দুঃসময় পার করছে শিক্ষার্থীরা, শিক্ষকরা স্বার্থের ‘দেনদরবারে’

আল-আমিন হাসান আদিব
আল-আমিন হাসান আদিব আল-আমিন হাসান আদিব , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:৪৯ পিএম, ২৯ জুলাই ২০২৪
ভিন্ন দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট সহিংসতায় এখন পর্যন্ত নিহত ১৫০ জন (সরকারি হিসাব)। এর মধ্যে অনেকেই শিক্ষার্থী। গুলিবিদ্ধ হয়ে অনেক শিক্ষার্থী কাতরাচ্ছেন হাসপাতালের বিছানায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ অনির্দিষ্টকালের জন্য। কবে ফিরবে ক্যাম্পাসে শিক্ষার পরিবেশ, কবে খুলবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান- তা জানে না কেউ। আন্দোলনে জড়িয়ে নিজেদের নিরাপত্তা শঙ্কা তো আছেই।

শিক্ষার্থীরা যখন চরম দুঃসময় পার করছেন, ঠিক তখন নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে ‘দেনদরবারে’ বসেছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা। গত ১ জুলাই থেকে সর্বজনীন পেনশনের প্রত্যয় স্কিম বাতিলের দাবিতে তারা সর্বাত্মক কর্মবিরতি করে আসছেন। ১৫ জুলাই পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচিও করেন। কোটা সংস্কার আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নিলে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণার পর সশরীরে কোনো কর্মসূচি করছেন না শিক্ষকরা।

শিক্ষাবিদ ও অভিভাবকরা বলছেন, শিক্ষকদের উচিত ছিল এ দুঃসময়ে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানো। আহত শিক্ষার্থীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার দাবি নিয়ে সরকারের কাছে যাওয়া। গণগ্রেফতার অভিযানে শিক্ষার্থীদের যাতে হয়রানি না করা হয়, সেদিকে নজর দেওয়াও উচিত ছিল। প্রয়োজন ছিল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার পরিবেশ ফেরাতে তৎপর হওয়া। অথচ সেই সময়ে তারা নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন, যা অনাকাঙ্ক্ষিত এবং দুঃখজনক।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সর্বজনীন পেনশনের প্রত্যয় স্কিমে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করার প্রতিবাদে জুন মাসের মাঝামাঝি থেকেই বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছেন দেশের ৩৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। সবশেষ গত ১ জুলাই থেকে তারা সর্বাত্মক কর্মবিরতি ও অবস্থান কর্মসূচি করছেন। মাঝে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গেও বৈঠক করেন। তাতে দাবি পূরণে আশ্বাস না পাওয়ায় কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। তবে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে চলমান পরিস্থিতিতে তাদের আন্দোলন চাপা পড়ে যায়।

আরও পড়ুন

রোববার (২৮ জুলাই) রাতে হঠাৎ গণমাধ্যমকে জানানো হয়, সোমবার (২৯ জুলাই) সচিবালয়ে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর সঙ্গে পেনশন স্কিমে শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত না করার দাবি নিয়ে বৈঠকে বসবেন। এরপর থেকে বিষয়টি নিয়ে অনেক শিক্ষাবিদ ও অভিভাবক সমালোচনা শুরু করেন। তবে পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী—সোমবার বিকেল সাড়ে ৪টায় সচিবালয়ে শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সঙ্গে বৈঠকে বসে শিক্ষকদের প্রতিনিধিদল।

অবশ্যই ছাত্র-ছাত্রীদের দুর্দিনে শিক্ষকদের পাশে থাকা উচিত। দেশ স্বাধীনের আগে থেকেই শিক্ষকরা যৌক্তিক দাবিতে শিক্ষার্থীদের যেসব আন্দোলন তাতে একাত্মতা জানাতেন। এ রেওয়াজ ছিল। আমার মনে হয়, সেই জায়গা থেকে আমরা সরে এসেছি।-ইমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন দৃশ্যমান হয় গত ১ জুলাই। ১৫ জুলাইয়ের পর এ আন্দোলন ঘিরে সহিংসতা সৃষ্টি হয়। এতে এ পর্যন্ত সরকারি হিসাবে ১৫০ জন নিহত হয়েছেন। যার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ এবং স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীও রয়েছেন। সারাদেশে আহত হয়েছেন কয়েক হাজার শিক্ষার্থী। তাদের অনেকে শরীরে ক্ষত নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। অনেকের পরিবার চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে বলেও গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হচ্ছে। এ অবস্থা জেনেও চুপ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা।

আন্দোলনে জড়িয়ে অনেক শিক্ষার্থী নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। হল বা ক্যাম্পাসে ফিরতে পারা তারা ভয়ে আছেন। হঠাৎ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হওয়ায় ঢাকায় থাকার জায়গা নিয়েও সংকটে পড়েন অনেক শিক্ষার্থী। টিউশনি কিংবা খণ্ডকালীন কাজের স্বার্থে তাদের বাড়ি ফেরাও সম্ভব হয়নি। কাজ হারানোর শঙ্কায় অনেকে। এর মধ্যে রয়েছে ধরপাকড়ের ভয়। বন্ধু-বান্ধবের কাছে মেসে আশ্রয় নিয়েও স্বস্তিতে নেই তারা। আন্দোলনে জড়িত সন্দেহে বিভিন্ন হোস্টেলে রেড দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

দুঃসময় পার করছে শিক্ষার্থীরা, শিক্ষকরা স্বার্থের ‘দেনদরবারে’

অনেকের অনার্স বা মাস্টার্স শেষ বর্ষের পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল জুলাই মাসেই। তারাও আছেন নানান টানাপোড়েনে। অথচ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনা কিংবা বিপদে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায়নি অধিকাংশ শিক্ষককে। যদিও নিপীড়নবিরোধী শিক্ষকের ব্যানারে কিছু শিক্ষক সভা-সমাবেশ করছেন।

আরও পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের একজন ছাত্রীর অভিভাবক মো. সিরাজুল ইসলাম। পেশায় তিনি একজন ব্যবসায়ী। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের যে বৈশিষ্ট্য তাতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। আমি নিজেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। তখন শিক্ষকরা যেভাবে আমাদের পাশে দাঁড়াতেন, এখনকার শিক্ষকরা তা থেকে অনেক পিছিয়ে।’

সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘সবার আগে শিক্ষকদের উচিত ছিল আহত ছাত্র-ছাত্রীদের খোঁজ-খবর নেওয়া। সরকারের কাছে তাদের সুচিকিৎসা নিশ্চিতের দাবি করা। দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার জন্য কাজ করা উচিত ছিল। তা না করে এ মুহূর্তে তারা সরকারের মন্ত্রীদের সঙ্গে নিজেদের অবসরকালীন পেনশনের টাকা কত পাবেন, না পাবেন তা নিয়ে বসেছেন। এটা লজ্জাজনক।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের এক ছাত্রের মা আলীমুন্নেছা। তিনি সাভারের রেডিও কলোনিতে থাকেন। তার ছেলে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। গত কয়েকদিন রাতে সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তার বাসায় গেছেন অজ্ঞাত ব্যক্তিরা। বিষয়টি জানিয়ে আলীমুন্নেছা জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার ছেলেটা আজ তিন রাত বাসায় থাকতে পারছে না। কখন পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যায়, ভয়ে ভয়ে থাকি। শিক্ষকরা সরকারের কাছে শিক্ষার্থীদের এভাবে হয়রানি না করার দাবি তুলতে পারেন। তা না করে নিজেদের স্বার্থে তারা যদি কাজ করেন, তাদের প্রতি যে শ্রদ্ধা, তা নষ্ট হয়ে যাবে।’

এটা নিয়ে বৈঠকে কোনো কথা হয়নি। এটা তো সরকার দেখছেই। শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করছে, নিহতদের পরিবারকে প্রধানমন্ত্রী আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন। এটা নিয়ে আমাদের তো আর কিছু বলার নেই।- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. নিজামুল হক ভূঁঞা

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মধ্যে চেতনাবোধ ছিল তা ক্রমে লুপ্ত হচ্ছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘অবশ্যই ছাত্র-ছাত্রীদের দুর্দিনে শিক্ষকদের পাশে থাকা উচিত। দেশ স্বাধীনের আগে থেকেই শিক্ষকরা যৌক্তিক দাবিতে শিক্ষার্থীদের যেসব আন্দোলন তাতে একাত্মতা জানাতেন। এ রেওয়াজ ছিল। অনেক শিক্ষক তো শহীদও হয়েছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শামসুজ্জোহা শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে জীবন দিয়ে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন। আমার মনে হয়, সেই জায়গা থেকে আমরা সরে এসেছি।’

তিনি বলেন, ‘একটা আন্দোলন হলো, সেখানে অনেক ছাত্র-ছাত্রী মারা গেলো। সাধারণ মানুষও মারা গেছে। দেখলাম অনেক শিশুও রয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকারের কাছে শিক্ষকদের পক্ষ থেকে দাবি তোলা উচিত ছিল। আজ যে বৈঠক শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে হচ্ছে, তাতে শিক্ষক নেতারা তা তুলে ধরেছেন কি না, তা আমি জানি না। শিক্ষকদের দাবিও পূরণ করা উচিত। তবে সবার আগে দুঃসময়ে শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষকদের নিবেদিতপ্রাণ হয়ে কাজ করা উচিত।’

শিক্ষার্থীদের পাশে শিক্ষকদের থাকা উচিত বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকও। তবে একইসঙ্গে শিক্ষকদের পেনশন সমস্যার সমাধান করাটাও দরকার বলে জানিয়েছেন তিনি।

দুঃসময় পার করছে শিক্ষার্থীরা, শিক্ষকরা স্বার্থের ‘দেনদরবারে’

অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক জাগো নিউজকে বলেন, ‘অবশ্যই শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও হয়রানি ঠেকাতে শিক্ষকদের কাজ করা উচিত। যেহেতু শিক্ষার্থীদের দাবিটি সরকার মেনে নিয়েছে। এখন তাদের ক্লাসে ফেরানোর ব্যবস্থা করতে হবে। সেক্ষেত্রে শিক্ষকরা ভূমিকা রাখতে পারেন। পাশাপাশি পেনশন ইস্যু নিয়ে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে, তাও সমাধান করা প্রয়োজন। দুটি বিষয়ে সমাধান হলে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সচল করা সহজ হবে।’

এদিকে, শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক শেষে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির মহাসচিব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. নিজামুল হক ভূঁঞা জাগো নিউজকে বলেন, ‘শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে। প্রত্যয় স্কিমে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত না করার বিষয়টি নিয়ে আমাদের কথা মন্ত্রী শুনেছেন। বাকি যে দুটি দাবি আমাদের ছিল, সেগুলোও ইতিবাচকভাবে দেখা হবে বলে জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী পরে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।’

কোটা সংস্কার আন্দোলনে হতাহত শিক্ষার্থী এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্বাভাবিক করার বিষয়ে শিক্ষক নেতারা শিক্ষামন্ত্রীর কাছে কোনো দাবি বা পরামর্শ তুলে ধরেছেন কি না, তা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা নিয়ে বৈঠকে কোনো কথা হয়নি। এটা তো সরকার দেখছেই। শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করছে, নিহতদের পরিবারকে প্রধানমন্ত্রী আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন। এটা নিয়ে আমাদের তো আর কিছু বলার নেই।’

এএএইচ/এএসএ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।