প্রশান্তিকা: প্রশান্ত পাড়ে বাংলা বইয়ের ফেরিওয়ালা
২০১৯ সালের মার্চে গিয়েছিলাম অস্ট্রেলিয়া। আমন্ত্রণ জানিয়েছিল সিডনি ভিত্তিক বাংলা পত্রিকা ‘প্রশান্তিকা’। তাদের সাথে সহ আয়োজক হিসেবে ছিল সিডনির আরেকটি পত্রিকা ‘মাসিক মুক্তমঞ্চ’। এই ট্যুর নিয়ে আমার মধ্যে উত্তেজনা থাকলেও বড় কোনো প্রত্যাশা ছিল না। সাধারণত দেশ থেকে বিদেশে এই ধরনের আয়োজনের ক্ষেত্রে আয়োজক এবং উদ্দিষ্ট দর্শকের কাছে লোভনীয় হয়ে থাকেন সিনে তারকা, কণ্ঠশিল্পী কিংবা স্টেজ পারফর্মাররা। এর কারণও রয়েছে। এই ধরনের ট্যুরগুলো সঙ্গত কারণেই খুব ব্যয়বহুল হয়। এবং এই ব্যয় উত্তোলনের জন্য আয়োজকদের দ্বারস্থ হতে হয় স্পন্সর প্রতিষ্ঠানের কাছে। আর কে না জানে একজন লেখকের তুলনায় স্পন্সর প্রতিষ্ঠানের কাছে একজন শোবিজ তারকা, সংগীতশিল্পী কিংবা পারফর্মারই অনেক বেশি আরাধ্য এবং দরকারি।
তো এমন বাস্তবতায়, লেখালেখিতে প্রায় নবীন এবং বয়সে তুলনামূলক তরুণ এই আমাকে যখন আমন্ত্রণ জানানো হলো, তখন আমি খানিক ঘাবড়েই গিয়েছিলাম। ব্যাপারটি আমার জন্য অপ্রত্যাশিত। তবে সেই অপ্রত্যাশিত ব্যাপারটিই বিস্ময়কর হয়ে উঠলো সিডনিবাসী বাংলাদেশিদের অভাবনীয় আতিথেয়তা ও অপার ভালোবাসায়। যা পরবর্তীতে মুগ্ধতা ছড়িয়েছে মেলবোর্ন ও ব্রিসবেনেও।
দেশে ফেরার পর দীর্ঘসময় আমি বুঁদ হয়েছিলাম সেই অস্ট্রেলিয়া ট্যুরে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, দেশাত্মবোধ ও সাংস্কৃতিক নানান অনুষঙ্গ ছড়িয়ে দেওয়ার যে চেষ্টা আমি সেখানে দেখেছি, তা মুগ্ধকর। সেই মুগ্ধতা বিভিন্ন সময়েই নানা কারণে বিস্তৃত হয়েছে। বিস্তৃত হয়েছে প্রশান্তিকা নামক পত্রিকাটির প্রতি অদ্ভুত এক ভালো লাগাও। সাত সমুদ্র তের নদীর ওপার থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ছড়িয়ে দেওয়ার যে অবিরাম প্রচেষ্টা তাদের, তা আমাকে আবেগে আপ্লুত করেছে।
প্রতিবছর সিডনিতে একুশে বইমেলা হয়। মাত্র একদিনের সেই বইমেলার জন্য বাংলাদেশ থেকে বিপুল কুরিয়ার খরচে বই নিয়ে যায় প্রশান্তিকা। তাদের একটি সিস্টার কনসার্ন রয়েছে। কনসার্নটির নাম প্রশান্তিকা বইঘর। সেই বইঘরের মাধ্যমে বছরজুড়েই তারা সমগ্র অস্ট্রেলিয়ায় বই পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করে। অস্ট্রেলিয়া বিশাল এক দেশ বা মহাদেশ। সেই দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে অনলাইন বা ফোনে বই অর্ডার করলেই তারা কুরিয়ারের মাধ্যমে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেন। চেষ্টা করেন সিডনির বাঙালি কমিউনিটি আয়োজিত যেকোনো আয়োজনে বই নিয়ে হাজির হতে।
প্রবাসের কঠিন জীবন, রুঢ় বাস্তবতা ও শত ব্যস্ততার মধ্যেও বাংলা বই ছড়িয়ে দেওয়ার এই প্রচেষ্টায় যে দুজন মানুষ নিরন্তর সময় ও শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন, তাদের একজন আতিকুর রহমান শুভ এবং অন্যজন আরিফুর রহমান পাশা। প্রথমজন প্রশান্তিকা পত্রিকার সম্পাদক। আচরণে শান্ত, গম্ভীর, স্থির। দ্বিতীয়জন একই পত্রিকার বার্তা সম্পাদক। অস্থির, ছটফটে, তুমুল আড্ডাবাজ। তারা সম্পর্কে সহোদর। কিন্তু পুরোপুরি বিপরীত চরিত্রের এই দুজন মানুষ ঠিক এই একটি জায়গায় এসে যেন মিলে গেলেন একই স্রোতে। সেই স্রোত বাংলা বই ছড়িয়ে দেওয়ার।
করোনা পরবর্তী বাস্তবতায় দেশের বইমেলাই যখন ঘোর অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হয়েছিল; তখন অস্ট্রেলিয়ার পাঠকদের কাছে বাংলা বই পৌঁছে যাবে, এমন ভাবনা আমি অন্তত ভাবিনি। হয়তো ভাবেননি অস্ট্রেলিয়ার পাঠকরাও। কিন্তু প্রশান্তিকা বইঘর সেই অসম্ভব ভাবনাটিকেও সত্যি করে ফেললো। অমর একুশে পালন উপলক্ষে যে সীমিত পরিসরের আয়োজন হয়েছিল সিডনিতে, সেই আয়োজনের জন্য আবারও দেশ থেকে বিপুল কুরিয়ার খরচ দিয়ে বই নিয়ে গেলেন তারা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই বই পাঠকের হাত পর্যন্ত পৌঁছাবে তো? তাদের খরচ উঠবে তো? প্রশ্ন কিংবা শঙ্কাটি যথাযথ। কারণ প্রতিবছরের মতো এবার সিডনিতে জমজমাট বইমেলা নেই। নেই বর্ষবরণ কিংবা বসন্ত উৎসবের মতো জমকালো আয়োজন। তাহলে বইগুলো পাঠক অবধি পৌঁছাবে কী করে?
ঠিক এমন বাস্তবতায় অনলাইনে ভেসে ওঠা একটি ছবি আমাকে সত্যিকার অর্থেই চমকে দিয়েছে। শুধু চমকেই দেয়নি, রীতিমতো মুগ্ধ করেছে। প্রশান্তিকা পত্রিকার বার্তা সম্পাদক, যিনি একজন জনপ্রিয় কথাশিল্পীও, সেই আরিফুর রহমানকে দেখা গেলো সিডনির বাঙালিপাড়া খ্যাত লাকেম্বায় এক রেস্তোরাঁর সামনের ফুটপাতে বই নিয়ে বসে যেতে। ছবিটি দেখে দীর্ঘসময় তাকিয়ে ছিলাম আমি। একজন মানুষ হাসিমুখে বসে আছেন। তাঁর সামনে একটি টেবিল। সেই টেবিলের ওপর থরেথরে সাজানো বাংলা বই। ফুটপাত দিয়ে মানুষ হেঁটে যাচ্ছে। ব্যস্ত রাস্তায় হুসহাস গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। আর ফুটপাতে বই নিয়ে বসে আছেন ঝাঁকড়া চুলের বাবড়ি দোলানো এক তরুণ। তাঁর মুখভর্তি হাসি। হয়তো খুবই সাধারণ একটি ছবিই। কিন্তু ওই সাধারণ ছবিটিই মুহূর্তেই যেন হয়ে উঠলো অসাধারণ দ্যুতিময় এক অনুভব।
বাঙালি পথচারীরা হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ান। তারপর নেড়েচেড়ে দেখতে থাকেন, এই এতদূরের বাংলাদেশ থেকে যাওয়া তাদের নিজের ভাষার, নিজের লেখক ও প্রকাশকের বইগুলো। তারা সেই বই হাতে নিয়ে পাতা ওল্টাতে থাকেন। মুগ্ধ হয়ে খুঁজতে থাকেন জীবনের গল্প, গল্পের জীবন। তারপর প্রিয় লেখাগুলো নিজেদের করে নেন। একের পর এক ছবিগুলো দেখতে থাকি আমি। প্রতিটি দৃশ্য এতো জীবন্ত, এতো আপন মনে হয়। মনে হয় এভাবেই যদি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়তো আমাদের লেখা, আমাদের গল্প ও গান, বই ও চলচ্চিত্র।
একজন লেখক হিসেবে এই তেষ্টাটা খুব অনুভব করি। প্রায়ই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাংলা ভাষাভাষি পাঠকের অনুরোধ শুনি, তারা সেখানে বই চান। কিন্তু পাওয়ার উপায় নেই। নিজের কাছেই তখন খুব অসহায় লাগে। মনে হয় যদি কোনো উপায়ে নিজের লেখাগুলো সেখানে ছড়িয়ে দিতে পারতাম। ছড়িয়ে দিতে পারতাম বাংলাভাষার আর সব লেখকের বইও। কিন্তু হয় না। সাধ ও সাধ্যের যুগলবন্দী বড় কঠিন। আর কঠিন বলেই হয়তো আরিফুর রহমানের অমন বইয়ের ফেরিওয়ালা হয়ে লাকেম্বার ফুটপাতে বই নিয়ে বসে যাওয়ার ছবিটা বুকের ভেতর কেমন অদ্ভুত অনুভব দেয়। সেই অনুভব ভাষা ও ভালোবাসার। স্বপ্ন ও প্রত্যাশার। নিশ্চয়ই পৃথিবীর আর সব দেশেও প্রশান্তিকা বইঘরের মতো বাংলা বই ছড়িয়ে দেওয়ার এমন প্রচেষ্টা শুরু হবে। পাঠক পৃথিবীর সব দেশে বসেই সহজে সংগ্রহ করতে পারবেন তাঁর প্রিয় বাংলা বইটি।
তারপর ডুবে যেতে পারবেন দূর দেশে রেখে আসা প্রাণ আর শেকড়ের ঘ্রাণে।
এসইউ/জেআইএম