বইমেলায় নোবেলজয়ী কবি ভিসওয়াভা সিম্বোরস্কার অনুবাদ কবিতার বই
বাংলা একাডেমির অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়েছে পোল্যান্ডের নোবেলজয়ী কবি ভিসওয়াভা সিম্বোরস্কার অনুবাদ কবিতার বই ‘পাতাহীন বৃক্ষ অথবা কালো গাছ-কঙ্কাল’। বইটি অনুবাদ করেছেন পোল্যান্ডের ওয়ারশো বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মিহাউ পানাসুক এবং বাংলাদেশের কবি ও অনুবাদক অনন্ত উজ্জ্বল।
বইটির প্রচ্ছদ করেছেন মামুন হোসাইন, টাইপোগ্রাফি : আবিদ. এ. আজাদ। বইটি পাওয়া যাচ্ছে বাংলা একাডেমির অমর একুশে গ্রন্থমেলার বাতিঘর স্টলে [১২১-১২২] মূল্য : ২০০ টাকা।
সিম্বোরস্কার কবিতা সর্ম্পকে নিউইয়র্ক টাইমসে এডওয়াড হারচ বলেছেন, সিম্বোরস্কা তার কবিতায় সামগ্রিক চিন্তাভাবনার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আত্মবিশ্বাসের একটি মর্যাদাপূর্ণ বিদগ্ধ যুক্তি দৃঢ়ভাবে উপস্থাপন করেছেন। সম্ভবত তার কবিতা পৃথিবীকে রক্ষা করতে পারবে না। কিন্তু সিম্বোরস্কা কবিতা লেখার পরে এই পৃথিবীটা ঠিক আগের অবস্থায় থাকবে না। তিনি আমাদের শেখানোর চেষ্টা করেছেন, আমরা এই পৃথিবীর যে নাম দিয়েছি তাকে কীভাবে এবং কোন কৌশলে উপেক্ষা করা যায়।’
ভিসওয়াভা সিম্বোরস্কার কবিতা অস্তিত্ববাদ সম্পর্কে প্রশ্ন করে। এই বিষয়টি তার কবিতার ধরনের মধ্যে অন্যতম যার শ্রেণীকরণ ধার করা যায় না। সিম্বোরস্কা কোনো একটি বিষয়কে প্রাণপণে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে মানুষের অস্তিত্বের গভীরতম স্থানে নিয়ে যায়। যাকে ঘিরে আছে এখনকার ক্ষণস্থায়ী সময় এবং প্রতিদিনের জীবন। তিনি বর্তমানের কোনো অভিজ্ঞতা ও উপকরণকে যন্ত্রের মতো বুনন করে রাখেন। চারিত্রিকভাবে তার কবিতাগুলো সরল। সিম্বোরস্কার ব্যক্তিগত ভাষা ঠিক সমসাময়িক ভাষার মতো না। সিম্বোরস্কার কবিতায় চেতনা এবং সহানুভূতিগুলো প্রকাশিত হয় সামান্য ঘুরপাক খেয়ে। যার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় আধ্যাত্মিকতার আকর্ষণীয় সমন্বয়।
সিম্বোরস্কার কবিতা সবসময় প্রতিনিধিত্ব করে দ্ব›দ্বমূলক এক বিস্ময়কর ঘটনার, যা তার কবিতার পাঠককে চমকিয়ে দেয়। এই বুদ্ধিদীপ্ত, চুপচাপ অন্তর্মুখী প্রবণতা তার কবিতায় একটি বিশেষ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দাঁড় করিয়েছে। কবিতায় সিম্বোরস্কার সরল প্রকাশভঙ্গি পণ্ডিতদের জ্ঞানকে উপেক্ষা করে কবিতাগুলোকে করে তুলেছে নিখুঁত ও প্রাণবন্ত যা সহজে পঠিত হচ্ছে সমসাময়িক পাঠকের কাছে। সমালোচকদের সমালোচনা এবং গণমাধ্যমের সহযোগিতা ছাড়াই সিম্বোরস্কার কবিতা পাঠকের দোরগোড়ায় পৌঁছেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরই। ওই সময় এবং এর পরিবর্তে সিম্বোরস্কার কবিতার বই বিক্রির সংখ্যা ছিলো জনপ্রিয় উপন্যাসগুলোর সমান।
সিম্বোরস্কা কখনো কোনো কবিতা লেখা অথবা শিক্ষা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেননি। তিনি নিজেই তার লেখার নিজস্ব ভাষা ও শিল্পবোধ প্রকাশের কৌশল তৈরি করেছেন। সেখানে রয়েছে, মানুষের অস্তিত্বের জৈবিক ইতিহাস, কবির সামাজিক ভূমিকা এবং দার্শনিক মতাদর্শ, বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছকে বাঁধা সত্য, অভ্যাস ও সঙ্কোচ।
তিনি লিখেছেন, মানুষের জীবনের উজ্জ্বল সৌন্দর্যের সঙ্গে তীব্রতম গভীর সৌন্দর্যের অযৌক্তিতা এবং বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতার কথা। তার ভাষার মধ্যে রয়েছে সুবিবেচনাসম্পন্ন বিচার এবং মর্মস্পর্শী আবেগ। গীতধর্মী এই ভাষা পোল্যান্ডের তীব্র ঠান্ডা মধ্যে নিমজ্জিত-শান্ত, সতেজ ও বুদ্ধিদীপ্ত। এই ভাষা বুদ্ধিবৃত্তিক কঠোরতার বাইরে অনেক বেশি মানবিক। আপাতদৃষ্টিতে এই ভাষাটি স্ববিরোধী মনে হলেও দৃশ্যত সহজ, পরিশুদ্ধ এবং স্বতন্ত্র, যার অস্তিত্ব সংবেদনতায় ও সমবেদনায়।
ভিসওয়াভা সিম্বোরস্কা নোবেল বিজয়ী পোলিশ কবি। তিনি ১৯২৩ সালের ২ জুলাই পোল্যান্ডের পোজনান শহরের কাছাকাছি কোরনিক-এ এ্যানা মারিয়া নি রোটেরমান্ড এবং ভিনসেন্ট সিম্বোরস্কী দম্পতির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিলো ১৯৪৯ সালে। কিন্তু সমাজতন্ত্রীদের শর্ত পূরণ করতে না পারায় গ্রন্থটি প্রকাশের অনুমতি মেলেনি। যুদ্ধ-উত্তর পোল্যান্ডে অন্যান্য আরো অনেক সমাজতন্ত্রীদের মতো দলের দাপ্তরিক আদর্শ মেনে নিয়ে সিম্বোরস্কা গণপ্রজাতন্ত্রী পোল্যান্ডকে স্বাগত জানান। এরই ধারাবাহিকতায় ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫০ সালে রাজনৈতিক দলে যোগদানের জন্য আবেদনপত্র জমা দেন।
এরপর ১৯৫২ সালে ‘দ্যাটস হোয়াই উই আর এলাইভ’ নামে সিম্বোরস্কার প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয়। এই বছর বইটি ১১৪০ কপি বিক্রি হয়। বইটির এই বিশাল বিক্রির জন্য সিম্বোরস্কা পোলিশ রাইটার্স ইউনিয়নের (তখচ)-এর সদস্য হতে পেরেছিলেন খুব সহজে।
১৯৫৩ সালের মার্চ মাসে জোসেফ স্টালিনের মৃত্যুর পর "Życie Literackie" সাপ্তাহিক পত্রিকার একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এই সংখ্যায় সিম্বোরস্কার Ten dzień (This Day) নামের একটি কবিতা ছাপা হয়েছিল।
পরবর্তীকালে এই কবিতা এবং পত্রিকাটির বিশেষ সংখ্যা প্রকাশের জন্য স্বাধীন পোল্যান্ডে তিনি প্রচণ্ড আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছিলেন। সেই সময়ের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘আমি যা লিখেছি তা আমি আমার হৃদয় থেকে লিখেছি। এটা এমন কিছু ছিলো যা আজকের বাস্তবতায় বুঝতে পারা অসম্ভব ব্যাপার।’
দীর্ঘদিন ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত থাকার পর ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১ তারিখে ৮৮ বছর বয়সে পোল্যান্ডের ক্রাকোভ শহরে নিজ বাসভবনে ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় সিম্বোরস্কা মৃত্যুবরণ করেন।
তার মৃত্যুতে পোল্যান্ডের রাষ্ট্রপতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে বলেন, ‘সিম্বোরস্কা ছিলেন পোল্যান্ডের জাতীয় বিবেকের অভিভাবক। তার প্রাত্যহিক জীবনের ছোট ছোট ঘটনা ও কবিতায় রয়েছে বুদ্ধিদীপ্ত উপদেশ, যা বিশ্ববাসী ধীরে ধীরে অনুভব করবে।’
এসএইচএস/পিআর