কেমন ছিলো জল্লাদ জীবন: অনেক না-বলা কথা
পয়ত্রিশটি হত্যা মামলা এবং একটি অস্ত্র মামলায় জল্লাদ শাহজাহান ভূঁইয়ার একশ চুরাশি বছর সাজা হয়। তিনি প্রায় ছয় শতাধিক ডাকাতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তবে উচ্চ আদালতের বিশেষ বিবেচনায় তিনি বিয়াল্লিশ বছর সশ্রম কারাদণ্ড পান। এ সময় তিনি জল্লাদ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একসময় দেশজুড়ে আলোচিত হন। কারাগার থেকেও মুক্তি পান।
কারাগার থেকে মুক্তির পর তিনি জীবন কাহিনি প্রকাশের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেন। এ খবর পেয়ে এগিয়ে আসে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান কিংবদন্তী পাবলিকেশন। এই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার অঞ্জন হাসান পবন তার বই প্রকাশের দায়িত্ব নেন। ফলে ‘কেমন ছিলো জল্লাদ জীবন’ শিরোনামে বইটি প্রকাশিত হয় ২০২৪ সালের অমর একুশে বইমেলায়।
বইটিতে তিনি বাস্তব জীবনের বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরেছেন। বলতে চেয়েছেন অনেক না-বলা কথা। ঘটনাগুলোর বেশিরভাগই অনেক আগের। জীবনের গল্পে তিনি বেশকিছু নামও উল্লেখ করেছেন। বেশকিছু দিন-তারিখ উল্লেখ করেছেন। তার লেখা ঘটনা প্রবাহে কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশ অফিসারের নাম এসেছে। যদিও তাদের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না।
জল্লাদ শাহজাহান ভূঁইয়ার বলা ঘটনাগুলোকে অতীতের গল্প বলেই বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছেন বইয়ের ভূমিকায়। বইটি প্রকাশের তিন মাস পরই গত ২৪ জুন তিনি মারা যান। জীবন থেকে চিরতরে মুক্তি লাভ করেন। তার লেখা বইতে আমাদের জন্য রেখে যান কিছু শিক্ষণীয় বিষয়। বইটি পড়ে পাঠক অবশ্যই উপকৃত হবেন বলে আমার বিশ্বাস।
বইটির সূচিক্রমে যদি চোখ রাখা যায়, তাহলে দেখবেন—‘আমার শৈশব’, ‘মুক্তিযুদ্ধ’, ‘সেনাজীবন’, ‘প্রথম জেলজীবন’, ‘প্রথম জেলের পরবর্তী জীবন’, ‘ফাঁসির নিয়ম ও ফিরোজ পাগলা’, ‘এরশাদ শিকদারের ফাঁসি’, ‘বাংলা ভাইয়ের ফাঁসি’, ‘বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের ফাঁসি’, ‘যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি’, ‘জীবনের ইতিবৃত্ত ও অনুশোচনা’।
‘আমার শৈশব’ অংশে তিনি লিখেছেন, ‘১৯৫৮ সালের পহেলা জানুয়ারি মধ্যরাতে আমার জন্ম হয়েছিল তৎকালীন নারায়ণগঞ্জ সাব ডিভিশনের কালীগঞ্জ থানায়। গ্রামের নাম ইছাখালী। বাবা মো. হাছেন আলী ভূঁইয়া এবং মা সবমেহের বেগমের আমি ছিলাম চতুর্থ সন্তান।’ বইটি তিনি তার মা সবমেহের বেগমকে উৎসর্গ করেছেন।
সহজ-সরল সাবলীল ভাষায় তিনি ঘটনা বর্ণনা করে গেছেন। মারপ্যাঁচহীন ভাবে জীবনের গল্প বলে গেছেন। জেলখানার খাবার সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘মোটা আটার রুটিতে বড়ো বড়ো পোকা খুঁজে পাওয়া ছিল নিত্যদিনের ঘটনা।’ এমনই অনেক অভিজ্ঞতা ফুটে উঠেছে তার লেখায়।
জল্লাদ হওয়ার বাসনা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘আমদানী ওয়ার্ডের পাশে একটা জায়গায় রশিদ নামের এক লোক থাকে। জেলখানার কয়েদিরা তার সেবাযত্ন করে, খাবার এনে দেয়। এটা দেখে আমার বেশ কৌতূহল জাগল। জানতে চাইলাম কে ইনি? একজন বলল, উনি এখানকার প্রধান জল্লাদ।’
জল্লাদ হিসেবে অপরাধীদের ফাঁসি দেওয়া এবং সাজা মওকুফের বিষয়ে তিনি লিখেছেন, ‘জেলখানার নিয়ম অনুযায়ী প্রতি ফাঁসির পর আমি দুই মাসের রেয়াত (সাজা মওকুফ) পাবো। কিন্তু দশ বছরের বেশি সাজা মওকুফ সাধারণত করা হয় না। যার কারণে আমার নামে মোট ছাব্বিশটি ফাঁসি দেখানো হয়েছে। তবে এটাও বাংলাদেশে একজন জল্লাদের জন্য সর্বোচ্চসংখ্যক ফাঁসি।’
এমনই নানা বর্ণিল বিষয় উঠে এসেছে তার লেখায়। অনেক ঐতিহাসিক ফাঁসি কার্যকর হয়েছে তার হাত দিয়ে। ফলে ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। শাহজাহান ভূঁইয়া কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন ২০২৩ সালের ১৮ জুন। মুক্তির এক বছরের মাথায় জীবন থেকেই মুক্তি পেয়ে যান তিনি। ২০২৪ সালের ২৪ জুন মারা যান আলোচিত এই জল্লাদ।
বইটির শেষদিকে এসে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন। সেনা বাহিনীর চাকরি ছেড়ে দেওয়া, ডাকাতি করা এবং নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়াসহ বাবা-মায়ের কথা না শোনার জন্য আফসোস করেছেন। বইটির বিক্রয় মূল্য ৩০০ টাকা। প্রচ্ছদ করেছেন সাদিতউজজামান। আশা করি বইটি পাঠ-তৃষ্ণা নিবারণে সাহায্য করবে। আমি বইটির বহুল পাঠ ও প্রচার কামনা করছি।
এসইউ/জেআইএম