মাউশি-ভিকারুননিসার ভুলের বলি ১৬৯ শিশু শিক্ষার্থী

আল-আমিন হাসান আদিব
আল-আমিন হাসান আদিব আল-আমিন হাসান আদিব , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:২১ পিএম, ০৭ মার্চ ২০২৪
জাগো নিউজ গ্রাফিক্স

জুবাইয়া জেরিনের বয়স প্রায় সাড়ে সাত বছর। গত ডিসেম্বরে লটারির মাধ্যমে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয় সে। তখন তার বয়স ছিল সাত বছর তিন মাসের কাছাকাছি। জানুয়ারি থেকে শুরু হয় ওদের ক্লাস। বন্ধুদের সঙ্গে দুই মাস ক্লাস করেছে সে। ভিকারুননিসার স্কুলড্রেস পরতেও খুব ভালোবাসে। দুদিন আগে হঠাৎ জেনেছে বয়সের মারপ্যাঁচে তার ভর্তি বাতিল হয়েছে। আর যেতে পারবে না স্কুলে। এরপর থেকে কান্না থামছেই না জেরিনের। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়াও করছে না। কিছুতেই সে ভিকারুননিসা ছাড়তে চাইছে না।

এমনটি জানালেন তার মা আজমিরা খাতুন। শুধু জুবাইয়া জেরিন নয়, তার মতো ভর্তি বাতিল হয়েছে ভিকারুননিসার প্রথম শ্রেণির ১৬৯ শিক্ষার্থীর। উচ্চ আদালতের নির্দেশে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) ভিকারুননিসা স্কুলকে তাদের ভর্তি বাতিলের নির্দেশনা দেয়। সেই নির্দেশনা মেনে ভর্তি বাতিল করে স্কুল কর্তৃপক্ষ। এরই মধ্যে অনেক অভিভাবক তার সন্তানের ভর্তি বাতিলের নোটিশ পেয়েছেন। দুই মাস ক্লাস করার পর সন্তানের ভর্তি বাতিলের খবরে মাথায় যেন বাজ পড়েছে অভিভাবকদের।

অভিভাবকদের দাবি, তারা কোনো ধরনের ছলচাতুরির আশ্রয় নেননি। অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমেও সন্তানকে ভর্তি করাননি। মাউশি ও ভিকারুননিসার ভুলে কেন তাদের শিশুসন্তানদের ভবিষ্যৎ এভাবে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।

স্কুলমাউশি-ভিকারুননিসার ভুলের বলি ১৬৯ শিশু শিক্ষার্থী

অবশ্য অভিভাবকদের এমন প্রশ্নের জবাব মিলছে না ভিকারুননিসা স্কুল কর্তৃপক্ষ ও মাউশি কর্মকর্তাদের কাছেও। তারা বলছেন, ত্রুটি হয়েছিল, নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেছিল। অন্য দুজন অভিভাবক রিট করেছিলেন। উচ্চ আদালত সেটার সুরাহা করেছেন। তারা সবাই আদালতের নির্দেশনা মানতে বাধ্য।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত বছরের ২৩ অক্টোবর শিক্ষা মন্ত্রণালয় বেসরকারি স্কুলের ভর্তি নীতিমালা প্রকাশ করে। নীতিমালার ৩ নম্বর অনুচ্ছেদে শিক্ষার্থীর বয়স নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। সেখানে বলা হয়, জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ অনুযায়ী প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির জন্য শিক্ষার্থীর বয়স কমপক্ষে ৬ বছরের বেশি হতে হবে। সেই হিসাবে সর্বনিম্ন জন্ম তারিখ হবে ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি। তবে বয়সের ঊর্ধ্বসীমা অর্থাৎ, সর্বোচ্চ বয়সসীমা নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করবে। এরপর ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ভিকারুননিসা। প্রতিষ্ঠানটি প্রথম শ্রেণির জন্য ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে জন্ম নেওয়া শিশুরা যোগ্য বিবেচিত হবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করে।

নীতিমালা অনুযায়ী ৬ বছরের বেশি বয়সীরা প্রথম শ্রেণির জন্য যোগ্য বিবেচিত হবে। সেটা ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি জন্ম নেওয়া শিশুর ভর্তির সুযোগ ছিল। কিন্তু ভিকারুননিসা ভুল করে ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর জন্ম নেওয়ারা যোগ্য বলে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। সেটা আমরা পরে সংশোধনও করেছি চিঠি দিয়ে।- মাউশির মাধ্যমিক বিভাগের পরিচালক বেলাল হোসাইন

২৮ নভেম্বর ঘটা করে রাজধানীর সেগুনবাগিচার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে লটারির আয়োজন করে মাউশি। লটারির মাধ্যমে আবেদনকারীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঠিক করে দেওয়া হয়। এরপর যে শিক্ষার্থী যে প্রতিষ্ঠান পেয়েছে, তারা সেখানে নির্ধারিত দিনে কাগজপত্র নিয়ে যাচাই-বাছাইয়ের মুখোমুখি হয়। তখন ভিকারুননিসা জানতে পারে মাউশি থেকে লটারিতে নির্বাচিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে তাদের প্রতিষ্ঠানে ২০১৫, ২০১৬ ও ২০১৮ সালে জন্ম নেওয়া শিশুদের নামও রয়েছে।

স্কুলমাউশি-ভিকারুননিসার ভুলের বলি ১৬৯ শিশু শিক্ষার্থী

বিষয়টি মাউশিকে অবগত করে চিঠি দেয় স্কুল কর্তৃপক্ষ। মাউশির পরামর্শে গত ২ ডিসেম্বর গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান, সব সদস্য, শিক্ষক ও ভর্তি কমিটির প্রতিনিধিদের নিয়ে সভা করে ভিকারুননিসা কর্তৃপক্ষ। সেখানে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে জন্মগ্রহণ করা যেসব শিশু লটারিতে নির্বাচিত হয়েছে, তাদের ভর্তি নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এতে ২০১৫ সালের ১০ জন ও ২০১৬ সালে জন্ম নেওয়া ১৫৯ জন ছাত্রী প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির সুযোগ পায়। তবে ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি জন্ম নেওয়া পাঁচজনকে ভর্তির অযোগ্য বলে বিবেচনা করে স্কুল কর্তৃপক্ষ।

এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি জন্ম নেওয়া দুই শিক্ষার্থীর মা গত ১৪ জানুয়ারি হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। ২৩ জানুয়ারি হাইকোর্ট শুনানি নিয়ে রুলসহ আদেশ দেন। গত ১১ ফেব্রুয়ারি মাউশির সহকারী পরিচালক (মাধ্যমিক–২) এস এম জিয়াউল হায়দার হেনরী আদালতে হাজির হন। তিনি ভুল হয়েছে উল্লেখ করে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এরপর মাউশি থেকে ভিকারুননিসাকে চিঠি দিয়ে ভর্তি বাতিলের নির্দেশনা দেওয়া হয়। ভর্তি বাতিলের ফলে শূন্য হওয়া আসনে অপেক্ষমাণ তালিকা থেকে আগামী সাতদিনের মধ্যে শিক্ষার্থী ভর্তির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

মাউশির মাধ্যমিক বিভাগের পরিচালক বেলাল হোসাইন জাগো নিউজকে বলেন, ‘বর্তমানে আমি মাধ্যমিকে নেই। কলেজ বিভাগে দায়িত্বে আছি। তবে আমার সময়েই এটা ঘটেছে, তা সত্য। নীতিমালা অনুযায়ী ৬ বছরের বেশি বয়সীরা প্রথম শ্রেণির জন্য যোগ্য বিবেচিত হবে। সেটা ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি জন্ম নেওয়া শিশুর ভর্তির সুযোগ ছিল। কিন্তু ভিকারুননিসা ভুল করে ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর জন্ম নেওয়ারা যোগ্য বলে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। সেটা আমরা পরে সংশোধনও করেছি চিঠি দিয়ে।’

২০১৫ ও ২০১৬ সালে জন্ম নেওয়া শিশুদের ভর্তি গভর্নিং বডি ও ভর্তি কমিটির সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে হয়েছে। মাউশির পরামর্শে আমরা এটা (গভর্নিং বডির সভা) করেছিলাম। উচ্চ আদালত যেহেতু এ নিয়ে স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন, এখন মন্তব্য করাটা আইনের লঙ্ঘন।- ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী

তিনি বলেন, ‘২০১৫ ও ২০১৬ সালে জন্ম নেওয়া শিশুদের ভর্তি নেওয়ার বিষয়টি যেহেতু তাদের (প্রতিষ্ঠান) ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, সেজন্য তারা সভা করে এ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি জন্ম নেওয়া যে পাঁচজনকে ভর্তি নেওয়া হয়নি, সেটা ভিকারুননিসার ভুল। এখন আদালত নির্দেশ দিয়েছেন, সেটাই সবাইকে মানতে হবে। এর বেশি আমি কিছু জানি না।’

মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে শিশু শিক্ষার্থীরা
ভর্তি বাতিলের খবরে শিশুরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে বলে জানিয়েছেন অভিভাবকরা। তারা কিছুতেই এটা মানতে পারছেন না। দুই মাস ক্লাসের পর এখন শিশুসন্তানদের অন্য কোথাও ভর্তি করানোর চিন্তাও করতে পারছেন না বাবা-মা। মানবিক দিক বিবেচনায় তাদের ভর্তি বাতিল না করার অনুরোধ জানিয়েছেন তারা। একই সঙ্গে আইনি লড়াইয়েও নেমেছেন অভিভাবকরা।

স্কুলমাউশি-ভিকারুননিসার ভুলের বলি ১৬৯ শিশু শিক্ষার্থী

সৌমেন দে নামে এক অভিভাবক জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার মেয়েটা একটা কিন্ডারগার্টেনে পড়তো। মাউশির নিয়ম মেনে এবার আবেদন করি। লটারিতে ওর নাম আসে। ভিকারুননিসা, মতিঝিল আইডিয়ালসহ ভালো ভালো কয়েকটা প্রতিষ্ঠান পেয়েছে। আমরা ওকে ভিকারুননিসায় দিয়েছি। ও খুব খুশি। হঠাৎ শুনছি ওদের ভর্তি বাতিল করেছে। কোনো নোটিশ পাইনি। মিডিয়ায় দেখছি। এটা জানার পর মেয়েটা আমার কান্না করছে। ভেঙে পড়েছে। শিশুদের এভাবে মানসিক ধাক্কা দেওয়াটা দুঃখজনক।’

রাজু আহমেদ নামে আরেক অভিভাবক বলেন, ‘আমি সাধারণ নাগরিক। নিয়ম মেনে আবেদন করেছি, সঠিক কাগজপত্র দিয়েছি। কর্তৃপক্ষ সব যাচাই করে ভর্তি নিয়েছে। ফেব্রুয়ারি ও মার্চের বেতনও দিয়েছি। এখন বলছে ভর্তি বাতিল। এটা কী মগের মুল্লুক। ভুল করলে ভিকারুননিসা ও মাউশি করেছে। আমরা কোনো ভুল করিনি, অবৈধ কাজও করিনি। আমরা এ ভর্তি বাতিল মানবো না।’

কার দোষ, কার ভুল এগুলো জিজ্ঞেস করে তো আর লাভ নেই। উচ্চ আদালত এটার বিহিত করে দিয়েছেন। এ নিয়ে কথা বাড়াতে চাই না। ভবিষ্যতে বিষয়টি (সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ বয়স) নিয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা রাখা যায় কি না, তা নিয়ে আলোচনা করা হবে।- মাউশির উপ-পরিচালক (মাধ্যমিক) ও ঢাকা মহানগরী ভর্তি কমিটির সদস্য সচিব মোহাম্মদ আজিজ

জুবাইয়া জেরিনের মা আজমিরা খাতুন বলেন, ‘মেয়েটা স্কুলে যেতে পারবে না শোনার পর খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। সারাদিন কাঁদছে। বলছে, আমি অন্য স্কুলে যাবো না। যদি ওই স্কুলে না দাও, তাহলে আমি আর পড়বো না। মানবিক দিক বিবেচনা করে হলেও তো শিশুদের এভাবে ভর্তি বাতিল করা উচিত নয়। আমরা তো অবৈধভাবে ভর্তি করাইনি। ভুল বা নিয়মের লঙ্ঘন তো স্কুল করছে, আমরা দোষ করিনি। তাহলে শাস্তি কেন আমাদের ছোট বাচ্চাদের পেতে হবে?’

জানতে চাইলে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘২০১৫ ও ২০১৬ সালে জন্ম নেওয়া শিশুদের ভর্তি গভর্নিং বডি ও ভর্তি কমিটির সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে হয়েছে। মাউশির পরামর্শে আমরা এটা (গভর্নিং বডির সভা) করেছিলাম। উচ্চ আদালত যেহেতু এ নিয়ে স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন, এখন মন্তব্য করাটা আইনের লঙ্ঘন।’

মাউশির উপ-পরিচালক (মাধ্যমিক) ও ঢাকা মহানগরী ভর্তি কমিটির সদস্য সচিব মোহাম্মদ আজিজ উদ্দিন বলেন, ‘কার দোষ, কার ভুল এগুলো জিজ্ঞেস করে তো আর লাভ নেই। উচ্চ আদালত এটার বিহিত করে দিয়েছেন। এ নিয়ে কথা বাড়াতে চাই না। ভবিষ্যতে বিষয়টি (সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ বয়স) নিয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা রাখা যায় কি না, তা নিয়ে আলোচনা করা হবে।’

এএএইচ/এএসএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।