চটি গল্পের মতো সাহিত্যকে উৎসাহিত করলে বইমেলার উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে

সায়েম সাবু
সায়েম সাবু সায়েম সাবু , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:৪৪ পিএম, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

** তরুণ পাঠকদের আগ্রহ বৃদ্ধি খুবই ইতিবাচক
** পুলিশিং নয়, বাংলা একাডেমির নজরদারি বাড়ানো দরকার
** বই প্রকাশের নামে পর্নোগ্রাফিকে উৎসাহিত করা নয়
** আগে উৎসব ছিল আনন্দের, এখন সব হতাশায় ঘেরা

অমর একুশে বইমেলা বাঙালির প্রাণের উৎসব। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিজুড়ে চলা এই মেলার বিশেষ ব্যঞ্জনা ও আবেদন রয়েছে বিশ্বের প্রায় সব বাংলাভাষী মানুষের কাছে। লেখক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক শাহরিয়ার কবির-এর চোখে ‘বইমেলা শিল্প-সাহিত্যের মিলনমেলা’। তিনি এ-ও মনে করেন, আয়োজদের অবশ্যই নজরে রাখতে হবে, যেন কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় বইমেলার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ব্যাহত না হয়।

একুশে বইমেলার নানা দিক ও প্রসঙ্গ নিয়ে জাগো নিউজ-এর কাছে মতামত ব্যক্ত করেছেন শাহরিয়ার কবির। তিনি বলেছেন, বই প্রকাশের নামে আমরা পর্নোগ্রাফিকেও উৎসাহিত করতে পারি না।

বইমেলার শুরুর দিকের স্মৃতি রোমন্থন করে শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘স্বাধীনতার পর মুক্তধারার মাধ্যমে বইমেলার যাত্রা। মাদুর বা চট বিছিয়ে বই প্রদর্শনী এবং বিক্রির আয়োজন হতো। আশির দশকে কয়েকটি স্টল দিয়ে মেলা বসতো। সেখানে ‘ডানা’ প্রকাশনীতে আমি এবং অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন নিয়মিত বসতাম।’

সবচেয়ে আশার কথা হচ্ছে মেলায় বই বিক্রি হচ্ছে। বইয়ের বিক্রি বাড়ছে, মানে পাঠক বাড়ছে। অন্তত গত কয়েক বছরের বিক্রির হিসাব ধরলে এমনটিই মনে করতে হবে। তার মানে বইমেলার অন্তত একটি উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে। তরুণ পাঠকদের আগ্রহ বাড়ার বিষয়টি খুবই ইতিবাচক। পাঠক বছরজুড়ে বইমেলার জন্য অপেক্ষা করেন। লেখকরাও অপেক্ষা করেন

‘শুরুটা চমৎকার ছিল। বিশেষ করে সব লেখকের আড্ডায় বইমেলা প্রাণবন্ত হয়ে উঠতো। শুধু লেখকরাই যেতেন তা নয়, শিল্পের সব শাখার মানুষের পদচারণা থাকতো বইমেলায়। শিল্পী ও সৃজনশীল মানুষদের মিলনমেলায় পরিণত হতো মেলাপ্রাঙ্গণ। শিল্পগুরু কামরুল হাসান স্টলে বসে ছবি আঁকতেন। সেই ছবি মেলাতেই বিক্রি করতেন। এই যে শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের মিলনমেলা শুরু হয়েছিল, তা মূলত বাংলা ভাষা-সংস্কৃতিকে তুলে ধরার লক্ষ্যেই। শিল্পের নানামাত্রিক বিকাশের লক্ষ্যেই।’

চটি গল্পের মতো সাহিত্যকে উৎসাহিত করলে বইমেলার উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে

‘বইমেলার পরিধি বড় হতে হতে এত ব্যাপ্তি ঘটেছে যে, এখন বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের পাশাপাশি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। বইমেলা নিয়ে নানা আলোচনা আছে। তবে সবচেয়ে আশার কথা হচ্ছে মেলায় বই বিক্রি হচ্ছে। বইয়ের বিক্রি বাড়ছে, মানে পাঠক বাড়ছে। অন্তত গত কয়েক বছরের বিক্রির হিসাব ধরলে এমনটিই মনে করতে হবে। তার মানে বইমেলার অন্তত একটি উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে।’

আরও পড়ুন>>
বইমেলায় উপচেপড়া ভিড়, স্টলে ক্রেতা নেই
এখনো বিক্রির তুঙ্গে জনপ্রিয় লেখকদের বই
সন্তুষ্ট প্রকাশকরা, অব্যবস্থাপনায় সমালোচিত বাংলা একাডেমি
নীতিমালা লঙ্ঘন, আরও ৭ প্রকাশনীকে সতর্কবার্তা

শাহরিয়ার কবির বলেন, তরুণ পাঠকদের আগ্রহ বাড়ার বিষয়টি খুবই ইতিবাচক। পাঠক বছরজুড়ে বইমেলার জন্য অপেক্ষা করেন। লেখকরাও অপেক্ষা করেন। ফলে বইমেলা ঘিরে লেখক ও পাঠকের মধ্যে সরাসরি সংযোগ স্থাপনের সুযোগ হয়। প্রতিথযশা সব লেখকই তো মেলায় যান। আমরাও গিয়েছি একসময়। লেখকরা পাঠকদের সঙ্গে আড্ডা দেন। খুবই সুন্দর একটি যাত্রা ছিল আমাদের জন্য।

বইমেলা ঘিরে যে উৎপাতের খবরগুলো এখন দেখি, তা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়। পুলিশিং নয়, বাংলা একাডেমির নজরদারি বাড়ানো দরকার। মেলার সৌন্দর্যহানি হয়, মেলার উদ্দেশ্য ব্যাহত হয় এমন কোনো প্রকাশনা এবং লেখককে কোনোভাবেই উৎসাহিত করা ঠিক নয়। একটি খারাপ বিষয় পুরো ভালো আয়োজনকে নষ্ট করে দিতে পারে

বইমেলাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের দিকে আলোকপাত করে এই লেখক-গবেষক বলেন, বইমেলা ঘিরে যে উৎপাতের খবরগুলো এখন দেখি, তা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়। পুলিশিং নয়, বাংলা একাডেমির নজরদারি বাড়ানো দরকার। মেলার সৌন্দর্যহানি হয়, মেলার উদ্দেশ্য ব্যাহত হয় এমন কোনো প্রকাশনা এবং লেখককে কোনোভাবেই উৎসাহিত করা ঠিক নয়। একটি খারাপ বিষয় পুরো ভালো আয়োজনকে নষ্ট করে দিতে পারে।

চটি গল্পের মতো সাহিত্যকে উৎসাহিত করলে বইমেলার উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে

‘বই প্রকাশের নামে পর্নোগ্রাফি তুলে ধরা যায় না। রাষ্ট্রবিরোধী কোনো বই প্রকাশ হলে সরকার আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু চটি গল্পের মতো সাহিত্যকে উৎসাহিত করলে মেলার মূল উদ্দেশ্য তো ব্যাহত হবেই। এটি আপনি আইন দিয়ে বন্ধ করতে পারবেন না। এটি বন্ধ করার দায়িত্ব লেখক, পাঠক, প্রকাশক ও মেলার আয়োজকদের।’

শাহরিয়ার কবির বলেন, বইমেলা কিন্তু আর দশটি মেলার মতো নয়। অনেকেই পরিবার নিয়ে সেখানে যান। প্রেমিক-প্রেমিকারা যান। নতুন দম্পতিরা যান। এ বিষয়গুলো আয়োজকদের নজরে থাকতে হবে। এমন কোনো কিছু করা ঠিক হবে না, যাতে পাঠক-ক্রেতা-দর্শনার্থীরা বিরক্ত হন। আমি আমার সুবিধা দেখলে হবে না শুধু। আমার কারণে অন্যের অসুবিধা যেন না হয়, তা খেয়াল রাখাও মানবিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আমি একবার লেখক হুমায়ূন আহমেদকেও এ বিষয়টি বলেছিলাম।

চটি গল্পের মতো সাহিত্যকে উৎসাহিত করলে বইমেলার উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে

‘কারণ, নতুন বইয়ে অটোগ্রাফ নেওয়ার নাম করে এমন ভিড় হয়, সেখানে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্ম হয়ে যায়। বই চুরি যায়, মোবাইল ফোন চুরি যায়। হট্টগোল বাঁধে। বইয়ের মেলায় তো এমন হওয়ার কথা নয়। এটি তো সব বাঙালি ও বাংলাভাষীদের একটি মিলনমেলা। তাই দায়ও সবার’- যোগ করেন তিনি।

আরও পড়ুন>>
নাস্তিকরাও উগ্রবাদী হয়ে উঠছে
মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের ব্যবহৃত সব বুলেট চীনের
শিক্ষায় মৌলবাদের আঘাত দেখতে চাই না
ধর্ম ফেলে দেয়া যাবে না, রাষ্ট্র থেকে আলাদা রাখতে হবে

সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে এই লেখক ও প্রাবন্ধিক বলেন, আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রধান বাহন হচ্ছে বই। বইকে কেন্দ্র করেই আমাদের সাংস্কৃতিক জাগরণ হওয়ার কথা। অনেকেই বই লিখছেন। এটিকে ইতিবাচকভাবেই দেখতে হবে। এটিকে ধরে রাখতে হবে। তবে এমন কোনো কিছু করা উচিত নয়, যার জন্য বইমেলার স্পিরিট নষ্ট হয় এবং সরকার হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পায়।

যেমন পহেলা বৈশাখ সর্বজনীন একটি উৎসব। এ উৎসবে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, এখন আর সন্ধ্যার পর কোনো আয়োজন রাখতে দেয় না পুলিশ। কোনো না কোনো কারণেই তো এসব করা হয়েছে। নারীর প্রতি অশালীন আচরণ করা হয়েছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে। উৎসব বন্ধ করার জন্যই তো এই পরিকল্পনা। তারা (পরিকল্পনাকারীরা) অনেকাংশেই সফল

প্রসঙ্গ টেনে শাহরিয়ার কবির বলেন, যেমন পহেলা বৈশাখ সর্বজনীন একটি উৎসব। এ উৎসবে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, এখন আর সন্ধ্যার পর কোনো আয়োজন রাখতে দেয় না পুলিশ। কোনো না কোনো কারণেই তো এসব করা হয়েছে। নারীর প্রতি অশালীন আচরণ করা হয়েছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে। উৎসব বন্ধ করার জন্যই তো এই পরিকল্পনা। তারা (পরিকল্পনাকারীরা) অনেকাংশেই সফল।

‘পহেলা বৈশাখের উৎসবস্থল এখন নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হয়। রাতে আর কোনো আয়োজন থাকে না। অথচ আগে আমরা সারারাত ধরে উৎসব উদযাপন করতাম। যাত্রা হতো, পালা হতো। কত আনন্দ হতো। এখন সব হতাশায় ঘেরা। সুতরাং, বইমেলায় যেন অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনা না ঘটে তার জন্য আয়োজকদের আগে থেকেই সতর্ক হতে হবে।’

এএসএস/এমকেআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।