৫০ কোটি টাকার নৈপুণ্য অ্যাপের ভবিষ্যৎ কী?
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রণীত নতুন শিক্ষাক্রম চরম সমালোচনার মুখে পড়ে। মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে ছিল বড় অসন্তোষ। পরে মূল্যায়ন প্রক্রিয়া সহজ ও শিক্ষকদের পক্ষপাত এড়াতে তৈরি করা হয় ‘নৈপুণ্য অ্যাপ’। অ্যাপটি তৈরি, ব্যবহার, রক্ষণাবেক্ষণ মিলিয়ে এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে প্রায় ৫০ কোটি টাকা। এ তথ্য জানিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর নতুন সেই শিক্ষাক্রম বাতিল করেছে। পরিবর্তন এসেছে শিক্ষার্থী মূল্যায়নেও। আগের মতোই ফিরছে পরীক্ষা। বাতিল হয়েছে শিখনকালীন, ষান্মাসিক ও বার্ষিক সামষ্টিক মূল্যায়ন পদ্ধতি। এতে কার্যকারিতা হারিয়েছে আলোচিত নৈপুণ্য অ্যাপ। ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি করা অ্যাপটি এখন কী অবস্থায় আছে, এর ভবিষ্যৎ কী? পড়ে থাকবে নাকি ইতিবাচক কাজে লাগানো হবে? সেখানে থাকা প্রায় এক কোটি শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবকের তথ্য-উপাত্ত কতটা নিরাপদে অছে— এসব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা।
এনসিটিবি বলছে, অ্যাপটি এখন সক্রিয় নয়। যারা (এটুআই) এটি তৈরি করেছেন, তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। অন্যদিকে অ্যাপটি তৈরি করা এটুআই প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানান, নৈপুণ্য অ্যাপের ভবিষ্যৎ কী, তা তারা জানেন না। এনসিটিবি অ্যাপটি কাজে লাগাতে চাইলে তারা সেভাবে ব্যবস্থা নেবেন। না হলে হয়তো মুছে ফেলা হবে।
অ্যাপটি এখন বেকার পড়ে আছে এটা ঠিক। তবে এখান থেকে তথ্য-উপাত্ত বেহাত বা চুরি হওয়ার সুযোগ নেই। আমরা অ্যাপটি সব সময় নার্সিং করছি। শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ভয়ের কোনো কারণ নেই।-এটুআই প্রকল্পের এডুকেশন এক্সপার্ট মো. সাজ্জাদ হোসেন খান
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) নির্দেশনায় অ্যাপটি তৈরি করেছিল এটুআই। এতে সহায়তা দিয়েছিল ইউনেস্কো। ২০২৩ সালের ৪ নভেম্বর অ্যাপটি উন্মুক্ত করা হয়। সেই উন্মুক্তকরণ অনুষ্ঠানও ছিল ব্যাপক জাঁকজমকপূর্ণ। রাজধানীর একটি পাঁচ তারকা হোটেলে অর্ধকোটি টাকা খরচ করে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তাতে শিক্ষাবিদ, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবক, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকসহ অন্তত ৫০০ জনকে অতিথি করা হয়, যা নিয়ে তখন তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবি।
নৈপুণ্য অ্যাপের কাজ কী ছিল?
নতুন শিক্ষাক্রমে পরীক্ষা ছিল না। শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে সবকিছু শেখানো হতো। প্রতিদিনের কাজে একজন শিক্ষার্থী কতটা নৈপুণ্য দেখাতে পারছে, তা অ্যাপে থাকা বিভিন্ন নির্দেশকে ক্লিক করে সংরক্ষণ করা যেত। আবার ছয়মাস পর যে ষান্মাসিক মূল্যায়ন হতো, সেখানেও শিক্ষার্থীর পারদর্শিতার সূচকগুলো কিছু অপশনে ক্লিক করে সংরক্ষণ করতে পারতেন শিক্ষকরা। বার্ষিক সামষ্টিক মূল্যায়নেও একইভাবে শিক্ষার্থীর পারদর্শিতা সেখানে ইনপুট দিলে সারা বছর একজন শিক্ষার্থীর অ্যাক্টিভিটি অনুযায়ী একটি রিপোর্ট কার্ড দেওয়া হতো। সেটি অনুযায়ী পরবর্তী ক্লাসে উঠতো শিক্ষার্থী।
অ্যাপটিতে যদি এক কোটি মানুষের ডাটা থাকে, তাহলে বলতে হবে সেটি বিশাল তথ্য-উপাত্তের ভাণ্ডার। এমন প্ল্যাটফর্ম নিষ্ক্রিয় রাখা ঝুঁকিপূর্ণ। শিগগির এটি নিয়ে ভাবা উচিত।-সাইবার বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির
তাছাড়া ষষ্ঠ ও অষ্টম শ্রেণিতে শিক্ষার্থীর যে রেজিস্ট্রেশন করা হয়, তা অ্যাপের মাধ্যমে সম্পন্ন হতো। অ্যাপে শিক্ষকদের অংশে সংরক্ষণ করা হতো শিক্ষক নির্দেশিকা। সেখান থেকে শিক্ষকরা সেগুলো দেখে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাতে পারতেন। তাছাড়া পরীক্ষার আগে কেন্দ্রীয়ভাবে এনসিটিবি থেকে প্রশ্নপত্র তৈরি করে সেখানে দেওয়া হতো। ফলে সারাদেশে একই প্রশ্নপত্রে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের সুযোগ তৈরি হয়েছিল।
- আরও পড়ুন
- নৈপুণ্য অ্যাপের ‘মারপ্যাঁচে’ আটকা সাড়ে ৫ হাজার ছাত্রীর ফল
- নৈপুণ্য অ্যাপে নতুন শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশন-প্রমোশনের নির্দেশ
- ষাণ্মাসিক মূল্যায়নের প্রশ্নফাঁস হলে আইনি ব্যবস্থা: এনসিটিবি
অ্যাপটি তৈরির শুরু থেকে নির্দেশনা দিয়েছিলেন এনসিটিবির তৎকালীন সদস্য অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান। এখন তিনি অবসরে। মশিউজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘অ্যাপটি নিঃসন্দেহে ভালো ছিল। তবে প্রথমদিকে ব্যবহার নিয়ে কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। সেগুলো ধীরে ধীরে সমাধান করা হচ্ছিল।’
কতটা ব্যবহার হয়েছে নৈপুণ্য অ্যাপ
২০২৩ সালের শেষ দিকে নৈপুণ্য অ্যাপটি চালু করা হয়। ওই বছর ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে পরীক্ষামূলকভাবে নতুন শিক্ষাক্রম চালু করা হয়। তবে অ্যাপটি ব্যবহার করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছিলেন শিক্ষকরা। তারা তথ্য ইনপুট দিতে পারছিলেন না। ফলে অধিকাংশ শিক্ষার্থীর রিপোর্ট কার্ড ম্যানুয়ালি বা হাতে তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল। পরে অ্যাপটি আরও সহজ ও উন্নত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
চলতি বছর অর্থাৎ, ২০২৪ সালে ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়। বছরের শুরু থেকে শিক্ষার্থীদের শিখনকালীন মূল্যায়ন অ্যাপটিতে ইনপুট দেওয়া হয়। ষান্মাসিক মূল্যায়নেও ব্যবহার করা হয়। তবে ষান্মাসিক মূল্যায়নে চার বিষয়ের মূল্যায়ন নেওয়ার পরই কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। সেই পরীক্ষাগুলো আর নেওয়া হয়নি। ফলে অ্যাপের ব্যবহারও তখন থেকে স্থগিত।
এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক ড. রিয়াদ চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘অ্যাপটি খারাপ নাকি ভালো সে প্রশ্নে যাবো না। কতটুকু ব্যবহার হয়েছে, তাও বিশ্লেষণ করতে যাওয়া বোকামি হবে। ভবিষ্যতে এটা নিয়ে কাজ হবে কি না, তা সরকার নির্ধারণ করবে।’
নৈপুণ্য অ্যাপ এখন কার নিয়ন্ত্রণে?
নৈপুণ্য অ্যাপে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির ৫০ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থীর তথ্য-উপাত্ত রয়েছে। তাদের নাম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তথ্য, জন্ম নিবন্ধনের নম্বর, অভিভাবকের নাম, এনআইডি নম্বর, মোবাইল নম্বর অ্যাপটিতে ইনপুট দেওয়া হয়। পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয়ের প্রায় ৫ লাখ শিক্ষকের ব্যক্তিগত তথ্য ও পেশাগত তথ্য রয়েছে। ফলে সচেতন শিক্ষক ও অভিভাবকরা জানতে চান, অ্যাপটি এখন কার নিয়ন্ত্রণে? তাদের তথ্য-উপাত্ত চুরির আশঙ্কা আছে কি না?
রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বনশ্রী শাখার শিক্ষক সহিদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘অ্যাপে রেজিস্ট্রেশনের জন্য অনেক তথ্য দিতে হয়েছিল। সেখানে আমাদের শিক্ষকদের ব্যক্তিগত তথ্যও রয়েছে। এখন অ্যাপটি ক্রাশ (একেবারে মুছে) করে ফেলা হবে নাকি এটি আপডেট করা হবে, তা জানানো উচিত।’
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রীর মা জোহরা খাতুন জাগো নিউজকে বলেন, ‘রিপোর্ট কার্ড নিতে ও রেজিস্ট্রেশনের জন্য তখন মেয়ের তথ্যের সঙ্গে আমার তথ্যও দিয়েছিলাম। মোবাইল নম্বর, এনআইডি নম্বর, পাসপোর্ট নম্বর, বাসার ঠিকানা—এসব তথ্য রয়েছে। অ্যাপ যদি না থাকে, তাহলে তথ্যগুলো কেউ যে অপকর্ম করতে ব্যবহার করবে না, সে নিশ্চয়তা কোথায়?’
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রিয়াজুল হাসান চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘নৈপুণ্য অ্যাপ এখন স্থগিত। ওটা কোনো কাজে আসছে না। অ্যাপটি যারা তৈরি করেছিলেন, নিয়ন্ত্রণটাও তাদের কাছে। আশা করি, সেখানে থাকা তথ্য-উপাত্ত চুরি বা হ্যাকড হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ যারা এটি পরিচালনা করছেন, নিশ্চয়ই তারা দায়িত্বশীল।’
অ্যাপটি তৈরি করেছিল এটুআই। এ প্রকল্পের এডুকেশন এক্সপার্ট মো. সাজ্জাদ হোসেন খান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘অ্যাপটি এখন বেকার পড়ে আছে এটা ঠিক। তবে এখান থেকে তথ্য-উপাত্ত বেহাত বা চুরি হওয়ার সুযোগ নেই। আমরা অ্যাপটি সব সময় নার্সিং করছি। শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ভয়ের কোনো কারণ নেই।’
তিনি বলেন, ‘যে শিক্ষাক্রমই চালু থাক না কেন চাইলে অ্যাপটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহার করা যাবে। শিক্ষার্থীদের সারা জীবনের সব অ্যাকাডেমিক অ্যাক্টিভিটি এখানে সংরক্ষিত থাকলে তা ব্যবহার করে ভালো গবেষণা করা যেতে পারে। কোন শিক্ষার্থীর কোন দিকে ঝোঁক বেশি বা পারদর্শী, তা সহজেই বের করা যাবে। এখানে প্রশ্নব্যাংক নিরাপদে রাখা সম্ভব। কাজে লাগালে এটির অনেক ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। এটি নির্ভর করবে সরকার; বিশেষ করে এনসিটিবি কী ভাবছে তার ওপর।’
নিষ্ক্রিয় যে কোনো অ্যাপ থেকে তথ্য-উপাত্ত চুরির আশঙ্কা বেশি বলে মনে করেন সাইবার বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘অ্যাপটিতে যদি এক কোটি মানুষের ডাটা থাকে, তাহলে বলতে হবে সেটি বিশাল তথ্য-উপাত্তের ভাণ্ডার। এমন প্ল্যাটফর্ম নিষ্ক্রিয় রাখা ঝুঁকিপূর্ণ। শিগগির এটি নিয়ে ভাবা উচিত। হয় চলমান রাখতে হবে, অথবা ভিন্ন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে। আমি সব সময় এমন তথ্য ভাণ্ডারকে চালু রেখে ইতিবাচক ধারায় এগিয়ে নেওয়ার পক্ষে।’
এএএইচ/এএসএ/জিকেএস