তাঁরকাটার ভাঁজে: এক বীরাঙ্গনার কাহিনি

জাগো নিউজ ডেস্ক
জাগো নিউজ ডেস্ক জাগো নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ০২:৫৫ পিএম, ২৭ মার্চ ২০২৪

মাহমুদ নোমান

ড. মুকিদ চৌধুরীর ভাষার মধ্যে যে চোরা তৃপ্তি বিষাদ চূড়ায় মেঘের ঠোঁট ছুঁয়ে বৃষ্টি এনে দেবে। মুহূর্তে বাহিত করতে পারে ভেতর বাহিরে; ভাষার মধ্যে আত্মিক উপলব্ধি গাম্ভীর্যে উপস্থিত। আপনাকে মন্ত্রমুগ্ধে নিয়ে যাবে সম্পর্কের সবটুকু আড়ালে; ভাষার মধ্যে যে- ঠেঁস, সেটাতে লতিয়ে উঠে হাস্যোজ্জ্বল চরিত্রের ভাস্কর্য একেক করে। সুশোভিত সৌন্দর্যে আত্মীয় হয়ে ওঠে পাঠক। নিজের দশ দিকে উচ্চারিত হবে—এতদিন কোথায় ছিলেন!

ড. মুকিদ চৌধুরী ঘটনা পরিবেশনে পরিবেশ পরিস্থিতি যথার্থ মূল্যায়িত করতে পারেন। নিজের একটা পরিবেশ সৃজিত হয়, আরোপিত মনে হয় না। লেখার শুরু থেকে শেষাবধি একটা টানের টিউনিং করে চলে। যেটি উপলব্ধ জ্ঞানের বিকাশও ঘটিয়ে দেয়। ভাষাকে আপন করে নিতে এমন আশ্চর্য জাদুকরী মন্ত্রের অধিকারী ড. মুকিদ চৌধুরী। চলমান ঘটনার সাথে পরিবেশ ও প্রকৃতির চমকিত উপমা সহজে মিতালি করে ভাষ্যে। ইদানীং তার লেখা পড়তে পড়তে আমি বিস্ময়ে আবিষ্কারে নিজেকে দাঁড় করাচ্ছি বাংলা ভাষার একজন সৌন্দর্যের জাদুকরের প্রদীপ্ত আলোয়। যিনি যত তাড়াতাড়ি বাংলার পাঠকদের কাছে উন্মোচিত হবেন; ততই বাংলা সাহিত্যের জন্য মঙ্গল।

০২
ড. মুকিদ চৌধুরীর অনবদ্য সৃষ্টি ‘যোদ্ধা’ নাট্যোপন্যাস পাঠের বিস্ময়কর গীতল স্পর্শের ছুঁয়ে যাওয়া ভালো লাগার পরে আরেকটি নাট্যোপন্যাস পাঠের আকাঙ্ক্ষা থেকে ছোট নাট্যোপন্যাস ‘তাঁরকাটার ভাঁজে’ পড়তে শুরু করা। সহজাত ব্যাপারের মতো সহজটাকে এত সুন্দর মোলায়েম স্বরে হৃদয় স্পন্দিত করা যেন ড. মুকিদ চৌধুরীর রূপকল্পনা।

কাকতালীয়ভাবে ‘তারকাঁটার ভাঁজে’ নাট্যোপন্যাস পাঠ করছি মার্চের ২৫ তারিখ বিকেলবেলা। অর্থাৎ এই ২৫ মার্চের রাতে ১৯৭১ সালের সেই কালরাত এবং ‘তারকাঁটার ভাঁজে’ উপন্যাসের শুরুটাও ২৫ মার্চের কালরাতের গা ও হৃদয় পোড়া বর্ণনার মধ্য দিয়ে। স্বভাবতই আমার মতো মুক্তিযুদ্ধ দেখতে না-পাওয়া তরুণের কাছে বিস্ময় আর হৃৎস্পন্দনের অস্বাভাবিকতা উপলব্ধির উপলক্ষ। ড. মুকিদ চৌধুরীর লেখা যতটুকু পড়েছি, মনে হয়েছে লেখক ঘটনা পরিস্থিতি তুলে ধরতে সে সময় একেবারে নিরপেক্ষ থাকেন। ২৫ মার্চের ভয়াল রাতে হিন্দু নিধনের যে বিচ্ছিরি পরিকল্পনা ‘তারকাঁটার ভাঁজে’ ব্যতীত অন্য কারও লেখায় তেমন দেখিনি। এমনকি হৃদয়ে ও মনন স্পর্শ করেনি। হয়তো কয়েকটি চলচ্চিত্রে ওই সময়ে দেশ ছেড়ে মানুষের পলায়ন দেখেছি। কিন্তু এমন বর্ণনা আর পরিবেশ ফুটিয়ে তুলতে পারেনি, তা অকপটে বলতে পারি। সেই ভয়াল রাতে কলেজপড়ুয়া মেয়ে রাসমণির ছবি আঁকা ও ছবি এঁকে ফেলে দেওয়ার দৃশ্য দিয়ে শুরু। যেন নিজেদের স্বপ্ন আর চাওয়া এঁকে এঁকে ফেলে দিচ্ছেন। রাসমণি এই উপন্যাসের মূল চরিত্র, রাইমণি, রাসমণির মা এবং প্রমথ দাসগুপ্ত রাসমণির বাবা। প্রমথ দাসগুপ্তের নিজের বাসভূম, মায়ের চিতা ও তুলসিতলা ফেলে পলায়ন না-করার দৃঢ়চেতা আকুতি পাঠকের মন কাঁদাবে। সেই ভয়াল রাতে আগুন দেখে রাসমণির কিশোরী ভাবের জিজ্ঞাসা মাকে—‘ও কীসের আগুন মা?
রাইমণি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, আমার তোর কপালের আগুন।
দুটি চোখ ভরে জল এলো রাইমণির। কয়েক ফোঁটা জলও গড়িয়ে পড়ল। দুহাতে তা মুছতে মুছতে রাইমণি বললেন, হিন্দু উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র। এখন আমাদেরও বাড়ি ছাড়তে হবে।’ (পৃ-১৪)
কিন্তু বাবার মৃত্যুর পরে সেই ভয়াল রাতে ঠিকই পালাতে হয়েছে রাসমণি ও তাঁর মাকে। কিন্তু ওই ভয়াল রাতে মা ও মেয়ে পলায়ন করতে গিয়ে দুজনের পথ বদলে যায়। দুজনে জানে না, দুজনের গতিপথ—
‘রাইমণি যত এগিয়ে যান আগুনের দাহ এবং মানুষের গুঞ্জন ততই যেন কাছে আসতে থাকে। যেন লণ্ঠন হাতে একঝাঁক মৌমাছি উড়ে বেড়াচ্ছে। মা মেয়ের শরীর ভার ভার ঠেকে, ভয়ে বুক কাঁপছে, জিব শুকিয়ে কাঠ। এসবের মধ্যেও রাসমণির একবার মনে হয়, এটি আলেয়ার আলো। মুখ ফুটে মাকে যে বলবে, সেই স্বর তার কণ্ঠে নেই। আগুন থেকে দূরে পালিয়ে যেতেই—ছোটাছুটি করতে করতে—মায়ের সঙ্গে মেয়েও পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ একসঙ্গে সবদিক হারিয়ে ফেলে। বাকি থাকে শুধু নিচে মাটি আর ঊর্ধ্বে আকাশ। রাইমণি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন রাসমণির কাছ থেকে।’ (পৃ-১৫)

রাসমণি পলায়নের মধ্যে দেখতে পায় রাজাকার আবুল কাশেম তার শরীরের দিকে বাজে ইঙ্গিতে তাকাচ্ছে। সেসময় এই রাজাকার আবুল কাশেমের ছেলে মীর কায়েশের কথা মনে হলো। মীর কায়েশ আবুল কাশেমের দ্বিতীয় পক্ষের ছেলে। সে আওয়ামীপন্থি এবং মুক্তিযোদ্ধা বলে বাবা ঘর থেকে বের করে দেয়। সেই রাতে পলায়নে রাসমণি অতকিছু বোঝার আগে পাকসেনাদের ঘাঁটিতে বন্দি হয়। শারীরিক নির্যাতনের কথা নতুন করে বলতে হবে না। শুধু এটুক বলি—ধর্মের দোহাই দিয়ে এমন নির্যাতন আরেকটি দেশের কথা বাদ দিন মানুষের ওপর মানুষের জোর জুলুম সুস্থ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। মানুষের জন্য ধর্ম, ধর্মের জন্য মানুষ নয়। এটি এই উপন্যাসে দারুণভাবে তুলে ধরেছেন সুনির্মিত যুক্তি দিয়ে। রাসমণি নিজের চোখে প্রতিক্ষণ পাকসেনাদের হাতে বাঙালি খুন, ধর্ষণ দেখতে পায়। রাসমণিকে কী ভেবে পালাক্রমে পাকপতি থেকে সাধারণ সৈনিক পর্যন্ত নির্যাতন করে বাঁচিয়ে রাখে কেবল ওর সুন্দর শরীরের লোভে বুঝি। ঘাঁটিতে থালাবাসন জামাকাপড় ধোয়ার বিনিময়ে খাবারের ব্যবস্থা হয় রাসমণির। পাকপতির রুমাল ধোয়ার কাহিনিতে সূক্ষ্ণ অনুভূতির জাল বুনে দেয় ড. মুকিদ চৌধুরী। রুমালটি উপহার দেয় পাঞ্জাবির এক নারী পাকপতিকে। সেটি দিয়ে সে কখনো নাক পর্যন্ত মোছে না। সযত্নে ধুতেও দেয়। কী এক সূক্ষ্ণ অনুভব। অথচ পরের বেলায় এসব মনেও থাকে না! দুজন বাঙালিকে পাকপতি নিজহাতে গলা টিপে মারার দৃশ্যের শেষে চা পানে মত্ত এক পিরিচ জিলাপির রস ভক্ষণে; তখন রাসমণি বারান্দায় আসার দৃশ্যটি এরকম—
‘নেশাজড়ানো চোখে পাকপতি মুচকি হাসছে আর উপভোগ করছে অনুশীলনরত পাকসেনাদের পদধ্বনি। তার দিকে মুখ করেই রাসমণি এসে দাঁড়ায়। একবার চোখ তুলে আকাশটা দেখে নেয়। যেন মীর কায়েশের মুখের প্রতিচ্ছবি নিয়ে মেঘের চিবুকের নিচে ম্লান ও দুর্বল সূর্যটি উদিত হয়েছে। রাসমণি স্বগতোক্তি করে, আদৌ কি সে বেঁচে আছে? সে কি জানে আমি এখনো বেঁচে আছি? নাকি সে আমার কথা যখন ভাবে, আমাকে মৃতই মনে করে? মুক্তি আমাকে একটা তারকাঁটার ভাঁজে পৃথক করে রেখেছে।’ (পৃ-২৭)

আরও পড়ুন

০৩
ড. মুকিদ চৌধুরী সিরিয়াস যাতনার মধ্যেও রসবোধ জিইয়ে রাখেন আশ্চর্যে। পাঠকের মধ্যে একঘেয়েমি আসার কোনো সুযোগ নেই। ‘তারকাঁটার ভাঁজে’ উপন্যাসটি মূলত রাসমণির বীরাঙ্গনা হয়ে ওঠার কাহিনি। পাকসেনাদের ঘাঁটিতে আক্রমণ করে অনেকের সাথে রাসমণিকে উদ্ধার করে ঠাকুর। ঠাকুর গেরিলা প্রধান। গভীর অরণ্যে আবাস গড়ে। ঠাকুরের মধ্যে রাসমণির প্রতি প্রেমানুভূতি জাগ্রত হলেও কেমন জানি মমত্ববোধে এটির বহিঃপ্রকাশ মুখে জানাননি। তদুপরি সবাইকে ডেকে গেরালিদের কাছে রাসমণিকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার মুহূর্তটি অনবদ্য—
‘এই নারীকে তোমরা চিনে রাখো। এমন নারীর সন্ধান তোমরা সচরাচর পাবে না। তিনি একজন বীরাঙ্গনা। তাঁকে সকলে বীরাঙ্গনা বলে ডাকবে। মায়ের মতো সম্মান করবে। তাঁর কোনো অনিষ্ট করবে না, করতেও দেবে না। তোমরা মানসম্মান রক্ষা করে চলবে।’ (পৃ-৩৯)

০৪
বীরাঙ্গনা রাসমণি প্রতিশোধে, দেশ রক্ষার শপথে, গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে একদিন ঠাকুরকে না-জানিয়ে বজরা সাজিয়ে পাকসেনার নৌকায় হামলা করে। কাকতালীয়ভাবে পাকসেনার নৌকায় মীর কায়েশও পাকসেনাদের সর্বস্ব লুটে নিতে গিয়ে আটকা পড়ে। ঘটনাচক্রে রাসমণি অস্ত্র লুট করতে সক্ষম হলে মীর কায়েশের সাথে সাক্ষাৎ হয়। এই উপন্যাসের টানটান উত্তেজনার পরিবেশ সৃষ্টি করে। প্রেমাকুতির মুহূর্মুহূ আলাপন নিবিড়ে নিয়ে যায়। দেশ রক্ষার ওই অস্থির সময়ে বীরাঙ্গনা কায়েশ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেও একদিন কায়েশের কাছে লোক পাঠায় দেখা করার জন্য। আবার একটি শর্তও জুড়ে দেয়, দেখা করার এই কথা যেন তার বাবা রাজাকার আবুল কাশেমকে না জানায়। এই কথা জেনে তো আবুল কাশেম চুপ থাকতে পারে না, পাকপতিকে জানায় এবং করুণ এক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে কায়েশের দেখা করতে আসার মধ্যে এগিয়ে আসে পাকসেনারা, যেন কায়েশ একটা টোপ। যুদ্ধের দামামা বাজতেই কায়েশকে চলে যাওয়ার বার বার অনুরোধ করেও কায়েশের একটাই জবাব—মরলে একসাথে মরবে, বাঁচলে একসাথে বাঁচবে।

এই আকুতির সুন্দর জয় হয়েছে। পাকসেনাদের পরাজিত করেছে বীরাঙ্গনা। শেষ মুহূর্তে বজরাটিকে কয়েক ডজন পাকসেনা ও পাকপতিসহ ঘিরে ফেলে। ভেতরে ঢুকেই পাকপতি বীরাঙ্গনা কে জানতে চাইলে প্রত্যেক নারীই বলে ওঠেন, আমরা প্রত্যেকেই বীরাঙ্গনা। এখানে একটা নির্ভেজাল যুদ্ধজয়ের দৃশ্যে হুবহু জড়িয়ে পড়েছি যেন আমিও। ড. মুকিদ চৌধুরী কথাসাহিত্যের সত্যিকারের রাজা। যার রাজত্বে তিনি সুষ্ঠু পরিচালনায় কোনো কার্পণ্য করেন না। পাঠকমাত্রই পড়লে বুঝে নেবেন কী মধুর অনুশাসন।

লেখক: কবি ও কথাশিল্পী।

এসইউ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।