ্র পর্যন্ত প্রথিত। তাঁর কবিতায় ফুটে ওঠে চিরায়ত জীবনের রূপ। কবি বলেন,
‘বৃষ্টির দোহাই বিবি, তিলবর্ণ ধানের দোহাই
দোহাই মাছ-মাংস দুগ্ধবতী হালাল পশুর,
লাঙল জোয়াল কাস্তে বায়ুভরা পালের দোহাই
হৃদয়ের ধর্ম নিয়ে কোনো কবি করে না কসুর।’ (সোনালি কাবিন-১৪)

ফলে নাসিমা হক মুক্তা তার ‘সোনালি কাবিন এক মহাকাব্যিক ইশতিহার’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘কবি আল মাহমুদ ভাবের কবি। তার গভীরতর ভাবনা ও তীক্ষ্মতা বর্ণনা করার সাহস যিনি করবেন তিনি নিজেই চমকে উঠবেন এবং দারুণ এক আধ্যাত্মিক জাদুর ঘোরে লেখার স্রোত অন্য দিকে ধাবিত হবে। একটি মানব ভ্রূণ যখন সদ্য জন্মের পর পৃথিবীর বাতাস গায়ে মেখে ওঁয়া ওঁয়া শব্দে কেঁদে ওঠে পিতাকে হাত পা গুটিয়ে দেয় তখন অসহায়ত্বের ভারে নুয়ে পড়ে পুরোনো মাটিতে। জাতিস্বর কবিতা পাঠ করলে বোঝা যাবে কতটুকু মহার্ঘ্য চিত্রকল্পতে নারীগর্ভে মানবজন্মের এক্স ও ওয়াই-এর সঞ্চারণ-ক্রিয়াকে বিচিত্র মননশীলতা দেখিয়েছেন।’

সুতরাং বলা যেতেই পারে, কবি আল মাহমুদের অন্য সাহিত্যকর্ম ছাড়াও সোনলি কাবিনের বিশিষ্টতা তাকে বাংলা সাহিত্যে চির জাগরুক করে রেখেছে এবং রাখবে। কেননা জীবন সায়াহ্নে এসেও তিনি রচনা করে গেছেন তাঁর কাব্য অলঙ্কার। তাঁর কাব্যসুধা পান করে তৃপ্ত হচ্ছেন পাঠককূল। দিগ্বিদিক ছড়িয়ে পড়ছে বাংলা কবিতা। সনেটদিগন্তে উচ্চারিত হচ্ছে আল মাহমুদের নাম। পূজিত হচ্ছে সোনালি কাবিন।

এসইউ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।