বইমেলায় অশনি সংকেত
একটু ভেবে দেখুন, দিন শেষে প্রকাশক কিন্তু টাকা কামাতেই চান। সাহিত্যসেবা-টেবা সব ছেঁদো বুলি, আমরা সবাই টাকার গোলাম। তাতে হয় কি, সাহিত্যের মানের বিষয়ে কেউ খুব একটা মাথা ঘামান না, লেখক-প্রকাশক উভয়েই চান বাজার-কাটতি বই লিখে বা ছেপে রাতারাতি নাম আর পয়সা কামাতে। মান নিয়ে মাথা ঘামিয়েও যে খুব একটা লাভ হবে তা তো নয়, বরং মান নির্ধারণ নিয়ে তখন আবার নতুন করে নাম-গান শুরু হবে। কারণ সাহিত্য বা লেখাটি মানসম্মত কি-না তা যাচাই করবে কে! কার এমন বুকের পাটা বা মগজে ধূসর পদার্থ আছে যিনি কি-না নির্মোহভাবে একটি লেখার পক্ষে বা বিপক্ষে রায় দেবেন!
একটি উদাহরণ দেই, তাহলেই সবাই আমার পয়েন্টখানা দিব্যি বুঝতে পারবেন। আমি লিখি কুড়ি বছর ধরে। এটা-সেটা মেলা কিছু লিখে এখন আমি মোটামুটি গোয়েন্দা আর অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাসে থিতু হয়েছি। তারকা-প্রকাশকও জুটেছে দু’চারজন। তার মানে বাজার কাটতি একেবারে মন্দ নয়। কিশোররাই মূলত আমার পাঠক। তারা বুদ্ধিমান না হতে পারে, তবে চালিয়াত নয়। লেখা পড়ে ভালো না লাগলে তারা বিনা বাক্যব্যয়ে তা ছুড়ে ফেলে দিতে কসুর করবে না। এটুকু চিত্তের স্বাধীনতা আমার পাঠকরা উপভোগ করে বলেই মানি।
তো হয়েছে কি, হালে আমি আমার এক প্রকাশককে ভিন্নতর কিছু প্রকাশের কথা বললে তিনি গা মোচড়ান, বলার চেষ্টা করেন যে, কিশোরে তো ভালোই ছিলেন, আবার কঠিন ও দুষ্পাচ্য লেখা, মান-টানের কথা তুলছেন কেন। ওসব লেখা আজকাল চলে নাকি! কে খায় বলুন! সাথে সাথে তিনি খ্যাতনামা দু’চারজনের নামও বলে দিলেন। আমি মানছি তিনি ভুল কিছু বলেননি। এই জামানায় মানসম্পন্ন লেখার তুলনায় চিপস-চানাচুর বরং চলে ভালো। খেলে কুচুরমুচুর শব্দ হয়, আবার হজমেও প্রবলেম হয় না। পুষ্টি! এসব নিয়ে আর কে ভাবে বলুন। সবাই শর্টকাটে দাও মারতে চায় এখন।
অর্থাৎ খেটেখুটে তৈরি করা ভালো লেখা কেউ আর এখন প্রকাশও করতে চান না। তাতে নাকি টাকা নষ্ট। বিক্রি কম। ফলে হয়েছে কী, নাদান পাঠকরা সব উদ্বাহু হয়ে সেই প্যানপেনে প্রেমের গল্পে গিয়ে ঢলে পড়ছে। নতুন বিয়ে করা বউ হানিমুন করতে গ্রামে গেল, সেখানে গিয়ে ধর্ষকামী এক পুরুষের খপ্পরে পড়লো নববধূটি। যথারীতি শ্লীলতাহানি ঘটল। বিচার-শালিস বসল। স্বামী বেচারা সবকিছু জেনেও বউকে তালাক দিলো না। এতে নাকি তার বিশাল মনের পরিচয় মিলল। এ হলো গিয়ে এখনকার প্রেমের আখ্যান। জনৈক লেখক তো ধর্ষণের মতো স্পর্শকাতর ঘটনাকে পুঁজি করে রীতিমতো বই বেচার ধান্ধাও শুরু করেছে। কী রুচি ভাবুন!
তারপর ধরুন চিৎ-কাত হয়ে তোলা ছবিযুক্ত ফেসবুক স্ট্যাটাসের সংকলন ছাপা হয়েছে দুটো। সেসব চলছেও দেদার। কারণ যার স্ট্যাটাসের পুস্তক এটি, তিনি যে সে কেউ নন, রীতিমতো সেলিব্রেটি। তিনি মেলার মাঠে এলে ভিড় জমে যায়, তাই দেখে বর্ষীয়ান লেখক ও কবিগণ শশব্যস্ত হয়ে পালানোর পথ পান না। কোনো কোনো ‘সাফল্যের টোটকা ব্যবসায়ী’ আবার সঙ্গে করে মিডিয়া বা নিজস্ব ক্যামেরা পারসন নিয়ে আসেন। নইলে তাদের বিকিকিনির এই মহা মূল্যবান মুহূর্ত ধারণ করবে কে! এসব দেখেটেখে একজন তীর্যক মন্তব্য করলেন, ‘বেশ তো চলছে, মেলায় এবার দুটো নাগরদোলা, মোড়গের লড়াই আর বান্দরের নাচ এনে বসালেই হয়। ষোলোকলা পূর্ণ’।
আমি নীরব দর্শকের মতো মেলার মাঠে ঘুরি। মানুষ দেখি, হাউকাউ কিসিমের কাণ্ড দেখে ব্যাপক মজা পাই। কারণ জোর করে পাঠক ধরে এনে তাদের হাতে নিজের বই গছিয়ে দেওয়া নেহাত অরুচিকর নয়, অভব্য আচরণ বটে। এক প্যাভিলিয়নঅলাকে দেখি চ্যাংড়াগোছের এক লেখককে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন, ইনি আমাদের বেস্টসেলার লেখক। পরিচিত হন। অথচ পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন নমস্য এক ব্যক্তি, যার বই পড়ে আমরা সভ্যতা শিখেছি বা কিছু জানার চেষ্টা করেছি। এহেন প্রকাশককে আপনি কী বলবেন- টাকার কুমির নাকি নিরেট বোকা!
তা কী লিখে বেস্টসেলার হলেন সেই অর্বাচীন যুবা! নাহ, তিনি নিজেও ঠিক জানেন না, কেন পাবলিক তার বইয়ের উপর এমন হুমড়ি খেয়ে পড়েছে! বস্তুত কারণ আর কিছুই নয়, অ্যাগ্রেসিভ মার্কেটিংয়ের জাদু, নয়তো তলে তলে নিজেই মুরিদ খরিদ করে এনেছেন। এসবই চলছে এখন। লেখক শুধু লিখলে হবে না, বইয়ের বিপণন থেকে শুরু করে খদ্দের বা মুরিদও তাকে তাড়িয়ে নিয়ে আসতে হবে। নইলে প্রকাশকের কাছে নিজের মান থাকবে না, নেক্সট বার আপনার বই ছাপতেও তিনি কুণ্ঠাবোধ করবেন।
সাহিত্য তাহলে ঠিক কী রকম হবে! অর্থাৎ আপনি নিজে বলছেন আপনি ভালো লিখছেন, কিন্তু পাঠক তা পাতে তুলছে না। এসব লিখে কী হবে! জমিজমা যা কিছু আছে সব বন্ধক রাখবো নাকি! জনৈক মুরগি-ধরা প্রকাশক সশব্দে আওয়াজ দিলেন। এর সঠিক উত্তর আমারও জানা নেই, তবে এটুকু বলতে পারি মুনাফাই যদি আপনার মূল উদ্দেশ্য হবে, তাহলে বই প্রকাশ না করে আপনি বরং এমএলএম কোম্পানি খুলতে পারেন। শুনেছি তাতে বেজায় লাভ।
এবার আসুন অশনি সংকেত কেন বলছি, কিঞ্চিত ব্যাখ্যা করি। তার আগে জানতে হবে সাহিত্য কী! কেনই বা! মহত্তম সাহিত্য সমাজ ও সময়ের দর্পণ। সময় বয়ে যায়, তার কতটুকুই বা আমরা স্মৃতিতে ধারণ করতে পারি! অথচ একজন সুসাহিত্যিক সেই ধারণ ও বহনের কাজটি করে থাকেন অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে। কয়েক হাজার বছর আগে গ্রিসে কী ঘটেছিল তা কিন্তু আমরা জানছি হোমারের ‘ইলিয়াড’ ও ‘ওডিসি’ পড়ে। মহামতি সক্রেটিস, প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল পড়ে আমরা শিখছি জীবনবোধ ও সময়কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কৌশল। কিন্তু হালের এই চিপস-চানাচুর টাইপ সাফল্যের টোটকা পড়ে কী হবে! এরা কি সমাজের ভেতরে প্রবহমান অন্তঃস্রোত সম্পর্কে জানে, বোঝে, নাকি ধারণ করতে পারে! বরং এদের গুঁতোয় যারা নিষ্ঠাবান সৃজনশীল লেখক, গবেষক ও কবি, তারা সৃষ্টিশীলতায় ক্রমশ আগ্রহ হারাচ্ছেন। কারণ আমপাঠক বা প্রকাশক কেউই তাদেরকে সঠিক মূল্যায়ন করছেন না। কালো টাকার ঠেলায় ভালো টাকা যেমন বাজার থেকে উৎখাত হয়, সুসাহিত্যের অবস্থাও হয়েছে এখন ঠিক তাই। ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা যাকে বলে।
প্রকাশক টাকা চান, কুলেখক রাতারাতি যশ বা নাম চান, আবার অবিবেচক পাঠক কিছু না বুঝেশুনে গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসান। এভাবে চলতে থাকলে অদূরভবিষ্যতে অমর একুশে বইমেলায় জ্ঞানের আকর বলে কিছু পাওয়া যাবে না, ধুলোবালি আর পুরোটাই ফেসবুক ও বিপণননির্ভর অর্বাচীন লেখক-প্রকাশকের দখলে চলে যাবে। আর জাতি হিসেবে আমরা পিছিয়ে পড়বো। তাই আমি মনে করি, এখনই রাশ টানা দরকার। পাণ্ডুলিপি প্রকাশের আগে তা যাচাই-বাছাই করতে হবে। বুয়ার হাতে লেখা বাজারের ফর্দ যেন বই হয়ে না বেরোয়। তবে মান নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বা অদৃশ্য হাতের কারসাজি নয় বরং সুবিবেচনা ও সুবুদ্ধির পরিচয় দিতে হবে, যাতে আবার সেই ‘ঠক বাছতে গাঁ উজারের’ মতো ব্যাপার না ঘটে।
এসইউ/জেআইএম