হতাশ বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা
পিএসসি-মন্ত্রণালয় ‘ঠেলাঠেলিতে’ আটকা ইন্সট্রাক্টর-এটিইও নিয়োগ
#চাকরিপ্রত্যাশী ৩৮ হাজার প্রার্থী ‘নিরুপায়’
#প্রার্থীদের মামলার তথ্যও দেয় না পিএসসি
#একে-অন্যকে দায় দিচ্ছে মন্ত্রণালয়-পিএসসি
#ক্ষুব্ধ-হতাশ বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান-প্রজন্ম
সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে একটি সমন্বিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এতে তিন শতাধিক শূন্যপদে আগ্রহী প্রার্থীদের আবেদন চাওয়া হয়। বিজ্ঞপ্তিতে নবম গ্রেডের ৭২ জন পিটিআই ইন্সট্রাক্টর ও ১৭ জন সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা (এটিইও) নিয়োগের কথা ছিল। এ পদগুলো বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রজন্মের জন্য সংরক্ষিত। অথচ প্রায় ছয় বছর পার হলেও এসব পদে নিয়োগ সম্পন্ন হয়নি। মামলার কারণে ঝুলে আছে নিয়োগপ্রত্যাশী বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের ভাগ্য। এ মামলা কে নিষ্পত্তি করবে, তা নিয়ে একে-অন্যকে ‘দোষারোপ’ করছেন পিএসসি ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা বলছেন, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে পিএসসি। কোনো মামলা হলে তারাই নিষ্পত্তি করবেন। যদি কোনো প্রার্থীর জমা দেওয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদে কোনো সন্দেহ-সংশয় থাকে, সেটা যাচাই করবে মন্ত্রণালয়। বাকি সব কাজ পিএসসির।
‘আবেদন করেছি ছয় বছর হলো। আবেদন করেই শেষ। নিয়োগ প্রক্রিয়া আর এগোয়নি। যে বিজ্ঞপ্তিতে এটিইও পদে নিয়োগের আবেদন চাওয়া হয়, ওই বিজ্ঞপ্তির দুটি পদ বাদে সব পদের পরীক্ষা হয়ে গেছে। অনেক পদে নিয়োগও শেষ। তারা চাকরি করছেন। ঝুলে আছেন শুধু বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা’
পিএসসি কর্মকর্তাদের দাবি, যে মামলায় ইন্সট্রাক্টর ও এটিইও নিয়োগ আটকে আছে, তা নিষ্পত্তির দায়িত্ব মন্ত্রণালয়ের। এটা তাদের কাজ নয়। মন্ত্রণালয় যথাযথ পদক্ষেপ না নিয়ে তাদের দেওয়া চিঠি পাঠাচ্ছে পিএসসিতে। এতে নিয়োগ প্রক্রিয়ার জটিলতা কাটবে না।
আরও পড়ুন>> পদোন্নতির সুযোগ কমছে এটিইওদের, প্রাথমিকের মাঠ পর্যায়ে হতাশা
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৮ সালের ২৪ জানুয়ারি ৩০৭টি শূন্যপদে সমন্বিত একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। বিজ্ঞপ্তির ক্রমিক নম্বর-২৪-এর ১১তম ইউনিটে নবম গ্রেডের পিটিআই ইন্সট্রাক্টরের ৭২টি শূন্যপদে আবেদন চাওয়া হয়। একই বিজ্ঞপ্তির ক্রমিক নম্বর ৪৬-এর ১১তম ইউনিটে সহকারী উপজেলা/থানা শিক্ষা কর্মকর্তার ১৭টি শূন্যপদে আগ্রহী প্রার্থীদের আবেদন চাওয়া হয়। এটিইও নবম গ্রেডের নন-ক্যাডার পদ। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর পিএসসির কাছে এ জনবল চায়।
পিএসসি সূত্র ও প্রার্থীরা জানান, বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর এটিইও পদে প্রায় ২০ হাজার এবং পিটিআই ইন্সট্রাক্টর পদে ১৮ হাজারের মতো আবেদন জমা পড়ে। তবে কোনো পরীক্ষা বা পরীক্ষার তারিখ আজও জানানো হয়নি। গত ছয় বছরেও প্রার্থীরা বারবার পিএসসিতে ধরনা দিলেও কোনো সদুত্তর পাননি। তাদের জানানো হয়েছে, ‘মামলা হওয়ায় নিয়োগ আটকে আছে।’ কীসের মামলা, কে মামলা করেছেন, সবশেষ অবস্থা কী- তার কিছুই জানানো হয়নি প্রার্থীদের। ফলে এ নিয়ে পুরোপুরি অন্ধকারে চাকরিপ্রত্যাশী বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা।
‘বীর মুক্তিযোদ্ধা সন্তান ও প্রজন্মের পক্ষ থেকে তাদের জন্য পিএসসিতে কয়েকবার গেছি। চেয়ারম্যানকেও অনুরোধ করেছি, কোনো অগ্রগতি নেই। মামলাসহ নানা উছিলায় তারা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রজন্মের জন্য সংরক্ষিত পদগুলোতে নিয়োগ আটকে রেখেছেন। মন্ত্রণালয় ও পিএসসির কাছে আমাদের দাবি- বিষয়টি দ্রুত সুরাহা করে নিয়োগ সম্পন্নের উদ্যোগ নেওয়া হোক’
দীর্ঘদিনেও নিয়োগ না হওয়ায় হতাশ প্রার্থীরা। বীর মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের জন্য সংরক্ষিত কোটায় নিয়োগ প্রক্রিয়ায়ও এমন হয়রানিতে ক্ষুব্ধ তারা। ঝুলে থাকা চাকরিপ্রত্যাশীদের একজন এস এম মাহবুব হোসেন। বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম ফজলুল করিম। মাহবুব গাজীপুরের ভাওয়াল বদরে আলম কলেজ থেকে ২০১৫ সালে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। ২০১৮ সালে এটিইও পদে আবেদন করেও নিয়োগ প্রক্রিয়া না এগোনোয় বেকার জীবন কাটছিল তার। সম্প্রতি শেরপুরে একটি কমিউনিটি ক্লিনিকে খণ্ডকালীন চাকরি করছেন মাহবুব।
আরও পড়ুন>> নিয়োগে বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের বয়সসীমা মানছে না সরকারি দপ্তর
এটিইও প্রার্থী এস এম মাহবুব জাগো নিউজকে বলেন, ‘আবেদন করেছি ছয় বছর হলো। আবেদন করেই শেষ। নিয়োগ প্রক্রিয়া আর এগোয়নি। যে বিজ্ঞপ্তিতে এটিইও পদে নিয়োগের আবেদন চাওয়া হয়, ওই বিজ্ঞপ্তির দুটি পদ বাদে সব পদের পরীক্ষা হয়ে গেছে। অনেক পদে নিয়োগও শেষ। তারা চাকরি করছেন। ঝুলে আছেন শুধু বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা।’
‘অন্য প্রার্থীরা এক মামলা করে বসায় ওই দুটি পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া আটকে আছে। এ মামলা নিষ্পত্তি করবে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়। আইনি জটিলতা কাটলে আমরা তখন এটা নিয়ে এগোবো’
পিএসসির আচরণে ক্ষুব্ধ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কয়েকবার আমরা (এটিইও প্রার্থী) পিএসসিতে গেছি। চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করেছি। উনি শুধু বলেন- মামলার কারণে নিয়োগ আটকে আছে। কোন মামলা, কীসের মামলা, মামলার অবস্থা কী- এসব কিছুই বলেন না। যারা দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন, তাদের সন্তান ও প্রজন্মকে নিয়োগে এমন মূলা ঝুলিয়ে রাখাটা লজ্জাজনক।’
এটিইও পদে আরেক প্রার্থী মাহমুদুল হাসান রনি। ঢাকা কলেজ থেকে স্নাতক-স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন তিনি। থাকেন রাজধানীর আজিমপুরে। তিনি বলেন, ‘বিজ্ঞপ্তির পর আবেদন করে প্রত্যাশা ছিল- চাকরিটা হবে। কিন্তু ছয় বছরেও নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে কোনো কথাই শুনলাম না। বেকার থাকা তো সম্ভব নয়। বাধ্য হয়ে এখন একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছি।’
মুক্তিযোদ্ধা সন্তান ও প্রজন্মের চিঠিতে ‘নড়াচড়া’
দীর্ঘদিন নিয়োগ আটকে থাকায় সমস্যা সমাধান করে প্রক্রিয়া শুরুর পদক্ষেপ নিতে সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন ‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রজন্ম’র কেন্দ্রীয় কমান্ডের সভাপতি অহিদুল ইসলাম তুষার। ৫ জুলাই মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর এ আবেদন করেন তিনি। তার আবেদন যাচাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে গত ২৮ আগস্ট তা পিএসসিতে পাঠিয়েছে মন্ত্রণালয়। তবে পিএসসি বলছে, এখনো তারা চিঠি পাননি। হাতে পেলেই চিঠির জবাব দেওয়া হবে।
‘মামলা নিষ্পত্তি আমাদের কাজ হবে কেন? বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে পিএসসি। মামলা হলে তারা সেটা নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেবে। মন্ত্রণালয় এটা করতে যাবে কেন?’
মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব আসিফ মাহমুদের সই করা যে চিঠিটি পিএসসিতে পাঠানো হয়েছে, তাতে বলা হয়, পিটিআই ইন্সট্রাক্টর ও সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার পদে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের প্রায় ছয় বছর অতিবাহিত হতে চললেও নিয়োগের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না, যা আবেদনকারীদের মধ্যে নানা উৎকণ্ঠা ও হতাশা বিরাজ করছে মর্মে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রজন্মের কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সভাপতি অহিদুল ইসলাম তুষারের আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এ আবেদনের বিষয়ে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণের জন্য আবেদনটি নির্দেশক্রমে অগ্রায়ণ করা হলো।
আরও পড়ুন>> বদলির ক্ষমতা ফিরে পেল প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর
এদিকে, পিএসসির চেয়ারম্যান, সচিব, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রককেও (নন-ক্যাডার) একই দাবি জানিয়ে গত ৮ সেপ্টেম্বর চিঠি দেন মুক্তিযোদ্ধা সন্তান ও প্রজন্মের সভাপতি অহিদুল ইসলাম তুষার। তার এ চিঠির পর থমকে থাকা এ নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে কিছুটা ‘নড়াচড়া’ দেখা গেছে পিএসসিতে।
অহিদুল ইসলাম তুষার জাগো নিউজকে বলেন, ‘ছয় বছর ধরে একটা নিয়োগ প্রক্রিয়া ঝুলে আছে। আমাদের ভাই-বোন যারা বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, তারা হতাশাগ্রস্ত। মুক্তিযোদ্ধা সন্তান ও প্রজন্মের পক্ষ থেকে তাদের জন্য পিএসসিতে কয়েকবার গেছি। চেয়ারম্যানকেও অনুরোধ করেছি, কোনো অগ্রগতি নেই। মামলাসহ নানা উছিলায় তারা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রজন্মের জন্য সংরক্ষিত পদগুলোতে নিয়োগ আটকে রেখেছেন। মন্ত্রণালয় ও পিএসসির কাছে আমাদের দাবি- বিষয়টি দ্রুত সুরাহা করে নিয়োগ সম্পন্নের উদ্যোগ নেওয়া হোক।’
মন্ত্রণালয়-পিএসসির ‘ঠেলাঠেলি’
ছয় বছর ধরে আটকে থাকা নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে প্রার্থীদের জন্য কোনো আশার খবরই নেই। উল্টো মন্ত্রণালয় ও পিএসসির কর্মকর্তারা একে অন্যের ঘাড়ে দায়িত্ব চাপাচ্ছেন।
মুক্তিযোদ্ধাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা (গেজেট) মো. আব্দুল লতিফ। তিনি প্রত্যায়ন শাখায়ও অতিরিক্ত দায়িত্বে রয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে আব্দুল লতিফের কণ্ঠে বিস্ময়। তিনি বলেন, ‘মামলা নিষ্পত্তি আমাদের কাজ হবে কেন? বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে পিএসসি। মামলা হলে তারা সেটা নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেবে। মন্ত্রণালয় এটা করতে যাবে কেন?’
তিনি বলেন, ‘কোনো প্রার্থীর জমা দেওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবা/মা বা নানা-নানি, দাদা-দাদির সনদ নিয়ে সংশয় থাকলে তা ঠিক আছে কি না, সেটা আমরা যাচাই করে দেই পিএসসিকে। মামলা তো কোনো দিনই আমরা দেখি না। মামলা দেখার কাজ অবশ্যই পিএসসির।’
নন-ক্যাডার কোটায় নিয়োগের ক্ষেত্রে জটিলতা হলে তা নিয়ে কাজ করেন পিএসসির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক শাখার ইউনিট-১১-এর কর্মকর্তারা। এ ইউনিটের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘অন্য প্রার্থীরা এক মামলা করে বসায় ওই দুটি পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া আটকে আছে। এ মামলা নিষ্পত্তি করবে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়। আইনি জটিলতা কাটলে আমরা তখন এটা নিয়ে এগোবো।’
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে পিএসসিতে চিঠি দেওয়ার বিষয়টি দৃষ্টিগোচর করা হলে তিনি বলেন, ‘এটা কেন তারা পাঠালেন তা বোধগম্য নয়। নিজেদের কাজ, এখানে কেন চিঠি ফরোয়ার্ড করেছেন, তা জানি না। যদিও চিঠি আমরা পাইনি। হয়তো আমাদের হাতে এখনো পৌঁছায়নি। হাতে পেলে আমরাও জবাব পাঠাবো।’
এএএইচ/এএসএ/এএসএম