‘ভালো-খারাপের বিশ্বাস ভেঙে দিতেই নতুন শিক্ষাক্রম’

আল-আমিন হাসান আদিব
আল-আমিন হাসান আদিব আল-আমিন হাসান আদিব , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:৪০ এএম, ১২ অক্টোবর ২০২৩
অধ্যাপক ড. মো. মশিউজ্জামান

নতুন শিক্ষাক্রমে বদলে যাচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থা। বন্ধ হচ্ছে পরীক্ষা। থাকছে না জিপিএ-নম্বর নিয়ে মাতামাতিও। মূল্যায়নে আসছে চিহ্ন বা সূচক, যা নিয়ে শঙ্কা, সংশয়ের শেষ নেই অভিভাবকদের। অভিযোগ-অনুযোগ রয়েছে শিক্ষকদেরও। এ শিক্ষাক্রমের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছেন অভিভাবকরা। গণস্বাক্ষরের পর ঘোষণা দিয়েছেন মানববন্ধন কর্মসূচির। শিক্ষাবিদরাও কেউ কেউ বলছেন- রাজনৈতিক উত্তাপের বছরে সরকারকে বাড়তি চাপে ফেলতে পারে নতুন শিক্ষাক্রম।

এসব বিষয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন নতুন শিক্ষাক্রম প্রণেতাদের মধ্যে অন্যতম অধ্যাপক ড. মো. মশিউজ্জামান। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) শিক্ষাক্রম ইউনিটের সদস্য তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক আল-আমিন হাসান আদিব।

‘ভিকারুননিসা নূন স্কুলের অনেক মেয়েকে দেখবেন এখন গৃহস্থালি কাজ করছেন। আবার মধ্যম সারির কোনো স্কুল থেকে পাস করা মেয়েটি হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে বড় ব্যাংকে ভালো পদে চাকরি করছেন। নতুন শিক্ষাক্রমে এটা বলার কোনো সুযোগ নেই যে, তুমি ওর চেয়ে ভালো। ভালো ও খারাপ- এ বিশ্বাস ভেঙে দেওয়ার কাজটিই করছি আমরা’

জাগো নিউজ: নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের পথে হাঁটছে বাংলাদেশ। বলাই যায়- শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসছে। আপনি সামনের সারিতে থেকে এ শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করেছেন। নতুন শিক্ষাক্রমকে অল্প কথায় কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

অধ্যাপক মশিউজ্জামান: আবর্জনার ভেতরে চমৎকার রক্তকরবী ফোটে। আবার পরিচ্ছন্ন আদর্শ পরিবেশে থাকা গোলাপ গাছটিও শুকিয়ে মরে যায়। আবর্জনায় ফোটা রক্তকরবী দেখেও আমরা উচ্ছ্বসিত হই না। বরং গোলাপ গাছটি কেন মারা গেলো, তা নিয়ে আক্ষেপের শেষ থাকে না। অথচ আবর্জনা ও পরিচ্ছন্ন আদর্শ জায়গা- দুটি সমান গুরুত্ব দিলে কোনোভাবে গোলাপ গাছটি মারা গেলেও প্রস্ফুটিত রক্তকরবী নিয়ে সান্ত্বনা পেতাম।

আরও পড়ুন>>থাকছে না জিপিএ-নম্বর, আসছে চিহ্নভিত্তিক মূল্যায়ন

নতুন শিক্ষাক্রমে আমরা সব শিক্ষার্থীকে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে আগামীর বাংলাদেশ গড়তে বাস্তবভিত্তিক শিক্ষা দেবো। কেউ অবহেলিত থাকবে না, কেউ অতি আদর পেয়েও ঝরে পড়ার মতো দুর্ঘটনার মুখে পতিত হবে না। নিজ নিজ যোগ্যতায় আপন মনে বেড়ে উঠবে সবাই। রক্তকরবীর জায়গায় রক্তকরবী শোভা পাবে, গোলাপের জায়গায় গোলাপ সুবাস ছড়াবে। প্রত্যেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং পরিবার, সমাজ ও দেশ গড়ায় সমান ভাগিদার হবে।

নতুন শিক্ষাক্রমে নিয়মিত ব্যবহারিক কাজ করছে শিক্ষার্থীরা

জাগো নিউজ: শিক্ষাক্রম নিয়ে আপনার প্রারম্ভিক কথাগুলো আরও একটু স্পষ্ট করে বাস্তবভিত্তিক উদাহরণে বোঝাবেন…।

অধ্যাপক মশিউজ্জামান: হ্যাঁ, আমি এটাই বোঝাতে চাইছি—বর্তমান যে শিক্ষাক্রম, তাতে একজন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পাচ্ছে। বাহবা দেওয়া হচ্ছে। ১০ বছর পর খোঁজ নিয়ে দেখা যাচ্ছে, হয়তো সে হারিয়ে গেছে। অথচ জিপিএ-৪ বা তারও কম পাওয়া একজন শিক্ষার্থী খুব ভালো জায়গায় রয়েছে। ভিকারুননিসা নূন স্কুলের অনেক মেয়েকে দেখবেন এখন গৃহস্থালি কাজ করছেন। আবার মধ্যম সারির কোনো স্কুল থেকে পাস করা মেয়েটি হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে বড় ব্যাংকে ভালো পদে চাকরি করছেন। নতুন শিক্ষাক্রমে এটা বলার কোনো সুযোগ নেই যে, তুমি ওর চেয়ে ভালো। ভালো ও খারাপ- এ বিশ্বাস ভেঙে দেওয়ার কাজটিই করছি আমরা।

‘নম্বর বলেই কিছু থাকবে না। আমরা শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার মুখে ফেলবো না, মূল্যায়ন করবো। মূল্যায়ন হবে যোগ্যতা ও আগ্রহ বা ঝোঁকনির্ভর। এ যোগ্যতা পরিমাপ করার নির্দিষ্ট কতকগুলো পারফরম্যান্স ইনডিকেটর থাকবে। সেটার সূচকও উল্লেখ করা থাকবে’

জাগো নিউজ: এসএসসির আগে নবম-দশম শ্রেণি। আগে একই সিলেবাসের ওপর এসএসসি পরীক্ষা হতো। এখন সেটা কেমন হবে?

অধ্যাপক মশিউজ্জামান: নবম ও দশম শ্রেণি এখন পুরোপুরি আলাদা। নবম শ্রেণিতে স্বাভাবিক মূল্যায়ন হবে। শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচি অনুযায়ী এসএসসি পরীক্ষায় মূল্যায়ন করা হবে।

জাগো নিউজ: জিপিএ-নম্বর তুলে দিচ্ছেন। চিহ্নভিত্তিক মূল্যায়ন আনা হচ্ছে। বিষয়টি একেবারে নতুন। সেভাবে কেউ স্পষ্ট করতে পারছেন না। শিক্ষকরাও না! চিহ্নভিত্তিক মূল্যায়নটা আসলে কী?

অধ্যাপক মশিউজ্জামান: নতুন শিক্ষাক্রমে নবম শ্রেণি পর্যন্ত কারিকুলামে ষান্মাসিক ও বার্ষিক সামষ্টিক মূল্যায়ন থাকবে। বর্তমানে আমরা ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণিতে তিনটি চিহ্ন দিয়ে মূল্যায়ন করেছি। ত্রিভুজ, বৃত্ত ও চতুর্ভুজ। শিক্ষার্থী নির্দিষ্ট বিষয়ে কোন পর্যায়ে আছে, তা বোঝানো হচ্ছে। এগুলো দিয়ে কিন্তু ভালো বা খারাপ বোঝানো হয়নি। কোনো একটি কাজ বা বিষয়ে তার ঝোঁক বা অবস্থান কোথায়, সেটা বোঝাতে চেয়েছি আমরা। আগে যেমন ফলাফলের রিপোর্টে আমরা লিখে দিতাম—তুমি বাংলায় ৭৫ বা ‘এ’ গ্রেড পেয়েছ, ইংরেজিতে ৬০ বা ‘এ মাইনাস’ গ্রেড পেয়েছ— এই গ্রেডিং ও নম্বরের প্রক্রিয়াটা একেবারেই থাকবে না।

জাগো নিউজ: ষষ্ঠ-সপ্তমে মূল্যায়ন নিয়ে অনেক সমালোচনা। ২০২৬ সালে এসএসসিতে একই প্রক্রিয়ায় ‍মূল্যায়ন হবে বলে শোনা যাচ্ছে। তখনও কি তিনটি স্তর অর্থাৎ ত্রিভুজ, বৃত্ত, চতুর্ভুজ থাকবে?

অধ্যাপক মশিউজ্জামান: না না, এটাতে আমরা পরিবর্তন আনবো। নির্দিষ্ট কতগুলো বিষয় থাকবে। তার বিপরীতে পারফরম্যান্স ইনডিকেটর ইনডেক্স (পিআইআই) থাকবে। হয়তো সেখানে তিনটি, চারটি কিংবা পাঁচটি ইনডিকেটরও থাকতে পারে। সেগুলো মিলিয়ে সামারি (সংক্ষেপ) দাঁড় করানো হবে। সেটা হবে মূল মূল্যায়ন।

‘সব বাবা-মা সন্তান জন্মের পর, কেউ কেউ তো আগেই বলে রাখেন— আমার সন্তান বড় হয়ে ডাক্তার হবে, ইঞ্জিনিয়ার হবে। কী আশ্চর্য! ও (শিক্ষার্থী) কী চায়, ওর মস্তিষ্ক কী বলে, তা নিয়ে ভ্রুক্ষেপ নেই’

জাগো নিউজ: নম্বরের পরিবর্তে ইনডিকেটর বা চিহ্নে মূল্যায়ন… কেউ যদি ৫০-৬০ নম্বর পায়, সেটার জন্য একটি চিহ্ন থাকবে—বিষয়টি কী এমন?

অধ্যাপক মশিউজ্জামান: নম্বর বলেই কিছু থাকবে না। আমরা শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার মুখে ফেলবো না, মূল্যায়ন করবো। মূল্যায়ন হবে যোগ্যতা ও আগ্রহ বা ঝোঁকনির্ভর। এ যোগ্যতা পরিমাপ করার নির্দিষ্ট কতকগুলো পারফরম্যান্স ইনডিকেটর থাকবে। সেটার সূচকও উল্লেখ করা থাকবে।

নতুন শিক্ষাক্রম বাতিলের দাবিতে গণস্বাক্ষর কর্মসূচি করছেন অভিভাবকরা

জাগো নিউজ: সবগুলো বিষয়ের জিপিএ যোগ করে চূড়ান্ত ফল বের করা হয়। ইনডিকেটর বা চিহ্নগুলোর সূচক সংক্ষেপ করে যে চূড়ান্ত মূল্যায়ন করা হবে, সেটাকে এক কথায় কী বলা হবে? শিক্ষার্থী ত্রিভুজ পেয়েছেন, বৃত্ত পেয়েছেন— বিষয়টি কী এমন?

অধ্যাপক মশিউজ্জামান: মোটেও তেমনটা হবে না। শিক্ষার্থীর প্রাপ্ত সূচকগুলো মিলিয়ে চূড়ান্ত মূল্যায়নে তার আগ্রহটা বোঝানো হবে। কাউকে বলা হবে— তুমি খেলাধুলায় ভালো। তুমি এ পথে হাঁটতে পারো, ক্যারিয়ার গড়তে পারো। যদি তুমি খেলাধুলায় নাও যেতে পারো, সেক্ষেত্রে তোমার সংগীত বা গণিতে ভালো ঝোঁক। তুমি সংগীত বা গণিত পড়তে পারো। অর্থাৎ তাকে তার দক্ষতা বা আগ্রহের বিষয় বাতলে দেওয়া হবে।

আরও পড়ুন>> শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে থামছে না বুলিং, ‘শিকেয় তোলা’ নীতিমালা

জাগো নিউজ: চিহ্ন-সূচক দিয়ে ঠিক কি বোঝানো হচ্ছে, তা নিয়েও ধোঁয়াশা রয়েছে। খোদ শিক্ষকরাও জানেন না। অভিভাবক-শিক্ষার্থীদের বোঝাতেও পারেন না। বিষয়টি নিয়ে গুজবও রটছে। এটি কীভাবে রুখবেন?

অধ্যাপক মশিউজ্জামান: ত্রিভুজ, বৃত্ত, চতুর্ভুজের কথা বলছেন তো? এগুলো থাকবে না। আগামী পরীক্ষায় এগুলোও তুলে দেবো। সবাই মনে করছেন, ত্রিভুজটা তো মনে হয় সবচেয়ে উঁচু। তার মানে আমার সন্তান সবকটিতে ত্রিভুজ পেয়েছে, খুব উঁচুমানে রয়েছে। আনন্দে ফেসবুকে পোস্টও দিয়েছেন। এটা আমিও দেখেছি। এটা পরিবর্তন করবো। আগামী বছর যেটা সবচেয়ে খারাপ, সেটাকে ত্রিভুজ করে দেবো। যেটা সবচেয়ে ভালো, সেটিকে বৃত্ত করে দেবো। দেখি তখন তারা কী বলেন!

প্রশ্ন: এটা (ত্রিভুজ, বৃত্ত ও চতুর্ভুজ পদ্ধতি) কি মাধ্যমিক স্তরের সব শ্রেণি থেকে তুলে দেওয়া হবে? নাকি শুধুই এসএসসি-এইচএসসিতে?

অধ্যাপক মশিউজ্জামান: দেখুন— আমরা চাই না যে কোনোভাবে বাচ্চাদের গ্রেডিং বা শ্রেণিবিভক্ত করা হোক। আপনি কাউকে বলবেন যে, তুমি জিপিএ-৪ পেয়েছ, তুমি জিপিএ-৩ পেয়েছ, ২.৬ পেয়েছ..। মুশফিকুর রহিমকে আপনি বললেন যে, তুমি তো এইচএসসিতে জিপিএ-২.৬ পেয়েছ। আমি জিপিএ-৫ পেয়েছি। এর কোনো অর্থ হয়? আপনার কাছে মনে হয় এটার কোনো অর্থ আছে? আপনি কি সুপিরিয়র মুশফিকুর রহিমের চেয়ে ভালো? নিশ্চয়ই না। সেই জায়গা থেকেই চিন্তা করেন যে, কোনো একজন শিক্ষার্থীকে আমরা এতদিন ধরে যে বলেছি, তুমি জিপিএ-৫, তুমি গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছ, সুতরাং তুমিই সেরা।’

রাত জেগে বাড়ির কাজ করতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের

এটা কতটা ‘ননসেন্স’, ‘ইডিয়টিক’ ভাবুন। এগুলো করেছি আমরা। এভাবে কোনো শিক্ষার্থীকে আইডেনটিফাই করা ঠিক নয়। এটা করে আমরা অনেক ক্ষতি করেছি। এক লাখ শিক্ষার্থীকে উৎসাহ দিয়ে পুরস্কৃত করেছি। বাকি ১৯ লাখ বাচ্চাকে বলে দিয়েছি- তুমি খারাপ। আমরা ওই জায়গা থেকে সরে যেতে চাই।

প্রশ্ন: বাবা-মা সন্তানকে চিকিৎসক বা প্রকৌশলী বানাতে চান। কেউ শিক্ষক হতে চান। এমন শখ-আহ্লাদ থাকে অনেকের। সেই পথ কি তাহলে রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে?

অধ্যাপক মশিউজ্জামান: অবশ্যই রুদ্ধ হচ্ছে। আমরা তো এটাই দূর করতে চাইছি। সব বাবা-মা সন্তান জন্মের পর, কেউ কেউ তো আগেই বলে রাখেন— আমার সন্তান বড় হয়ে ডাক্তার হবে, ইঞ্জিনিয়ার হবে। কী আশ্চর্য! ও (শিক্ষার্থী) কী চায়, ওর মস্তিষ্ক কী বলে, তা নিয়ে ভ্রুক্ষেপ নেই। একজন শিক্ষার্থী গণিত সমাধানে খুব মজা পাচ্ছে। কেউ ইতিহাসের পাতায় পাতায় ঘুরতে এবং সন্ধান করতে পছন্দ করছে, কেউ সাহিত্য পড়তে এবং গল্প-কবিতা, উপন্যাস লিখতে পছন্দ করছে।

আরও পড়ুন>> স্কুল-কলেজে যৌন হয়রানি, প্রাইভেট-কোচিংয়েই ‘সর্বনাশ’

এসব থেকে সরিয়ে জোর করে তাকে ডাক্তার বানিয়ে দিচ্ছেন। সে কি ডাক্তার হলেও সেবাটা সঠিকভাবে মন থেকে দিতে পারবে? হয়তো কেউ পারবে। যদি দু-একজনও না পারে, তাহলে ক্ষতিটা কী হবে? তার হাতে চিকিৎসা নিয়ে প্রাণহানিও ঘটতে পারে। এ ধরনের পাগলামি-আজগুবি প্রক্রিয়া বন্ধ করে শিক্ষার্থী যা পছন্দ করে, তাকে তাই করতে দেওয়াটা আমাদের প্রধান লক্ষ্য। এতে বিষয়ভিত্তিক ক্যারিয়ার গড়ার অবারিত সুযোগ মিলবে।

শিক্ষাক্রম বাতিল দাবিতে গণস্বাক্ষর করছেন এক অভিভাবক/ছবি: জাগো নিউজ

জাগো নিউজ: এসএসসি বা এইচএসসি পাস করে পছন্দের সাবজেক্টে পড়ার সুযোগ পাবেন কীভাবে? বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রক্রিয়া পরিবর্তনে তো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি এখনো। এটি কি বড় গলদ থেকে যাচ্ছে না?

অধ্যাপক মশিউজ্জামান: এইচএসসি পর্যন্ত আমরা সব নতুন কারিকুলামে সাজিয়েছি। উচ্চশিক্ষার বিষয়টি নিয়ে অন্যরা কাজ করবেন। এটা তো আমাদের কাজ নয়। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত কাজ করছি। সেই প্রক্রিয়া নিশ্চয় সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) গ্রহণ করবে। আমি বলবো- দ্রুত সেটা শুরু করা হোক।

প্রশ্ন: আপনি বললেন— যার যে বিষয়ে আগ্রহ, তিনি সেটাতে পড়বেন। এতে কি উচ্চ শিক্ষাক্ষেত্রে নির্দিষ্ট বিভাগ পেতে বিড়ম্বনা বা ভোগান্তি বাড়বে না?

অধ্যাপক মশিউজ্জামান: দেখুন সাবজেক্ট বাছাই করে নেবে শিক্ষার্থী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়। এখন যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক খারাপ বিভাগ যেগুলো ভাবা হয়, সেই বিভাগ পেলেও সেখানে ভর্তিতে আগ্রহ বেশি শিক্ষার্থীদের। কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের নামকরা। সে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পছন্দের এবং ভালো সাবজেক্ট বিবেচিত হওয়া বিভাগে চান্স পেয়েও ছেড়ে চলে আসে। এটা অযৌক্তিক।

নতুন কারিকুলাম শিক্ষার্থীদের এ ধারণা থেকে সরিয়ে আনবে। প্রয়োজনে ঢাকার একজন শিক্ষার্থী পছন্দের বিভাগে পড়তে রাজশাহী বা চট্টগ্রামে যাবেন। চট্টগ্রামের একজন শিক্ষার্থী আগ্রহের বিভাগে পড়তে দিনাজপুর যাবেন। অথচ আপনি আমেরিকার দিকে তাকান, দেখবেন—কোনো শিক্ষার্থীর পছন্দের সাবজেক্ট তার স্টেটে নেই। সেজন্য তিনি পছন্দের বিষয়ে পড়তে অন্য স্টেটে চলে যাচ্ছেন। পৃথিবীর কোথাও একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সব সাবজেক্ট থাকে না। আগ্রহের বিষয়ে পড়তে প্রয়োজনে দূর-দূরান্তে যেতে হবে।

জাগো নিউজ: আপনার কথায় স্পষ্ট হচ্ছে, নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে অনেক আশার দিক রয়েছে। অভিভাবকরা এ নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন। তারা আন্দোলনেও নামছেন। হয়তো সতেনতার অভাবে এটা করতে পারে…।

অধ্যাপক মশিউজ্জামান: আমি এটাকে অভিভাবকদের অসচেতনতা বলবো না। সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা কখনোই অসচেতন হবেন না। তাদের প্রতিক্রিয়াকে আমি শ্রদ্ধা করি। অভিভাবক নাও বুঝতে পারেন। অভিভাবককে বুঝতে হবে, এ দায় কিন্তু তাদের নয়।

নতুন শিক্ষাক্রমে নিয়মিত ব্যবহারিক কাজ করছে শিক্ষার্থীরা

জাগো নিউজ: শিক্ষাক্রম নিয়ে অভিভাবকদের জানানো বা বোঝানোর দায়িত্বটা কার? তিন বছরেও সেটা সম্ভবই বা হলো না কেন?

অধ্যাপক মশিউজ্জামান: বোঝা ও বোঝানোর দায়িত্ব শিক্ষকদের। কারণ শিক্ষকরা চাকরি করেন, বেতন নেন। তিনি এটা বুঝবেন না, তা তো হবে না। তাকে বুঝতেই হবে। চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে বুঝতে। শিক্ষকরা যখন কনফিউজিং কথা বলেন, তখন অভিভাবকরা কনফিউজড হন, আতঙ্কিত হন। তারা সভা-সমাবেশ করতে চান, আন্দোলনে নেমে যান। প্রয়োজনে অবরোধ করবেন। সব বন্ধ করে দেবেন। সেটা তারা করতেই পারেন, এটা তাদের অধিকার।

জাগো নিউজ: শিক্ষকরাও অভিভাবকদের পক্ষে রয়েছেন। তারাও নেপথ্যে থেকে শিক্ষাক্রম বাতিলের আন্দোলনে রসদ জোগাচ্ছেন। এর কারণ কী?

অধ্যাপক মশিউজ্জামান: কিছু স্বার্থান্বেষী শিক্ষক এটায় জড়িত। তাদের মধ্যে মেধাবী শিক্ষকও রয়েছেন। যারা প্রচুর পরিমাণে প্রাইভেট পড়ান, কোচিং বাণিজ্য করেন। তা থেকে মাসে দু-তিন লাখ টাকা আয় করেন। তার যখন প্রাইভেট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তিনি তো এটার বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগবেনই। এখানে অভিভাবকদেরও দায় রয়েছে। তাদের কাছে কোন শিক্ষক ভালো? যিনি প্রাইভেট পড়ান, বাড়তি নম্বর দিয়ে সন্তানের ভালো রেজাল্ট করিয়ে দেন। যে শিক্ষক প্রাইভেট পড়ান না অথচ খুব মেধাবী-সৎ, তার নামটাও কেউ জানেন না।

জাগো নিউজ: অসংখ্য শিক্ষক প্রশিক্ষণ পাননি। দুই মাস পর থেকেই তাদের সব শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম পড়াতে হবে। এমন অবস্থায় শিক্ষকদের দায় দেওয়াটা কতটা যৌক্তিক?

অধ্যাপক মশিউজ্জামান: প্রশিক্ষণ দেওয়া তো অধিদপ্তরগুলোর কাজ। মাউশি, মাদরাসা অধিদপ্তর, কারিগরি অধিদপ্তরের কাজ। শিক্ষকদের সঙ্গে আমাদের (এনসিটি) প্রত্যক্ষ কোনো সম্পর্ক নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও আমরা নিয়ন্ত্রণও করি না।

তাদের উচিত যেসব শিক্ষক বোঝেননি, তাদের বোঝানোর ব্যবস্থা করা। রাষ্ট্র সেভাবেই জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে (এনসিটিবি) দাঁড় করিয়েছে। আমরা কারিকুলাম তৈরি করি, পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করি। অধিদপ্তরগুলোর দায়িত্ব হলো- সেগুলো শিক্ষকদের বুঝিয়ে দেওয়া, প্রশিক্ষণ দেওয়া। যার যে কাজ, সেটা করতে হবে।

জাগো নিউজ: মূল্যায়নে শিক্ষকরা কতটা নিরপেক্ষ থাকবেন, তা নিয়ে সংশয়ে অভিভাবকরা। শিক্ষকদের কি কাউকে বাড়তি সুবিধা দেওয়ার সুযোগ নতুন শিক্ষাক্রমে আছে?

অধ্যাপক মশিউজ্জামান: শিক্ষকরা মাত্র একবার মূল্যায়ন করেছেন। সেটা ষান্মাষিকে। সামনে নভেম্বরে তারা সামষ্টিক মূল্যায়ন করবেন। দ্বিতীয় দফায় মূল্যায়ন করলে অনেক কিছু স্পষ্ট হয়ে যাবে। এখানে পক্ষপাতিত্ব বা বাড়তি সুবিধা দেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ ম্যানুয়ালি এটা থাকবে না। ২০২৪ সাল থেকে অ্যাপসের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হবে। শিক্ষকরা নির্দিষ্ট জায়গায় সূচকগুলো উল্লেখ করলেই তা অ্যাপস সংক্ষেপ করে দেবে। তাতে শিক্ষকদের কষ্ট ও সময় কমবে।

নতুন শিক্ষাক্রমে নিয়মিত ব্যবহারিক কাজ করছে শিক্ষার্থীরা

প্রশ্ন: শিক্ষাবিদরাও নতুন কারিকুলাম নিয়ে সমালোচনা করছেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ও সমাজ কিংবা রাষ্ট্রব্যবস্থায় এ কারিকুলাম মুখ থুবড়ে পড়বে বলছেন অনেকে। আপনি কী মনে করেন?

অধ্যাপক মশিউজ্জামান: নতুন একটা জিনিস। শত বছর ধরে আমরা পরীক্ষা পদ্ধতিতে শিক্ষাব্যবস্থা চালাচ্ছি। সেখানে নম্বর, জিপিএ ছিল। সেখান থেকে যখন শিফটিং করছি, সেটা শিক্ষাবিদ বলুন আর শিক্ষক-অভিভাবক বলুন; একবারে কেউ বুঝে যাবেন বা মেনে নেবেন, সেই প্রত্যাশা আমরা করছিও না।

সবশেষ যেটা বলবো- কারিকুলাম কোনো সায়েন্স না যে একবারে কাঠামো দাঁড় করিয়ে সফল করে ফেলবো। আমেরিকা যখন মহাকাশ যান পাঠায়, মাঝে মধ্যে সেটাও ব্যর্থ হয়। এটা (ব্যর্থ হওয়া) ঘটতেই পারে। সব ক্ষেত্রে অনেকগুলো ট্রায়াল করতে হয়। আমিও ট্রায়াল প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে এগিয়ে যাবো। সব পক্ষকে বলবো- আমাদের একটু সময় দেন, আস্থা রাখুন।

এএএইচ/এএসএ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।