উপবৃত্তি পেতে পদে পদে বিড়ম্বনায় মফস্বলের শিক্ষার্থীরা
মিতু মনি রংপুরের একটি বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষা দেন। বাবা অসুস্থ থাকায় রসায়ন পরীক্ষার হলে পৌঁছাতে দেরি হয় তার। ফল প্রকাশের দিন জানতে পারেন ওই বিষয়ে ফেল করেছেন তিনি। এক বিষয়ে আবারও পরীক্ষা দিতে চান তিনি। কিন্তু তার পরিবারের পক্ষে খরচ চালানো সম্ভব নয়।
মিতু মনি বলেন, বাবা গরিব মানুষ। অনেক কষ্টে ১০টা বছর পড়িয়েছিল। ছাত্রী হওয়া সত্বেও তিনি নবম-দশম শ্রেণিতে উপবৃত্তি পাইনি। ফর্মপূরণ করলেও অনলাইনে (মোবাইল ব্যাংকিংয়ে কেইসি ভেরিফিকেশন) ঝামেলা হওয়ায় তালিকায় আমার নাম আসেনি। এখন পরিবারের পক্ষে খরচ চালানোর সাধ্য নেই। উপবৃত্তির টাকাটা যদি পেতাম, তাহলে পরীক্ষা দিয়ে সামনের বছর পাস করে যেতাম।
মঙ্গলবার (১১ জুন) রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে এসএসসিতে ফেল করা শিক্ষার্থীদের নিয়ে আয়োজিত মতবিনিময় অনুষ্ঠানে এভাবেই আকুতি জানান ওই ছাত্রী। এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘গণসাক্ষরতা অভিযান’।
অনুষ্ঠানে মিতু মনি তার অবস্থা তুলে ধরার পর গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী জিজ্ঞেসা করেন, ‘সব ছাত্রীকে তো সরকার উপবৃত্তি দিচ্ছে। তুমি পাওনি কেন?’ জবাবে মিতু জানান, ‘ফর্ম পূরণ করে দিয়েছিলাম। কিন্তু উপবৃত্তিতে নাম আসেনি। স্যাররা বলেছেন, অনলাইনে তথ্য সঠিক হয়নি বলে বাদ পড়ে গেছি।’
কেন এমন হলো— এ নিয়ে অনুষ্ঠানস্থলে শোরগোল শুরু হলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শিক্ষক ও অভিভাবকরা এ নিয়ে কথা বলতে চান। একে একে শিক্ষকরা জানান সরকার উপবৃত্তি দিলেও মোবাইল ব্যাংকিংয়ে তা পেতে মফস্বলের শিক্ষার্থীদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। অনেক সময় আবেদন করেও নানা জটিলতায় সুবিধাবঞ্চিত ও মেয়ে শিক্ষার্থীরা তালিকা থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ, যার উপবৃত্তি পাওয়ার কথা, সে পাচ্ছে না।
সুনামগঞ্জ থেকে আসা একজন তরুণ শিক্ষক তার অভিজ্ঞতা থেকে কিছু তথ্য ও পরামর্শ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সরকার এক বছর বিকাশে, আবার পরের বছর নগদে উপবৃত্তি দিচ্ছে। এতে বিড়ম্বনা দেখা দিয়েছে। বিকাশ বা নগদ নম্বর দিলেই যদি টাকা চলে আসতো, তাহলে সমস্যা ছিল না। কেইসি ভেরিফিকেশন করতে হয়। এটা ৯০ শতাংশ গ্রামের অভিভাবক বোঝেন না। এজন্য তারা অনেক সময় উপবৃত্তির জন্য নির্বাচিত হওয়া থেকেও বঞ্চিত হয়।
ওই শিক্ষক বলেন, ‘আগে ম্যানুয়ালি থাকায় শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের নির্বাচিত করতেন। অনলাইন সিস্টেম হওয়ার পর ১০০ জনের তালিকা দিলে কোনো বছরে ৩০ জন পায়, আবার কোনো বছর ৪০ জন পায়। দেখা যায়, ৩০ জনের মধ্যে প্রায় সবই ছেলে। আবার কোনো বার দেখা যায় সবই মেয়ে। এভাবে প্রকৃত উপবৃত্তির দাবিদাররা বঞ্চিত হচ্ছেন।’
মেহেরপুরের সাজ্জাদুর রহমান নামে আরেকজন শিক্ষকও একই মতামত তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘উপবৃত্তি শতভাগ মেয়েদের পাওয়া উচিত। আগে সেটাই পেতোও। এখন অনলাইনে হওয়ায় যারা পাওয়ার উপযোগী, তারা পাচ্ছেন না। আবার অস্বচ্ছল কোনো অভিভাবক যদি অন্য কোনো ভাতা (বয়স্ক, বিধবা) পান, তার ছেলে বা মেয়েকে কোনো চিন্তাভাবনা না করেই বাদ দেওয়া হচ্ছে। অথচ তাদেরই বেশি দরকার।’
সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মেয়ে শিপ্রা। পঞ্চগড়ের একটি স্কুল থেকে পরীক্ষা দিয়ে সব বিষয়ে জিপিএ-৫ পেলেও এক বিষয়ে ফেল করেছেন। তিনি জানান, আমার বাবা-মা কৃষিকাজ করেন। আমিও তাদের সঙ্গে কাজ করি। ফাঁকে ফাঁকে পড়ালেখা করি। আমরা গরিব। অথচ সরকার আমাদের কোনো সুযোগ-সুবিধা দেয় না।
শিপ্রা বলেন, এবার ফেল করেছি, এখন তো আরও উপবৃত্তি দেবে না। যদি এমন সময়ে আমি উপবৃত্তি না পাই, তাহলে আমাকে বাসা থেকে আর পড়াবে না। সরকারের কাছে অনুরোধ আমাদের সহায়তা করুন। আমাদের নিজ ভাষার একজন শিক্ষক দেন। তাহলে আমরা ভালো রেজাল্ট করবো।
পঞ্চগড় থেকে আসা আরেক শিক্ষক বলেন, শিক্ষাটা শহরকেন্দ্রিক ও গ্রামকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। আপনারা যারা শহরে থাকেন, তাদের গ্রামের স্কুল সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নেই। বিশেষ করে বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। আমার স্কুলে দুজন বিজ্ঞানের শিক্ষক। অথচ এ স্কুলটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৬২ সালে। ডিজিটাল বা মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের জন্য কিছুই নেই।
তিনি বলেন, ‘আমার শিক্ষার্থীরা অনেকে গরিব। তাদের জন্য সরকারি সহায়তা প্রয়োজন। আমরা শিক্ষা অফিসে ঘুরেও ঘুরে উপবৃত্তির ব্যবস্থা করতে পারি না। অথচ সরকার দাবি করে শতভাগ উপবৃত্তি দিচ্ছে। অনলাইনে হওয়ায় টাকা পেতে এবং তালিকা ঠিক করে দিতেও খুব সমস্যায় পড়তে হচ্ছে আমাদের।’
উত্তরের জেলা দিনাজপুর থেকে আসা আব্দুর রব নামে এক শিক্ষক বলেন, আমার স্কুলে সাঁওতাল ছেলেমেয়েরা পড়ে। ওরা খুবই দরিদ্র পরিবারের। না খেয়ে স্কুলে আসে। দুপুরে যদি ওদের জন্য টিফিনের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে ওরা উৎসাহিত হবে। এটা খুব জরুরি।
চট্টগ্রাম থেকে আসা এক ছাত্রীর মা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার মেয়েটাকে বহু কষ্টে পড়িয়েছি। ও এবার ফেল করছে। আমি ওকে আবার পরীক্ষা দেওয়াবো। সরকার যদি উপবৃত্তির টাকাটা দেয়, তাহলে আমার জন্য সহজ হবে।
উপবৃত্তি না পাওয়া, যারা পান তাদের অনলাইনে টাকা পেতে ভোগান্তিতে পড়া, গ্রামের স্কুলে তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা না থাকায় করোনাকালে পড়ালেখা করতে না পারা, শিক্ষক সংকটসহ বিভিন্ন পরামর্শ তুলে ধরেন শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকরা।
শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা যখন একের পর এক প্রশ্ন করছিলেন, তখন মঞ্চে বসেছিলেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ, শিক্ষাসচিব নজরুল ইসলাম খান, অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ, লেখক ও শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল প্রমুখ।
অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী সব সমস্যাগুলো নোট করে তা সুপারিশ আকারে তুলে ধরা হবে বলে জানান। তিনি বলেন, ‘মায়েদের মোবাইল নম্বরে টাকা যাওয়ার কথা। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। আমি নিশ্চিত মায়েদের নম্বরে যদি টাকাটা দেওয়া সম্ভব হতো, তাহলে তা নষ্ট হতো না।’
রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘গবেষণা বলছে, কোনো মা যদি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্তও লেখাপড়া জানে তাহলে তার সন্তান নিরক্ষর হবে না, অপুষ্টিতে ভুগবে না। এজন্য মায়েদের এসব বিষয়ে সোচ্চার হতে হবে।’
সাবেক শিক্ষাসচিব এন আই খান বলেন, শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির টাকা দেওয়ার প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ করতে হবে। এখানে মনিটরিং জোরদার করতে হবে। কঠোর অবস্থান নিতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটিটা পুরোপুরি অভিভাবকদের নেতৃত্বে ছেড়ে দিতে হবে।
সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ‘আমরা উপবৃত্তির টাকা নয়-ছয় ঠেকাতে কঠোর হয়েছিলাম। সেটা ক্রমে উন্নত হওয়ার কথা। কিন্তু এখনো সেই একই অভিযোগ শুনতে হচ্ছে। এটা দুঃখজনক।’
লেখক ও শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, ‘যাদেরকে বলা হচ্ছে যে তুমি ফেল করেছো, তারা আসলে ফেল করেনি, তাদের ফেল করানো হয়েছে। এ তিন লাখ শিক্ষার্থী যাতে হারিয়ে না যায়, সেদিকে সরকারকে নজর রাখতে হবে। তাদের উপবৃত্তির ব্যবস্থা করতে হবে।’
অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, ‘সরকার অনেক কিছু করছে। তা মফস্বলে পৌঁছাচ্ছে কি না, সেটা দেখার লোক নেই। এ জায়গাটায় আমাদের আরও শক্ত হতে হবে। তাহলে সরকারের উদ্যোগ সফল হবে।’
এএএইচ/এমএএইচ/