তপন বাগচীর সাক্ষাৎকারসংগ্রহ: সাহিত্যের আয়না
সাক্ষাৎকার আসলে লেখকের আয়না। সমকালীন সাহিত্যের আয়না। এই আয়নায় পাঠক সমকালকে দেখতে পান। ব্যক্তির জীবন-দর্শন ফুটে ওঠে তাতে। তেমনই একটি সংকলন হাতে পেয়েছি সম্প্রতি। অমর একুশে বইমেলা ২০২৪ এ প্রকাশিত হয়েছে ড. তপন বাগচীর সাক্ষাৎকারসংগ্রহ। বিভিন্ন সময়ে নেওয়া তার সাক্ষাৎকার সংকলিত হয়েছে বইটিতে। এতে মোট ৩৮টি সাক্ষাৎকার লিপিবদ্ধ হয়েছে। দেশের সুপরিচিত জাতীয় দৈনিক, ওয়েবম্যাগ, লিটলম্যাগ ও অনলাইন পোর্টালে বিভিন্ন সময়ে এগুলো প্রকাশিত হয়েছিল।
ড. তপন বাগচী একাধারে একজন কবি, গল্পকার, ছড়াকার, প্রাবন্ধিক, গবেষক, লোকসংস্কৃতিবিদ, গীতিকার ও শিশুসাহিত্যিক। পেশাগত জীবনে তিনি বাংলা একাডেমির ফোকলোর, জাদুঘর ও মহাফেজখানা বিভাগের পরিচালক। পিএইচডি করেছেন বাংলাদেশের যাত্রাগানের ওপর। কিছুকাল সাংবাদিকতার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। ২০২৩ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার। এর আগেও তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার লাভ করেছেন। সাহিত্যচর্চার ফাঁকে ফাঁকে তিনি বিভিন্ন মাধ্যমে কথা বলেছেন। এসব সাক্ষাৎকারে তিনি সাহিত্যের নানাবিধ বিষয়ে কথা বলেছেন। শিশুসাহিত্য, কবিতা, লোকসংস্কৃতি, গান, ছন্দ, যাত্রাপালা, ছোটগল্প, পত্রিকার সাহিত্যপাতা, বইমেলা, প্রকাশনা, পুরস্কারসহ নানা অনুষঙ্গে সাক্ষাৎকারগুলো প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে।
একপলকে সূচিপত্র দেখলেই বইটি সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পাওয়া সম্ভব। যেমন- কেতকীর কাছে আমার ঋণ জন্মান্তরেও শোধ হবে না (পৃ-১১), শিশুদের জন্য লিখতে গেলে মন পবিত্র রাখতে হয় (পৃ-১৭), আবার মানুষ গ্রামায়ণের দিকে ঝুঁকবে (পৃ-২১), শত্রুর কাছে আমার দারুণ ঋণ আছে (পৃ-২৮), হুমায়ুন আজাদের কবিতা থাকবে আলোকবর্তিকা হয়ে (পৃ-৩১), ‘অশ্লীল নৃত্য’ বন্ধ করলেই যাত্রা সকলের উপযোগী হবে (পৃ-৪৬), গল্পে তো গল্প থাকতেই হবে (পৃ-৫৪), সরদার ফজলুল করিম ছিলেন মানবহিতৈষী দার্শনিক (পৃ-৫৯), ছড়ায় সরাসরি কথা বলা যায় (পৃ-৬৬), ছন্দ না জেনেও কবিতা লিখে অনেকে নাম কামিয়েছেন (পৃ-৬৯), বেশিরভাগ ওয়েবম্যাগই সুসম্পাদিত নয় (পৃ-৭২), খারাপ লেখক বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না (পৃ-৭৫), নিত্যদিনের জীবনযাপনের মতোই কবিতা আসে (পৃ-৮০), পাঠক ভালো থাকলে লেখক ভালো থাকেন (পৃ-৮৪), দেশপ্রেম একটি সহজাত প্রবণতা (পৃ-৯৩), সাহিত্যের কাজ দৈনিকের সাহিত্যপৃষ্ঠা ঘিরেই আবর্তিত (পৃ-১২৪), ফোকলোরের পঠনপদ্ধতির আধুনিকায়ন জরুরি (পৃ-১২৯), আমি সাহিত্যের সাধক মাত্র (পৃ-১৩৩), বাংলাদেশের সাহিত্য নিজের পথেই আছে স্বয়ম্ভু হয়ে (পৃ-১৪১), কবিতায় সমকালীন ভাষাকেও চিরকালীন রূপ দেয়ার চেষ্টা (পৃ-১৪৮), গান লেখা আমার লোকসংস্কৃতিচর্চার সম্প্রসারিত কাজ (পৃ-১৫১), বুদ্ধদেব বসু বাংলা সাহিত্যের এক শ্রেষ্ঠ পুরুষ (পৃ-১৬১), ‘মোয়াজ্জিন’ কবিতাই আমাদের রণসংগীত (পৃ-১৬৬), ছড়া ও গানকে আমি কবিতাচর্চারই অঙ্গ বিবেচনা করি (পৃ-১৭৫), আমার সাধনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে কবিতা (পৃ-১৮৬), গীতিকাব্য পদকে আমি তীব্রভাবে উৎসাহিত (পৃ-১৯৬), এখনকার জীবন নিয়েই আমি সুখী (পৃ-১৯৮), আমাদের প্রকাশনা বইমেলাকেন্দ্রিক (পৃ-২০১), বইয়ের আবেদন কখনো কমবে না (পৃ-২০৩), সংগীতের সুর হারিয়ে যায় না (পৃ-২০৭), পাগলদের মতো সহজ মানুষ হওয়া খুব সহজ নয় (পৃ-২০৯) ছন্দে ছন্দে মনানন্দে (পৃ-২১২), ভালবেসেই হলাম ছড়াব্রতী (পৃ-২২৫), আমি তো ভাই পাঠক নামেই গণ্য (পৃ-২২৯), ক্ল্যাসিক জানলে আধুনিক গানও গাইতে পারে (পৃ-২৪০), লোকসাহিত্য লোকমানসে রচিত হয় (পৃ-২৪৬), বৈষয়িক পুরস্কার লাভের জন্য কখনো লিখিনি (পৃ-২৪৯) এবং নিন্দুকেরা শক্তিশালী হলেও পরাজিতের বংশধর (পৃ-২৫১)।
সাক্ষাৎকারগুলো গ্রহণ করেছেন প্রথিতযশা কবি, লেখক ও সম্পাদকরা। তারা হলেন- তরুণ মুখোপাধ্যায়, শ্যামাপ্রসাদ ঘোষ, সুশীল সাহা, সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, মোহাম্মদ আলী, এমএ মজিদ, কুলদা রায়, সমীর কুমার বিশ্বাস, মিল্টন বিশ্বাস, মিলন সব্যসাচী, মোহাম্মদ নূরুল হক, মনসুর আজিজ, আহমেদ ফিরোজ, হামিম কামাল, দুপুর মিত্র, মাসুম খান, নীলাদ্রিশেখর সরকার, গোবিন্দ ধর, অরবিন্দ চক্রবর্তী, বঙ্গ রাখাল, সাদিয়া শিমুল, মনোয়ার হোসেন, রনি রেজা, সাবরিনা আফরিন সিলভী, ডেইলি স্টার প্রতিনিধি, মারুফ কিবরিয়া, এইচএম মেহেদী হাসান, রাহাত হোসেন, লিঠু মণ্ডল, দোলা বসু, জ্যোতির্ময় সেন, রমজান মাহমুদ, কামাল হোসেন ও জুলফিকার শাহাদাত (সম্পূরক তিনটি প্রশ্ন), অনুরূপ আইচ ও সৈয়দ নূর-ই-আলম, স্বরলিপি, সালাহ উদ্দিন মাহমুদ এবং মেহেদী হাসান শোয়েব।
আরও পড়ুন
তিনি বাংলা সাহিত্যের বর্ণিল এক অধ্যায়। তিনি যতদিন আমাদের মাঝে থাকবেন; ততদিন আমরা আরও বেশি বেশি সাহিত্যরসদ সংগ্রহ করতে পারব। পুরোটা সময়জুড়ে সাহিত্যচর্চায় নিমজ্জিত মানুষটি যেন জীবন্ত অভিধান। নব্বই দশকের শীর্ষস্থানীয় সাহিত্যসাধক তিনি। তার জন্ম ১৯৬৮ সালের ২৩ অক্টোবর মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার কদমবাড়ি গ্রামে। তিনি সাহিত্যচর্চা করে চলেছেন বিরামহীন। এক প্রশ্নের জবাবে তপন বাগচী বলেছেন, ‘কেবল সাহিত্য নয়, প্রতিটি গবেষণাতেই তত্ত্বের প্রয়োগ রয়েছে। আবার সকল গবেষণাই তাত্ত্বিক নয়। প্রায়োগিক গবেষণাও রয়েছে। প্রায়োগিক গবেষণা জাতীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে।’ (লোকসাহিত্য লোকমানসে রচিত হয়, পৃ-২৪৬)
বইয়ের মান নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে তপন বাগচী বলেছেন, ‘প্রযুক্তি সহজ হয়ে যাওয়ার কারণে অনেক সময় লেখকরাই কম্পোজ করে প্রুফ দেখে প্রকাশকের কাছে দেন। আর প্রকাশকও তা হুবহু ছাপিয়ে দেন। দেখা যায় ছাপার পর প্রচুর ভুলত্রুটি থেকে যায়। এতে করে পেশাদারিত্ব থাকে না। একজন লেখক, যে সব সময় বানান বিষয়ে মনোযোগী হবেন, তা নাও হতে পারে; এটা দোষেরও কিছু নয়। লেখক কিংবা প্রকাশক, যাকেই দায়ী করি না কেন শেষমেশ মার খাচ্ছে কিন্তু পাঠকরা। তারা একটি অশুদ্ধ বই পাচ্ছে।’ (আমাদের প্রকাশনা বইমেলাকেন্দ্রিক, পৃ-২০১)
তপন বাগচী যেসব বিষয়ে কথা বলেছেন, আমি আশা করি লেখক, গবেষক ও শিক্ষার্থীদের জ্ঞান আহরণে তা কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। তার নিরলস সাহিত্যচর্চা অন্যজনকে উৎসাহিত করবে। অনুপ্রেরণা জোগাবে। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত বইটি শোভা প্রকাশের একটি সুচিন্তার ফসল। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথামালা মলাটবন্দি করে প্রকাশক পাঠকের কৃতজ্ঞতা আদায়ে সক্ষম হয়েছেন। নাজিব তারেকের প্রচ্ছদে বইটির মূল্য রাখা হয়েছে ৫০০ টাকা। বিভিন্ন অনলাইন বুকশপসহ বইয়ের দোকানে বইটি পাওয়া যাচ্ছে। আগ্রহীরা সংগ্রহ করতে পারেন। আমি বইটির বহুল পাঠ ও প্রচার কামনা করছি।
এসইউ/জিকেএস