শফিক আশরাফের ‘পাউঠি’
গোধূলির আকাশে অস্তমান সোনারং সূর্যের আখ্যান
জাকিরুল জাকির
[পাউঠি কথন: কথাসাহিত্যের একজন অসামান্য শিল্পবীদ থেকে একজন সার্থক শিল্পী হয়ে একটি দীপ্যমান সূর্যের গোধূলিলগ্নে যাওয়ার পরিক্রমা নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়েছেন শফিক আশরাফ (৬ আগস্ট ১৯৭১-বর্তমান)। ‘পাউঠি’ তাঁর প্রথম উপন্যাস। টাঙ্গন প্রকাশনা থেকে ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত এ উপন্যাস অব্রুবাণ ও মূলত্রাণ নামে দুটি পর্বে বিস্তৃত। দেশবরেণ্য গবেষক স্বরোচিষ সরকারের মতানুসারে, এ উপন্যাসের কাহিনি মূলত দ্বিমাত্রিক–একদিকে বয়নশিল্পের সঙ্গে জড়িত একটি জনজাতির আত্মপরিচয়ের বিবরণ, অন্যদিকে এই সম্প্রদায় থেকে উঠে আসা একটি সত্তা কিভাবে বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে তার বর্ণনা।]
শিল্প শিল্পের জন্য নাকি জীবনের জন্য, নাকি বৈচিত্র্যময় সমাজজীবনই শিল্প? শিল্পকে যদি নান্দনিকতার শৃঙ্খল অতিক্রম করতেই হয় তবে বলা যায়, বাস্তব জীবনের অধিক নান্দনিকতা কোথায় আছে? জীবনের সংঘাতকে আলিঙ্গন করে ঘৃণিত শুঁয়োপোকার মনোমুগ্ধকর প্রজাতিতে রূপান্তরিত হওয়ার মাঝে যে নান্দনিক শিল্পগুণ আছে, জীবনের সমস্ত সঞ্চয় একীভূত করে ডানা তৈরি করে উড়বার উচ্ছ্বাস নিয়ে অগ্নিস্নান করা পিপীলিকাজীবনেও সেই শিল্পগুণ নিহিত আছে। জীবনের তাগিদে ঘর্মস্নাত এক জনগোষ্ঠীর পতনের এমন এক শৈল্পিক আখ্যান শফিক আশরাফের ‘পাউঠি’। পিছিয়ে পড়া নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর শৈল্পিক আখ্যান বাংলা সাহিত্যে অবশ্য এটিই প্রথম নয়। রাঢ়বঙ্গের কোপাই তীরবর্তী বাঁশবাঁদি গ্রামের কাহারদের অস্তিত্ব বিসর্জনের পটভূমিকে কেন্দ্র করে তারাশঙ্কর উপহার দিয়েছেন ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’। যেখানে বাঁশবাঁদির কাহার জীবন ছেড়ে করালীকে গ্রহণ করতে দেখা যায় চন্ননপুরের যন্ত্রজীবন। ফরিদপুর অঞ্চলের জেলে সমাজের প্রতিনিধি কুবেরের জলজীবন বিসর্জন দিয়ে নতুন জীবনভূমি ময়না দ্বীপে যাওয়ার আখ্যান মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ এবং তিস্তার তীরবর্তী কৃষক সমাজের আখ্যান দেবেশ রায়ের ‘তিস্তাপাড়ের বৃত্তান্ত’। কিন্তু বাংলা উপন্যাসে বয়নশিল্পের সাথে জড়িত মানুষের ঘর্মাক্ত ক্রন্দনের বাস্তব আখ্যান হিসেবে সমরেশ বসুর ‘টানাপোড়েন’। এর পরেই পাউঠির অবস্থান। ঔপনিবেশিক প্রভাব ও স্বাধীনতা-উত্তর সময়ের পুঁজিবাদী আগ্রাসনের চাপে যমুনাতীরবর্তী গ্রামগুলো থেকে ধীরে ধীরে লুপ্ত হতে থাকে তাঁতের খটখট আওয়াজ, যে আওয়াজ একসময় মসলিন কাপড়ের ভাঁজে মিশে পৌঁছে গিয়েছিল সুদূর পারস্য পর্যন্ত। সে আওয়াজ মিশে গিয়েছিল তাঁতপাড়ার সমস্ত মানুষের হৃদয়কম্পনের সাথে। ক্ষীণায়মান সেই কম্পনের শেষ ধ্বনিটুকু শফিক আশরাফ আবদ্ধ করেছেন তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘পাউঠি’তে।
যমুনা তীরবর্তী তাঁতসমাজের তিন পুরুষের এক পূর্ণাঙ্গ দর্পণচিত্র। এতে প্রতিফলিত হয়েছে ওই অঞ্চলের ভাষা, সংস্কৃতি, অপবিশ্বাস, প্রকৃতি এবং রাজনীতিসহ পুরো সমাজব্যবস্থা। বর্তমানের অর্ধমুক্ত সমাজে দাঁড়িয়ে যে কথা বলতে এখনো আমাদের গদি কেঁপে ওঠে, সেই সময়ের সমাজে দাঁড়িয়েই লেখক সে কথা অনায়াসেই বলে দেন, “গ্রামের তমিজ ডাকাত এখন আর ডাকাত নয়, তার নতুন নাম তমিজ মেম্বার।” যুদ্ধের পরে যে তমিজ লুটপাট, ডাকাতির জন্য যুদ্ধের অস্ত্র জমা দেয়নি। গরিবুল্লাহ তো তার ভাইদের মানুষের একটা কাটা মাথা দেখিয়ে ভোট নিয়ে মেম্বার হয়েছে। সংস্কার বাঙালির জীবনের সমার্থক। জীবনে প্রতিটি অধ্যায়ে ছড়িয়ে থাকে নানা সংস্কার-কুসংস্কার। লেখক কখনো এ সকল সংস্কার সমীহ করেছেন আবার কখনো প্রতিবাদের সুর বহন করেছেন আপন ভাষ্যে। বিয়ের যৌতুক প্রথা ভারতবর্ষের এক ভয়াবহ ব্যাধি হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছিল, কৌলিন্য প্রথা তথা এক জাতের সাথে অন্য জাতের বিয়ে যে সামাজিক বিরোধ তার পরিচয়ও বহন করে এ উপন্যাস। লেখকের ভাষায়, “গালিব জিজ্ঞেস করল, ‘সব ঠিকঠাক আছে তো? গ্রামের মানুষ তো বিয়েতে দেনাপাওনা নিয়ে ঝামেলা করে। তোমাদের এই ধরনের সমস্যা নেই তো?’ -নাহ্, ওই ধরনের কোনো সমস্যা নাই আর আমাদের এলাকাতে যৌতুকের প্রবণতা তুলনামূলক কম।”
জ্বিন-ভূতের বিশ্বাস বাংলার গ্রামীণ সমাজের শিরায় উপশিরায় প্রবাহিত। মালেহা খাতুন এ উপন্যাসে এ সকল বিশ্বাসের একজন প্রতিনিধি এবং একই সাথে একজন সার্থক মা। বালক রফিকের দুরন্তপনা আলাদাভাবে নজর কাড়ে। তার গাছের উঠে সাপের ফসফস শুনে আতঙ্কিত হয়ে নেমে যাওয়া, ঝোঁপের কাছে পাখির বাসার খোঁজ করা, নদী বা ডোবা হতে মাছ ধরা তাকে জীবন্ত করে তুলেছে। মনে হয় এ যেন দুর্গাহীন অপু। সে প্রকৃতির কোলে খেলা করে বেড়ে উঠেছে। সে কারণেই হয়তো বিবাহপরবর্তীকালেও প্রিয়তমার সাথে জোনাকির আলো অথবা বটবাবা দর্শনে আপ্লুত হয়। ততদিনে রফিক বৃহত্তর সমাজের সাথে যুক্ত হয়ে গিয়েছে কিন্তু সে কোনোকালেই আপন অস্তিত্বকে ভুলে যায়নি। সে নিজের জাতিকে লালন করেছে নিজের মধ্যে। যা এ উপন্যাসের মূল আকর্ষণ। থিসিস সুপারভাইজার তাই বলেন, “ধরে নাও এটা তোমার পিতৃঋণ শোধ করার একটা সুযোগ।” কিন্তু পিতৃঋণ কি পরিশোধযোগ্য? সমাজের সকলেই এই ঋণের নাগপাশে আবদ্ধ। ডিসেম্বরের তীব্র শীতেও ঘামের জলে সর্বাঙ্গ ভিজিয়ে যারা অন্যের লজ্জা নিবারণের বস্ত্র তৈরি নিজে বস্ত্রহীন হয়ে থাকে তারাই পরিচিত হয় জোলা বা বোকা নামে। বাস্তবেই তো তারা বোকা অন্যথায় মৃত ভবিষ্যতের আশায় জীবন বিসর্জন দেওয়ার কোনো কারণ নেই। যে তাঁতে কাপড় তৈরি করে একসময় পুরো পরিবারের জীবিকা নির্বাহ হতো; সেই তাঁত কাঁচামালের সংকটে ফাঁকা পড়ে থাকে। বল্লাবাজার হয়ে যায় লোকশূন্য। যে বাজারের কথা মনে করতেই রফিকের চোখ আর্দ্র হয়ে ওঠে।করুণ বদনে সে বিড়বিড় করে বলে, “ফিরে এসো সেই বল্লার হাট, ফিরে এসো জাদুকর।”
সভ্যতার কেন্দ্রীভবনের (সেন্ট্রালাইজেশন) ফলাফল এই অশ্রু, বাজারের লোকশূন্যতা। তাঁতশিল্পীদের চোখে অশ্রু, মুখে হতাশা, কণ্ঠে হাহাকার; কেন্দ্রের আকর্ষণে নিজের ভূমির এই বিসর্জনকে ব্যাখ্যা করবার শব্দ পাওয়া দুষ্কর। তাই জ্যাক দেরিদার ভাষায় বলতে হয়, “শব্দ আছে কিন্তু প্রতিশব্দ নাই”। সমস্ত ক্ষুদ্র শিল্প পুঁজিপতিদের হস্তগত হওয়ায় সংকটে পড়ে পিতৃস্মৃতি আকড়ে ধরে থাকা অবহেলিত শিল্পীকে বলতে হয়, “তাঁতঘরে আমার গ্যলি যে য্যবন, ওরে তুরা মন দিয়া শোন।”
মহিউদ্দিনকে বলতে হয়, “তা বাঁচব ক্যামনে তুমি কও, তুমি তো মেলা লেহাপড়া করলা। রাতারাতি সুতার দাম বান্ডিল প্রতি ২০০/৩০০ টেহা বাইরা যায়, রঙ কহনো বাজারে থাকে আবার থাকে না, দাম তাঁতিদের নাগালের বাইরে। কাপড়ের দাম পিস প্রতি ১০ টেহা বাড়ালে পাইকাররা মুখ ঘুরাইয়া চইলা যায়। ...তাঁতি মরার আর কী থাহে কও?”
ফলশ্রুতিতে সংবাদের শিরোনাম হয়, “ঐতিহ্য হারাচ্ছে তাঁতশিল্প, সিরাজগঞ্জের অনেকেই ফতুর হয়ে এলাকা ছেড়েছেন।” এভাবে পতন হতে থাকে দীর্ঘসময়ে ঐতিহ্যবাহী একটি শিল্পের। যে শিল্পের মাধ্যমে দীর্ঘদিন নিজের, নিজের পরিবারের ক্ষুধা নিবারণ করেছিলেন শিল্পীরা, সে শিল্প হারিয়ে যায় কিন্তু থেকে যায় নিষ্ঠুর ক্ষুধা। তাই শিল্পীদের মিশে যেতে হয় বৃহত্তর সমাজে, খুঁজে নিতে হয় নতুন ভূমি ময়না দ্বীপ, চন্ননপুর অথবা রফিকের মতো শিক্ষকজীবন। কিন্তু অবচেতনে রয়ে যায় সেই শিল্পীস্বভাব, যার টানে রফিককে মৃত তাঁতঘরে ফিরে যেতে হয়, মৃত পাউঠির কান্নার সাথে মিশে গিয়ে নিজের অশ্রুপাত করতে হয়। এই অশ্রুপাত সেই শিল্পীদের চোখ থেকে মুছে গেলেও পাউঠির মাধ্যমে সদা-বিকাশ তাৎপর্যে উদ্ভাসিত থাকবে পাঠকের মনে।
লেখক: শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
এসইউ/জেআইএম