ডিআইএ যুগ্ম-পরিচালকের কাণ্ড
অধ্যক্ষকে ফোন করে অশালীন কথাবার্তা, ‘গোপনে’ দেখা করার প্রস্তাব
‘আপনার বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ এসেছে, এখনো কিন্তু জমা নিইনি। সব তথ্যই আমার কাছে আছে…আপনার বাসা কি উত্তরায়? আসুন দুজনে বসে এক কাপ চা বা কফি খাই, কথা বলি।’
এভাবেই একটি সরকারি কলেজের অধ্যক্ষকে ফোন করে লিখিত অভিযোগ আছে জানিয়ে কৌশলে ঘুস লেনদেনের প্রস্তাব দেন শিক্ষা প্রশাসনের ‘দুদকখ্যাত’ পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) যুগ্ম-পরিচালক মো. আবুয়াল কায়সার।
শুধু তাই নয়, অভিযোগের নামে ফোনে অশালীন কথাবার্তা বলতেও শোনা যায় তাকে। তবে অধ্যক্ষের কাছে ‘পাত্তা না পেয়ে’ হুমকি-ধামকি দেন তিনি। কখনও ‘আইনের ভাষায় দেখে নেবো’ কখনও ডিবি দিয়ে হয়রানি; ‘ডিআইজি বন্ধু আছে, তাকে দিয়ে দেখে নেবো’ বলে হুমকি-ধামকি দেন আবুয়াল কায়সার।
জাগো নিউজের হাতে আসা একটি ফোনকলের ৬ মিনিট ৮ সেকেন্ডের রেকর্ডে এমন কথোপকথন শোনা যায়। ফোনের একপাশে টাঙ্গাইলের শহীদ ভবানী প্রসাদ সাহা সরকারি কলেজে (মির্জাপুর সরকারি কলেজ) অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. আব্দুল মান্নান। তাকে কল দেন আবুয়াল কায়সার। তিনি পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) যুগ্ম-পরিচালক বলে নিজেকে পরিচয়ও দেন।
অধ্যক্ষ আব্দুল মান্নান কথোপকথনটি তার সঙ্গে হয়েছে বলে জাগো নিউজকে নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, ১২-১৫ দিন আগে কলটি এসেছিল। তাকে হুমকি-ধামকি ও অনৈতিক সুবিধার জন্য গোপনে দেখা করতে বলা হয়েছিল। তিনি রাজি না হওয়ায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন ডিআইএর যুগ্ম-পরিচালক।
অন্যদিকে ডিআইএ’র যুগ্ম-পরিচালক আবুয়াল কায়সারের ভাষ্য, ‘ক্যাডার সার্ভিসের ক্ষেত্রে অনেক সময় অনেকে অপরাধ করলে তাকে ব্যক্তিগতভাবে ডেকে সতর্ক করে দেওয়া হয়। সেজন্যই তিনি কল করেছিলেন। কোনো অনৈতিক সুবিধা চাওয়ার জন্য নয়।’
আরও পড়ুন
- গ্রুপিং-দ্বন্দ্বে টালমাটাল ডিআইএ, ঘুস বাণিজ্যে ইমেজ সংকট
- অ্যাকাউন্টে ১৩৪ কোটি টাকা লেনদেনের ব্যাখ্যা দিলেন মুন্নী সাহা
- কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব ফরিদ উদ্দিনকে ওএসডি
- অনিয়মের তদন্ত করার সময় অভিযোগকারীকে মাদরাসা সুপারের মারধর
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিষয়টি খতিয়ে দেখবো। সত্যতা পেলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বর্তমান সরকার এসব বিষয়ে কঠোর। ঘুসবাণিজ্যে জড়ালে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’
অধ্যক্ষের সঙ্গে আবুয়াল কায়সারের কথোপকথন
অধ্যক্ষ আব্দুল মান্নান: হ্যালো…।
আবুয়াল কায়সার: এই আপনি কি প্রিন্সিপাল মান্নান সাহেব বলছেন?
অধ্যক্ষ: জ্বি জ্বি।
আবুয়াল কায়সার: ওহ আচ্ছা। আপনার নামে একটা অভিযোগ আছে।
(এরপর অধ্যক্ষের গোপনাঙ্গসহ সেক্সুয়াল বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অশ্লীল-অশ্রাব্য কথোকথন করেন আবুয়াল, যা গণমাধ্যমে প্রকাশযোগ্য নয়।)
অধ্যক্ষ: এগুলো কার… কাকে; কার কথা বলছেন?
আবুয়াল কায়সার: আপনি কি ছাত্রীর সঙ্গে এসব কথোপকথন করেছেন?
অধ্যক্ষ: না না, এগুলো আমার না। আমার মোবাইল, ফেসবুক হ্যাকড হয়েছিল। আর এসব এডিট করা। আপনি ভিডিওটা দেখেন, বুঝবেন।
আবুয়াল কায়সার: আপনি এসব কখনো করেননি? আপনার মোবাইল হ্যাকড হয়েছিল?
অধ্যক্ষ: না না। কখনই না।
আবুয়াল কায়সার: আপনার বাসা উত্তরা? আমার দপ্তরে একটা অভিযোগ এসেছে। আমরা এখনো অভিযোগটা নিইনি। যেহেতু আপনি… আপনি কত বিসিএস?
অধ্যক্ষ: আমি ফোরটিন (১৪তম বিসিএসে নিয়োগ পাওয়া)।
আবুয়াল কায়সার: আচ্ছা, আপনি এনসিটিবিতে (জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড) কতদিন চাকরি করেছেন?
অধ্যক্ষ: এনসিটিবিতে দুই ফেসে (মেয়াদ) প্রায় ১৩ বছর হবে।
আবুয়াল কায়সার: আসলে আপনি একজন বিসিএস ক্যাডার…এই মুহূর্তে প্রিন্সিপাল। আপনার বিরুদ্ধে যদি কোনো ষড়যন্ত্র হয়ে থাকে, সেটাও ভালো দেখায় না। আমি আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী বিধায় ফোনটা দিলাম। আপনি এ মুহূর্তে কি ঢাকায় আছেন?
অধ্যক্ষ: ঢাকায়, জ্বি ঢাকায়।
আবুয়াল কায়সার: আমরা কোথাও কি বসে চা খেতে পারি? আমার কাছে আপনার বিরুদ্ধে সব এভিডেন্স (প্রমাণ) আছে। আমাদের শিক্ষা সচিবের কাছে অভিযোগটা দেওয়ার জন্য এবং আমার দপ্তরেও দেওয়ার জন্য…অভিযোগটা আমার সাথে।
অধ্যক্ষ: আপনার পরিচয়টা একটু বলেন দাদা…আপনার পরিচয়টা..।
আবুয়াল কায়সার: আমি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে একটা দুদক আছে; শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে একটা পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর আছে। এখানকার কাজই হলো—দুর্নীতি আর এসব নারী কেলেঙ্কারি এগুলো তদন্ত করা।
অধ্যক্ষ: আপনার নামটা কি দাদা?
আবুয়াল কায়সার: আমি যুগ্ম-পরিচালক বলছি, জয়েন্ট ডাইরেক্টর।
অধ্যক্ষ: নামটা কি? হ্যালো…।
আবুয়াল কায়সার: আমার নাম শুনবেন? উত্তরায় এসে বলি? আমার ভিজিটিং কার্ড, আইডি কার্ড দেখাইয়া বলি। কোথায় আছেন এখন আপনি?
অধ্যক্ষ: না না সমস্যা নাই। আমি বাসায়ই আছি, ঢাকাতে।
আবুয়াল কায়সার: আপনি কোথায় আছেন এখন (উচ্চস্বরে)?
অধ্যক্ষ: আমি বাসায়ই আছি দাদা। অসুবিধা নাই। আপনি ডিআইএ আছেন তো? শিশির (ডিআইএর তৎকালীন পরিচালক) তো আমার ছোট ভাই।
আবুয়াল কায়সার: কে? শিশির? (কিছুটা নরম সুরে)। আচ্ছা, শিশির ছোট ভাই। আপনি কি জাহাঙ্গীরনগরের?
অধ্যক্ষ: জ্বি।
আবুয়াল কায়সার: ওহ আচ্ছা। তাহলে আপনি বলছেন যে, আপনার ছাত্রী ইন্টারমিডিয়েট পড়ে, তার সঙ্গে এসব চ্যাটিং, টকিং, ভিডিও, কারচুপি কথাবার্তা, দুই নম্বরি কথাবার্তা আপনি করেননি?
অধ্যক্ষ: না না না (উচ্চস্বরে)। এটা হলো হ্যাক হইছে। এটার জন্য তো আগেই জিডি করা আছে।
আবুয়াল কায়সার: মোবাইল হ্যাক হয়েছে?
অধ্যক্ষ: জ্বি জ্বি।
আবুয়াল: ওহ। কবে হ্যাক হয়েছে?
অধ্যক্ষ: ফেসবুক, মোবাইল হ্যাক বিষয়ে জিডি আগেই করা আছে।
আবুয়াল কায়সার: তার মানে আপনি তদন্তের অপেক্ষায় আছেন, তাই তো?
অধ্যক্ষ: আপনি যেভাবে বলছেন, তাতে তো সেটাই আসে।
আবুয়াল কায়সার: আমার কাছে লিখিত একটা অভিযোগ এসেছে।
অধ্যক্ষ: লিখিত কে দিয়েছে?
আবুয়াল কায়সার: লিখিত দিয়েছে যে অ্যাবিউজড, মানে যে নির্যাতিতা।
অধ্যক্ষ: নির্যাতিতা? সে কি অভিযোগ দিয়েছে?
আবুয়াল কায়সার: সেটা আপনাকে সব বলতে হবে (উচ্চস্বরে)? আমার একটাই কথা আপনার বিরুদ্ধে তাহলে কি ষড়যন্ত্র হচ্ছে কি না?
অধ্যক্ষ: জ্বি। আমি সেটাই বলছি। এটা নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে।
আবুয়াল কায়সার: আচ্ছা আচ্ছা। ষড়যন্ত্র হচ্ছে? কথাটা শুনে খুব ভালো লাগলো। এখন কথা হলো—আপনি যে কলেজে প্রিন্সিপাল…আপনি ওখানে চারতলায় একটা রুমে থাকেন?
অধ্যক্ষ: চারতলায় থাকি। আরও প্রিন্সিপালরা এখানে থাকতেন। আমি এখানে নতুন এসেছি। ওনারা আমাকে এখানে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
আবুয়াল কায়সার: আপনি ওখানে ডিগ্রির কোনো মেয়েকে নিয়ে, ইন্টারমিডিয়েটের কোনো মেয়েকে নিয়ে থাকেন। সব তথ্যই তো আমাদের কাছে আসে।
অধ্যক্ষ: না না না। এ তথ্য টোটালটাই মিথ্যা। টোটালটাই মিথ্যা, টোটালটাই মিথ্যা (উত্তেজিত হয়ে উচ্চস্বরে)। আমি ওখানে, আমি ওখানে..।
আবুয়াল কায়সার: আপনি চ্যালেঞ্জ করছেন তো? আইনের ভাষায় আমি কথা বলবো। ওকে।
অধ্যক্ষ: না না আপনার সঙ্গে তো আমি কথা ফ্রি-লি বলতেছি। এটা তো চ্যালেঞ্জের বিষয় নয়। আপনি প্রশ্ন করছেন, আমি উত্তর দিচ্ছি।
আবুয়াল কায়সার: আপনি কার সঙ্গে চ্যালেঞ্জ করেছেন, আপনি জানেন না। আমি এক্ষুনি ফোন দিচ্ছি ডিবিকে। ডিআইজি আমার বন্ধু। আপনাকে দেখে নেওয়া হবে।
জানতে চাইলে শহীদ ভবানী প্রসাদ সাহা সরকারি কলেজের (মির্জাপুর সরকারি কলেজ) অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. আব্দুল মান্নান জাগো নিউজকে বলেন, ‘উনি আমাকে ফোন দিয়েছিলেন। অফিস টাইমেও না… সেটা রাতে। বুঝলাম না, কেন উনি আমাকে ফোন দিলেন? ওনার কাছে অভিযোগ গেলে তদন্ত করবেন। তা না করে উনি ভয়ভীতি দেখালেন, দেখা করতে বললেন। আমি কোনো সাড়া দেইনি।’
ডিআইএ কর্মকর্তা দেখা করতে কেন বলেছিলেন? এর মাধ্যমে কি আপনি ঘুস চাওয়ার ইঙ্গিত মনে করছেন—প্রশ্নে অধ্যক্ষ বলেন, ‘হ্যাঁ অবশ্যই। উনি অনৈতিক সুবিধার জন্যই চা খাওয়ার, কফি খাওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছেন। এটা তো স্পষ্ট। উনি ২২ বিসিএসের, আমি ১৪তম বিসিএসের। ওনার চেয়ে ৮ ব্যাচ সিনিয়র। তারপরও উনি যাচ্ছেতাইভাবে কথা বলেছেন। এটা অনাকাঙ্ক্ষিত।’
অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে যুগ্ম-পরিচালক আবুয়াল কায়সার জাগো নিউজকে বলেন, ‘ক্যাডার সার্ভিসের কেউ হলে তাকে ডেকে হয়তো সতর্ক করা হয়। বাইরে নয়, আমার অফিসে ডেকেছিলাম। যত মামলাই হোক, যদি সালিশ বা দুই পক্ষকে সমাধান করে দেওয়া যায়, তাহলে সেটা তো খারাপ নয়।’
কেউ অপরাধ করলে তার শাস্তি হওয়া উচিত। সেখানে এটি ছাত্রী নিপীড়নের ঘটনা। অথচ আপনি মীমাংসা করে দিচ্ছেন। এতে কি নিয়মের ব্যত্যয় ঘটছে না—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘উনি একজন সিনিয়র পারসন। সম্মানীয় প্রিন্সিপাল। সেক্ষেত্রে ওনাকে বিষয়টি মীমাংসা করে দেওয়াতে সমস্যা নেই।’
আবুয়াল কায়সারের বিরুদ্ধে আরও যত অভিযোগ
শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর ডিআইএকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ঘুস-দুর্নীতিমুক্ত করার চেষ্টা করলেও তা সম্ভব হয়নি। বরং ফাইল আটকে রেখে অনৈতিক সুবিধা আদায়সহ বিভিন্ন অভিযোগ ওঠে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে গিয়ে ঘুস চেয়ে গণপিটুনি খাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
সম্প্রতি ২৬৯টি ফাইল অনৈতিকভাবে আটকে রাখায় ডিআইএর যুগ্ম-পরিচালক আবুয়াল কায়সারকে কারণ দর্শানোর নোটিশও দেওয়া হয়। তাছাড়া ডিআইএ’র পরিচালক কাজী মো. আবু কাইয়ুম শিশিরের সঙ্গে নানান বিষয় নিয়ে টানাপোড়েন দেখা দেয়। এতে অধিদপ্তরের কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দেয়।
যুগ্ম-পরিচালকের সঙ্গে দ্বন্দ্বের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিআইএ’র পরিচালক পদ থেকে সদ্য বদলি হওয়া অধ্যাপক কাজী মো. আবু কাইয়ুম জাগো নিউজকে বলেন, মানসিক দূরত্ব থেকে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। এ নিয়ে যুগ্ম-পরিচালকের সঙ্গে আমার দুবার বৈঠকও হয়েছে। বৈঠকে ভুল বোঝাবুঝির অবসান হয়েছিল। যেহেতু আমাকে এখন বদলি করা হয়েছে, সেজন্য আমি ডিআইএ নিয়ে আর কিছু বলতে চাই না।
ফাইল আটকে রাখাসহ অন্য অভিযোগের বিষয়ে আবুয়াল কায়সার জাগো নিউজকে বলেন, ‘অফিসিয়াল বিষয়ে আমাদের মিডিয়ায় মন্তব্য করার ক্ষেত্রে নিষেধ আছে। এ নিয়ে আমি কিছু বলতে চাইছি না।’
এএএইচ/ইএ/জেআইএম