রমজানে যে কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখা হচ্ছে

আল-আমিন হাসান আদিব
আল-আমিন হাসান আদিব আল-আমিন হাসান আদিব , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:১৭ এএম, ১৪ মার্চ ২০২৪
ফাইল ছবি

রমজানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা নাকি বন্ধ থাকবে, তা ঠিক করা নিয়ে রীতিমতো তিনদিনের ‘নাটকীয়তা’ দেখেছে দেশবাসী। ক্ষণে ক্ষণে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে তটস্থ হয়ে পড়েন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। সিদ্ধান্তে অনড় থেকে শেষ পর্যন্ত নিজেদের পক্ষেই আদালতের আদেশ পেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ফলে প্রাথমিক বিদ্যালয় ২১ মার্চ এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয় ২৫ মার্চ পর্যন্ত খোলা থাকছে। এছাড়া মাদরাসায় ২১ মার্চ এবং কলেজে ২৪ মার্চ পর্যন্ত চলবে ক্লাস।

বছরের শুরুতে ঘোষিত ছুটির তালিকায় পুরো রমজানজুড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি ছিল। ফলে শিক্ষকরাও রোজায় ছুটির প্রত্যাশায় ছিলেন। বেশিরভাগ অভিভাবকও স্কুল বন্ধ রাখার পক্ষে। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠেছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় কেন রমজানে দুই সপ্তাহ স্কুল-কলেজ খোলা রাখতে এত মরিয়া?

অভিভাবক-শিক্ষকদের এমন প্রশ্নের জবাবে যুক্তি তুলে ধরেছেন জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। মতামত জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রীও।

জানতে চাইলে এনসিটিবির সদস্য (কারিকুলাম) অধ্যাপক মশিউজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘নতুন কারিকুলাম মুখস্তনির্ভর নয়। আগে দেখা যেত, ছুটির মধ্যে শিক্ষার্থীদের কয়েক অধ্যায় পড়া দিয়ে দিতেন শিক্ষকরা। সেসব অধ্যায় নিয়ে ক্লাস হোক বা না হোক, ওইসব অধ্যায় পড়ানো শেষ বলে ধরে নেওয়া হতো। বছর শেষে অধ্যায়গুলো থেকে প্রশ্নপত্র তৈরি করে পরীক্ষাও হতো।’

নতুন কারিকুলামে শিখনঘণ্টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিখনঘণ্টা পূরণে বছরের নির্দিষ্ট সময় স্কুলে ক্লাস চালাতেই হবে। বাৎসরিক ছুটি, সাপ্তাহিক ছুটি মিলিয়ে বছরের প্রায় ১৫০ দিন এমনিতেই স্কুল বন্ধ থাকে। ষান্মাসিক ও বার্ষিক মূল্যায়নের সময় বাদ দিলে যে দিনগুলো থাকবে, তা শিক্ষার্থীকে শেখানোর জন্য পর্যাপ্ত নয়।

তিনি বলেন, ‘নতুন কারিকুলামে বিষয়টি উল্টো। শিক্ষার্থীরা প্রতিটি অধ্যায় পড়বে, হাতে-কলমে শিখবে এবং তখনই মূল্যায়ন হবে। এজন্য নতুন কারিকুলামে শিখনঘণ্টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিখনঘণ্টা পূরণে বছরের নির্দিষ্ট সময় স্কুলে ক্লাস চালাতেই হবে। বাৎসরিক ছুটি, সাপ্তাহিক ছুটি মিলিয়ে বছরের প্রায় ১৫০ দিন এমনিতেই স্কুল বন্ধ থাকে। ষান্মাসিক ও বার্ষিক মূল্যায়নের সময় বাদ দিলে যে দিনগুলো থাকবে, তা শিক্ষার্থীকে শেখানোর জন্য পর্যাপ্ত নয়। তাই ছুটি কমিয়ে শিখনঘণ্টা পূরণের চেষ্টা করছে সরকার।’

আরও পড়ুন

একই কথা জানিয়েছেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক নেহাল আহমেদ। আগামী বছরে রমজানে ছুটি আরও কমানোও হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি।

অধ্যাপক নেহাল আহমেদের ভাষ্য, ‘নতুন কারিকুলামে যথাযথভাবে শিক্ষার্থীদের শেখাতে বছরে অন্তত ১৮৫ কর্মদিবস প্রয়োজন। এজন্য ছুটি বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। শিক্ষার্থীদের স্বার্থে শিখনঘণ্টা ঠিক রাখতে হবে। আমরা আগামী বছরের শুরুতে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষাপঞ্জিকা তৈরি করবো।’

জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন কোর কমিটির সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক এম তারিক আহসান বলেন, ‘দেখুন-উপকূলীয় অঞ্চলে দুর্যোগের কারণে ছুটি দিতে হয়। এতে সেখানে শিখনঘণ্টা কমে যায়। আবার কোনো কোনো এলাকায় বেশি শীত পড়লেও ছুটি দিতে হচ্ছে। এতেও শিখনঘণ্টা কমে যাচ্ছে। এসব কারণে শিখনঘণ্টা হিসাব করে ১৮৫ দিনের বেশি শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য শিক্ষাপঞ্জিকা করা উচিত হবে।’

রমজানে যে কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখা জরুরি

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমে পড়ানো হয়। প্রথম বছর পাইলটিং হিসেবে ধরা হয়। এবার প্রাথমিকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় এবং মাধ্যমিকের অষ্টম-নবমে এ শিক্ষাক্রম পড়ানো হবে। সবমিলিয়ে সাত শ্রেণিতে পূর্ণরূপে নতুন কারিকুলামে পাঠদান ও মূল্যায়ন হবে। নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে শিক্ষক প্রশিক্ষণ, শিক্ষার্থীদের প্রতিষ্ঠানের বাইরে তথ্য সংগ্রহসহ নানান কারণে আগের চেয়ে বেশি সময় প্রয়োজন।

বর্তমানে সাপ্তাহিক ছুটি দুদিন। শুধু সাপ্তাহিক ছুটিতেই বছরে ১০৪ দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। ফলে শিখনঘণ্টা ঠিক রাখা চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে কমপক্ষে ১৮৫ দিন বিদ্যালয়ে পাঠদান কার্যক্রম অব্যাহত রাখতেই হবে।

তাছাড়া বর্তমানে সাপ্তাহিক ছুটি দুদিন। শুধু সাপ্তাহিক ছুটিতেই বছরে ১০৪ দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। ফলে শিখনঘণ্টা ঠিক রাখা চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে কমপক্ষে ১৮৫ দিন বিদ্যালয়ে পাঠদান কার্যক্রম অব্যাহত রাখতেই হবে। শিখনঘণ্টা ঠিক রাখতে বাড়তি সময় হিসাবে ধরে শিক্ষাপঞ্জিকা করার পথে হাঁটছে শিক্ষা প্রশাসন।

শিক্ষক-অভিভাবকদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া
রাজধানীর গভর্নমেন্ট সায়েন্স হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল রাকিব। জানতে চাইলে তার মা রেবেকা সুলতানা জাগো নিউজকে বলেন, ‘নতুন কারিকুলামে তো বাসায় পড়াশোনা বলে কিছু নেই। স্কুলেই সব কাজ। এজন্য স্কুল যত কম বন্ধ থাকবে, ততই ভালো। একটু কষ্ট হবে। রাস্তায় যানজটে ভোগান্তি বাড়বে। তবুও আমরা এটাকে ভালোই মনে করছি।’

আরও পড়ুন

তবে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র শিহাব উদ্দিনের মা হাসনা বেগম রমজানে স্কুল বন্ধ রাখা উচিত ছিল বলে মনে করেন। জাগো নিউজকে হাসনা বেগম বলেন, ‘রমজান মাসটা মুসলমানদের কাছে অন্য রকম একটা মাস। আমার ছেলে রোজা রাখে। সেহরি শেষ করে ওরা আর ঘুমাতে চায় না। অথচ সকাল ৭টায় স্কুলের জন্য বের হতে হয়। রাতে সেহরি শেষ করে ভোরে উঠে স্কুলে নিয়ে যাওয়া খুবই কষ্টকর। এজন্য রোজার মধ্যে ১৫ দিন ক্লাস বন্ধ রাখলে খুব বেশি অসুবিধা হতো না।’

রাজধানীর একটি স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ নাম-পরিচয় প্রকাশ না করে জাগো নিউজকে বলেন, ‘অষ্টম-নবম ও দশম শ্রেণির মুসলিম শিক্ষার্থীরা অনেকে রোজা রাখে। ষষ্ঠ-সপ্তমের শিক্ষার্থীরাও অনেকে রোজা রাখার চেষ্টা করে। এজন্য স্কুলে আসতে চায় না। রমজানে স্কুল খোলা রেখে খুব বেশি লাভ হয় না। আমরা মনে করি- পড়ালেখাটা মুখ্য নয়। সরকারের কিছু আমলারা এ সিদ্ধান্ত নেন। এটা শিক্ষকদের ওপর জুলুম করা ছাড়া আর কিছু নয়।’

আমরা ছুটি কিছুটা কমিয়েছি শিক্ষার্থীদেরই স্বার্থে। হ্যাঁ, রমজানে শিশু শিক্ষার্থীদের নিয়ে অভিভাবকদের কিছুটা ভোগান্তি হতে পারে। তবে বৃহৎ স্বার্থে সবাইকে একটু ধৈর্য ধরতে হবে, ভোগান্তি সইতে হবে।

তবে নতুন কারিকুলামে প্রশিক্ষণ নেওয়া শিক্ষকদের অনেকে স্কুল খোলা রাখার সিদ্ধান্ত সঠিক বলে মনে করেন। তারা জানান, নতুন কারিকুলামে শিখনকালীন মূল্যায়ন হওয়ায় নিয়মিত ক্লাস চলা উচিত। দীর্ঘসময় ছুটি রাখলে শিখনঘণ্টা পূরণ হবে না। শিক্ষার্থীরা না শিখেই পরের ক্লাসে উঠে যাবে। এতে নতুন কারিকুলামের যে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় আমরা শিক্ষায় আমূল পরিবর্তন আনার কাজে হাত দিয়েছি। আমাদের শিক্ষার্থীদের দক্ষ-যোগ্য করে গড়ে তুলতে চাই। ধরাবাঁধা নিয়মে পড়ালেখা করলে আমরা পিছিয়েই থাকবো। সেখান থেকে বেরিয়ে যুগোপযোগী ও বৈশ্বিক সামঞ্জস্যপূর্ণ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। নতুন এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়নে শিক্ষক-অভিভাবকসহ সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।’

তিনি বলেন, ‘আমরা ছুটি কিছুটা কমিয়েছি শিক্ষার্থীদেরই স্বার্থে। হ্যাঁ, রমজানে শিশু শিক্ষার্থীদের নিয়ে অভিভাবকদের কিছুটা ভোগান্তি হতে পারে। তবে বৃহৎ স্বার্থে সবাইকে একটু ধৈর্য ধরতে হবে, ভোগান্তি সইতে হবে। আমরা এটুকু বলতে পারি, সরকার শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের স্বার্থেই রমজানে স্কুল কিছুদিন খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’

এএএইচ/কেএসআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।