পিএসসিতে নিয়োগ পরীক্ষা-ফল প্রকাশে ভাটা, পদোন্নতিতে তোড়জোড়
এক যুগে বিসিএসসহ ৩০টি গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে টালমাটাল সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। দীর্ঘদিন ধরে চলা এ অনিয়ম তদন্তে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রশ্নফাঁস চক্র ধরতে কাজ করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগও (সিআইডি)। অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটিও করে পিএসসি। এরমধ্যে সরকার পতনের পর তিনটি বিসিএসের পরীক্ষা, ফল তৈরির কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। বন্ধ রয়েছে নন-ক্যাডারসহ বিভাগীয় পদোন্নতির বহু পরীক্ষাও।
স্থগিত পরীক্ষাগুলো দ্রুত শুরু করা, ফলাফল প্রকাশসহ বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে প্রতি কর্মদিবসেই পিএসসির সামনে বিক্ষোভ করছেন চাকরিপ্রার্থীরা। তাদের বিক্ষোভের মুখে পিএসসির চেয়ারম্যানসহ সদস্যদের পেছনের ফটক দিয়ে অনেকটা পালিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে হররোজ।
পিএসসি সূত্র জানায়, সার্বিক পরিস্থিতিতে পিএসসি যখন স্থবির, ঠিক তখন ঢালাও পদোন্নতি দিতে নিয়োগবিধি প্রণয়নে ব্যস্ত সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা। সেখানে নবম গ্রেড থেকে ৫০-৭০ শতাংশ পদোন্নতির বিধান রাখা হচ্ছে। এমন বিধান রেখে করা নিয়োগবিধিকে ‘নিয়মবর্হিভূত ও নজিরবিহীন’ বলে উল্লেখ করেছেন খোদ প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
স্থগিত বহু পরীক্ষা, আটকে আছে ফলাফল
কোটা সংস্কার আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নিলে গত ১৮ জুলাই থেকে বিসিএসসহ নিয়োগ পরীক্ষাগুলো স্থগিত করতে শুরু করে পিএসসি। ৪৪তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা চলছিল। সেটা এখন স্থগিত। ৪৬তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষাও স্থগিত রয়েছে। ৪৫তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা শেষ হলেও খাতা মূল্যায়নসহ অন্যান্য কাজ থমকে আছে।
তাছাড়া বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষা, চাকরিরতদের বিভাগীয় পদোন্নতির পরীক্ষাগুলোও স্থগিত করেছে পিএসসি। সবশেষ গত ১৪ সেপ্টেম্বর পরীক্ষা শুরুর একদিন আগের রাতে বিসিএস ক্যাডার ও নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের প্রথম অর্ধবার্ষিকী বিভাগীয় পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করা হয়। একইসঙ্গে জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের ‘ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (দশম গ্রেড)’ পদের ব্যবহারিক পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়। এতে ক্ষতির মুখে পড়েছেন প্রশাসনে চাকরিরত বিভিন্ন ক্যাডারের কয়েক হাজার কর্মকর্তা।
এদিকে, অনেক নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফলও আটকে গেছে। কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে জুনিয়র ইন্সট্রাক্টরের প্রায় এক হাজার পদে দীর্ঘদিন আগে পরীক্ষা শেষ হলেও ফল প্রকাশ করা হয়নি। কয়েকমাস ধরে প্রার্থীরা অনশনসহ আন্দোলন করে আসছেন। তাতেও সাড়া মিলছে না। আটকে আছে নার্সিং-মিডওয়াইফারি নিয়োগের পরীক্ষার ফলও।
নিয়োগ পরীক্ষা-ফল প্রকাশ ছেড়ে পদোন্নতিতে নজর!
প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ ওঠার পর তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে পিএসসি। কয়েকজন কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত, তদন্ত কমিটি গঠন করে প্রাথমিক ধাক্কা সামলে ওঠার চেষ্টা করেন চেয়ারম্যানসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা। তবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার পতনের পর এখন নড়বড়ে পিএসসির প্রশাসনিক কাঠামো। বেশিরভাগ সদস্য অফিস করছেন না। পিএসসির চেইন অব কমান্ডের এ দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছেন দুর্নীতিবাজ ও সুযোগসন্ধানীরা। তারা নিয়মবর্হিভূত পদোন্নতি বাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় মেতে উঠেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৮ সালে চাকরিতে যোগদান করা সাতজন সহকারী পরিচালককে ‘বঞ্চিত’ দেখিয়ে পদোন্নতি দিতে বিশেষ একটি পক্ষ তোড়জোড় শুরু করেছে। ২০১৩ সাল থেকে তাদের ভূতাপেক্ষভাবে উপ-পরিচালক পদে পদোন্নতির প্রক্রিয়াও প্রায় চূড়ান্ত। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান পিএসসিতে এ ধরনের পদোন্নতি ‘নজিরবিহীন’ বলে অভিযোগ করেছেন কর্মকর্তারা।
পিএসসির কয়েকজন কর্মকর্তা অভিযোগ করেছেন, বিগত বছরগুলোতে নিম্নপদ থেকে নবম গ্রেডে পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তারা প্রশ্নফাঁসসহ বিভিন্ন অনিয়ম করেছেন। সেগুলো বিভিন্ন সময়ে করা তদন্তে প্রমাণও মিলেছে। গ্রেফতার ও শাস্তি পাওয়ার পরও তাদের ৫৫-৭০ শতাংশ পদোন্নতির সুযোগ রেখে একটা খসড়া বিধিমালা প্রস্তাব করেছে কমিশন। বর্তমানে সরাসরি নিয়োগযোগ্য ১৮টি সহকারী পরিচালক পদ খালি থাকলেও বিগত বিসিএসগুলো থেকে সেখানে নিয়োগ দেয়নি পিএসসি। হঠাৎ নবম গ্রেড থেকে সেখানে নিয়োগের পাঁয়তারা শুরু করেছে একটি পক্ষ, যাতে পিএসসিতে দুর্নীতি-অনিয়ম আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রশ্নফাঁসের ‘দায়সারা’ তদন্ত, ক্ষুব্ধ চাকরিপ্রার্থীরা
জুলাইয়ে বেসরকারি একটি টেলিভিশনে পিএসসির প্রশ্নফাঁস নিয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রচার করা হয়। সিআইডি প্রশ্নফাঁসে জড়িত কয়েকটি চক্রকে চিহ্নিত করে তাদের গ্রেফতারে অভিযানে নামে। সাবেক ও বর্তমান বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতারও করা হয়। তাদের সাময়িক বহিষ্কার করে পিএসসিও। ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে প্রতিষ্ঠানটি।
পিএসসির গঠিত তদন্ত কমিটি যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, তাতে তারা দাবি করেছেন—প্রশ্নফাঁসের কোনো প্রমাণই তারা পাননি। ফলে কোনো পরীক্ষা বাতিলের প্রয়োজন নেই বলেও সেখানে সুপারিশ করেছেন।
পিএসসির গঠিত তদন্ত কমিটিতে প্রধান ছিলেন যুগ্মসচিব ড. আব্দুল আলীম খান। সদস্য পরিচালক দিলাওয়েজ দুরদানা। সদস্যসচিব হিসেবে কাজ করেছেন মোহাম্মদ আজিজুল হক। গত ৯ সেপ্টেম্বর তারা পিএসসি চেয়ারম্যানের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন।
তদন্ত কমিটির প্রধান ড. আব্দুল আলীম খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘তদন্তে প্রশ্নফাঁসের কোনো ঘটনা আমরা পাইনি। প্রতিবেদনে সেগুলো বিস্তারিত উল্লেখ করে চেয়ারম্যানের কাছে জমা দিয়েছি। সেখানে কিছু সুপারিশও রয়েছে।’
এদিকে, পিএসসির এমন দায়সারা তদন্ত ও প্রতিবেদনের তীব্র বিরোধিতা করেছে সিআইডি। সংস্থাটি বলছে, পিএসসির গ্রেফতার কর্মকর্তারা দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। সেগুলোও তদন্ত কমিটি আমলে নেয়নি। তারা দায় এড়াতে কোনোরকম তদন্ত করেই মনগড়া প্রতিবেদন তৈরি করেছেন বলে অভিযোগ সিআইডি কর্মকর্তাদের।
সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এএসপি) জুয়েল চাকমা বলেন, ‘পিএসসির গঠিত তদন্ত কমিটি আমাদের কোনো বক্তব্য নেয়নি। কোনো বিষয়ে তথ্যও চায়নি। গত ৫ সেপ্টেম্বর আমরা একটি চিঠি পাই। ওইদিনই আমাদের বক্তব্যের জন্য যেতে বলা হয়। সেদিন আদালতে আমাদের মামলার তারিখ থাকায় যেতে পারিনি। বিষয়টি পিএসসিকে জানানোও হয়।’
তিনি বলেন, ‘এরপরে পিএসসি আর আমাদের বক্তব্য নেয়নি, নেওয়ার চেষ্টাও করেনি। পিএসসির কেউ আমাদের একটি টেলিফোন কলও করেননি। আমাদের কাছে প্রশ্নফাঁসের অনেক তথ্য-প্রমাণ রয়েছে, যা আমরা তাদেরকে দিতে পারিনি। তার আগেই প্রতিবেদন জমা হয়ে গেছে।’
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে পিএসসির সচিব আবদুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী কোনো মন্তব্য করতে চাননি। তিনি চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। পরে চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইনের সঙ্গে কয়েক দফা যোগাযোগ করা হলে তিনি কল রিসিভ করেননি।
এএএইচ/এসআর