চাঁবিপ্রবির ভূমি অধিগ্রহণে ‘বিতর্কিত’ সেই মৌজামূল্য সংশোধন

সালাহ উদ্দিন জসিম
সালাহ উদ্দিন জসিম সালাহ উদ্দিন জসিম , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১০:৪২ এএম, ১৫ জুলাই ২০২৪
চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জমি অধিগ্রহণের মৌজামূল্য

চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চাঁবিপ্রবি) ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে জলঘোলা কম হয়নি। চড়ামূল্যে ১৩৯টি দলিল রেজিস্ট্রেশন করে এর আলোকে মৌজামূল্য ধরে সরকারের প্রায় সাড়ে তিনশ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। তৎকালীন জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে সেটি ভেস্তে যায়।

এখানেই শেষ নয়, নানাভাবে সবার চোখে ধুলো দিয়ে চড়ামূল্যে ভূমি অধিগ্রহণের চেষ্টা হয় বারবার। অবশেষে বিতর্কিত সেই মৌজামূল্য সংশোধন করা হয়েছে। নতুন মৌজামূল্যে ভূমি অধিগ্রহণের জন্য প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলেও জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

২০১৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১৯ এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। এ সংক্রান্ত বিল ২০২০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর সংসদে পাস হয়। ১৫ সেপ্টেম্বর সরকারি গেজেটের মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু। প্রতিষ্ঠার পর থেকে নানান কারণে আলোচনায় এ বিশ্ববিদ্যালয়টি। বিশেষ করে এর ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির স্বজন ও ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। অভিযোগের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে গিয়ে উল্টো শাস্তির মুখোমুখি হন তারা।

অভিযোগে যা বলেছিলেন জেলা প্রশাসক

চাঁদপুরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ খোদ ওই দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন। ভূমি মন্ত্রণালয়কে লেখা এক চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘চাঁদপুর সদর উপজেলার ১১৫ নম্বর লক্ষ্মীপুর সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের নির্ধারিত বাজারমূল্য অনুযায়ী নাল, বাড়ি/বাগান, পুকুর/ডোবা ও ভিটি শ্রেণির মূল্য পর্যায়ক্রমে ১৩ হাজার ৮০২ টাকা, ২৩ হাজার ৯৬৬, ৩৮ হাজার ৯৫৬ এবং ৩৩ হাজার ২৯৪ টাকা ধরে প্রকল্প প্রাক্কলন দাঁড়ায় ১৯৩ কোটি ৯০ লাখ ৬৫ হাজার ৫০৭ টাকা। কিন্তু দেখা যায়, সবশেষ নির্ধারিত মৌজামূল্যের তুলনায় অধিগ্রহণের জন্য সংগৃহীত দরপত্র চরম অস্বাভাবিক।’ অর্থাৎ আগে সেটির প্রাক্কলন মূল্য দেখানো হয়েছিল ৫৫৩ কোটি টাকা। যাতে সরকারের ৩৫৯ কোটি ১৬ লাখ ৬১ হাজার ৭৮২ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়।

চাঁবিপ্রবির ভূমি অধিগ্রহণে ‘বিতর্কিত’ সেই মৌজামূল্য সংশোধন

জেলা প্রশাসকের এ অভিযোগ চ্যালেঞ্জ করে মন্ত্রীর স্বজনরা আদালতে যান। নিজেদের শুদ্ধ দাবি করে আরও বেশি দাম চান। আদালত তাদের তিরস্কার করে বলেন, ‘১৩৯টি দলিল অসৎ উদ্দেশ্যে সম্পাদিত।’ একই সঙ্গে তাদের কোটি টাকা জরিমানাও করেন আদালত।

এতেও থামেননি তারা। গত বছরের ২১ আগস্ট ‘চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ, উন্নয়ন ও আনুষঙ্গিক কাজ’ শীর্ষক প্রকল্পের যাচাই কমিটির সভা হয়। এতে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ১৯৩ কোটি ৯১ লাখ টাকায় জমি অধিগ্রহণ সম্ভব নয় মর্মে মত দেন। বরং তৎকালীন মৌজা রেটে জমি অধিগ্রহণের ব্যয় প্রাক্কলনের জন্য উপাচার্যকে অনুরোধ করা হয়। সে অনুযায়ী উপাচার্যও জেলা প্রশাসনের কাছে ব্যয় প্রাক্কলন চান। বিষয়টি নিয়ে জাগো নিউজে প্রতিবেদনও প্রকাশ হয়।

এতে ‘১৩৯টি দলিল অসৎ উদ্দেশ্যে সম্পাদিত’ দলিল মূল্যের ওপর নির্ভর করে নির্ধারণ করা মৌজামূল্যে ব্যয় প্রাক্কলন ধরা হলে আগের মতো রাষ্ট্রের অর্থের তসরুফ হবে বলে মত দেন সংশ্লিষ্টরা। যে কারণে নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। নতুন করে ব্যয় প্রাক্কলন সম্ভব নয় বলে মত দেয় জেলা প্রশাসন। পাশাপাশি রেজিস্ট্রার অফিস থেকেও মৌজামূল্য পুনর্নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়।

কী আছে নতুন মৌজামূল্যে

দীর্ঘ চিঠি চালাচালির পর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে নিবন্ধন অধিদপ্তরের বিশেষ আদেশে বলা হয়, ‘সম্পত্তির সর্বনিম্ন বাজারমূল্য নির্ধারণ বিধিমালা ২০১০ এবং অধিকতর সংশোধন-২০১৫ এর বিধি ৫ এর উপবিধি ৬,৭ ও ৮ এর আলোকে চাঁদপুর জেলার সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের অধিক্ষেত্রাধীন ১১৬ নম্বর লক্ষ্মীপুর মৌজার নাল শ্রেণির প্রতি শতক জমির বাজারমূল্য ১ লাখ ৬২ হাজার ৬৫ টাকার স্থলে ২৩ হাজার ৯৬০ টাকা, বাড়ি/বাগান শ্রেণির প্রতি শতক জমির বাজারমূল্য ১ লাখ ৭২ হাজার ৮৮১ টাকার স্থলে ৫৭ হাজার ৮৬৭ টাকা, চাষি/ভিটি প্রতি শতক জমির বাজারমূল্য ১ লাখ ৪৩ হাজার ৮৬৭ টাকার স্থলে ৪১ হাজার ১৪৪ টাকা, ডোবা/পুকুর শ্রেণির প্রতি শতক জমির বাজারমূল্য ২ লাখ ৬৬ হাজার ৯৯৯ টাকার স্থলে ৪৫ হাজার ৭৬৪ টাকা মর্মে পুনর্নির্ধারণ/সংশোধনের প্রস্তাব অনুমোদন করা হলো।’

তবে গত বছরের জুলাই থেকে এ বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত উচ্চ মৌজা রেটে সম্পাদিত দলিলগুলো আসন্ন অর্থবছরের মৌজামূল্য নির্ধারণের সময় বিবেচনায় নিলে সমস্যাটি ফের সামনে আসবে।

চাঁবিপ্রবির ভূমি অধিগ্রহণে ‘বিতর্কিত’ সেই মৌজামূল্য সংশোধন

এ বিষয়ে জেলা রেজিস্ট্রার মহসিন আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ ও গণমাধ্যমের প্রকাশিত প্রতিবেদনের আলোকে আমরা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলাম। সেই তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে আমরা মৌজামূল্য পুনর্নির্ধারণের প্রস্তাবনা দেই। মহাপরিদর্শকের (নিবন্ধন) কার্যালয় থেকে এটি অনুমোদন দিয়েছে।’

গত আট মাস উচ্চ মৌজামূল্যে আপনারা যে দলিলগুলো সম্পাদন করেছেন পরবর্তীসময়ে মৌজামূল্য নির্ধারণে এগুলো বিবেচনায় নেবেন কি না জানতে চাইলে মহসিন আলম বলেন, ‘গত ৮ মাসের মধ্যে উচ্চ মৌজামূল্যে সম্পাদিত দলিলগুলোর বিষয়ে নিবন্ধন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শককে (আইজিআর) জানিয়ে তার নির্দেশনা মোতাবেক সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

এদিকে, নতুন নির্ধারিত মৌজামূল্য অনুযায়ী ব্যয় প্রাক্কলন চেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, এমনটাই জানিয়ে চাঁবিপ্রবির উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. নাছিম আখতার জাগো নিউজকে বলেন, ‘মৌজামূল্য পুনর্নির্ধারণের বিষয়টি আমার জানা আছে। সে আলোকেই আমরা এখন ব্যয় প্রাক্কলন চেয়েছি। কার্যক্রম চলমান। ফাইল এখন পরিকল্পনা কমিশনে।’

এসইউজে/এএসএ/এমএমএআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।