‘স্ত্রী মনে করে স্বামী অযোগ্য, সন্তান বলে প্রমোশন পাওনা কেন বাবা’
‘বছরের পর বছর চাকরি করেও আমরা একই পদে। যোগ্যতা থাকলেও পদোন্নতি নেই। এমন সমস্যায় প্রতিনিয়ত আমরা পারিবারিক ও সামাজিকভাবে হেয় হচ্ছি। কারও স্ত্রী মনে করেন হয়তো তার স্বামীর যোগ্যতা নেই। সন্তানরা এসে বলে-আমার অমুক বন্ধুর বাবা বা মা প্রমোশন (পদোন্নতি) পেয়েছেন। তুমি প্রমোশন পাও না কেন বাবা? আমরা বছরের পর বছর এসব প্রশ্নে নিশ্চুপ। স্ত্রী-সন্তান তথা পরিবারকে কোনো জবাব দেওয়ার মুখ আমাদের নেই।’
কথাগুলো বলছিলেন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন ‘বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি’র সভাপতি অধ্যাপক মো. শাহেদুল খবির চৌধুরী। পদোন্নতিজট, পদসৃজন, ক্যাডার কম্পোজিশনের সুরক্ষা, স্কেল আপগ্রেডেশন ও আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসনের দাবিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।
মঙ্গলবার (৫ সেপ্টেম্বর) জাতীয় প্রেস ক্লাবে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির মহাসচিব মো. শওকত হোসেন মোল্যা।
লিখিত বক্তব্যে শওকত হোসেন মোল্যা বলেন, শিক্ষার রূপান্তরের অন্যতম কারিগর বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা। তারাই প্রণয়ন করেছেন নতুন শিক্ষাক্রম। এ শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নেও তারাই অন্যতম শক্তি। কিন্তু প্রাপ্য অধিকার ও সুবিধা থেকে বঞ্চিত তারা। পদোন্নতির সব যোগ্যতা অর্জন সত্ত্বেও বছরের পর বছর শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা পদোন্নতি পাচ্ছেন না।
তিনি বলেন, ২৯ বছর চাকরি করেও সহযোগী অধ্যাপক থেকে অবসরে যাচ্ছেন এ ক্যাডারের কর্মকর্তারা। এ মুহুর্তে শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতিযোগ্য কর্মকর্তার সংখ্যা ৭০০০ জন। এর মধ্যে অধ্যাপক পদে ১৬তম থেকে ২০তম বিসিএস পর্যন্ত পদোন্নতি যোগ্য কর্মকর্তা আছেন ১২০০ জন। সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক পদে ২৪তম থেকে ২৭তম বিসিএস পর্যন্ত পদোন্নতি যোগ্য কর্মকর্তা আছেন প্রায় ৩০০০ জন। যারা চাকরির ১৬-১৯ বছর পার করেছেন। প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতিযোগ্য ৩১তম থেকে ৩৫তম ব্যাচ পর্যন্ত পদোন্নতি যোগ্য কর্মকর্তা আছেন প্রায় ৩০০০ জন। যারা ৮-১১ বছর প্রভাষক হিসেবে আছেন। এ বিশাল সংখ্যক কর্মকর্তার পদোন্নতির জন্য সরকারের কোনো অতিরিক্ত অর্থ প্রয়োজন নেই। সবাই পদোন্নতিযোগ্য পদের বেতন স্কেলের সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে গেছেন।
অন্যান্য ক্যাডারে পদোন্নতির ক্ষেত্রে ব্যাচভিত্তিক উচ্চতর গ্রেডে পদোন্নতি দেওয়া হয় উল্লেখ করে শওকত হোসেন বলেন, ‘শিক্ষা ক্যাডারে এটা অনুসৃত না হওয়ায় অন্যান্য ক্যাডারের ভুলনায় শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা পিছিয়ে আছেন। বেতন স্কেল অনুযায়ী চতুর্থ ও ষষ্ঠ গ্রেড প্রাপ্য কর্মকর্তাদের প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে এক বছর আগে। কিন্তু এ বিষয়েও কোনো অগ্রগতি নেই।
ছুটির ফাঁদে শিক্ষাব্যবস্থা
বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির মহাসচিব বলেন, শিক্ষা ক্যাডারকে অবকাশমুক্ত করা জরুরি। বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থা ছুটির ফাঁদে পড়েছে। বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সপ্তাহে দুদিন ছুটি ভোগ করে। আবার অবকাশ বিভাগ বিধায় অবকাশকালীন ছুটি বছরে ৫৫ দিন ভোগ করে। তাতে দেখা যায়-বছরের প্রায় ৫০ শতাংশ সময় ক্লাস বন্ধ থাকে। উচ্চ মাধমিক পরীক্ষা, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা সব মিলিয়ে বছরে শ্রেণি কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সিলেবাস শেষ হচ্ছে না।
‘অন্যদিকে অর্জিত ছুটি পাওয়ার পক্ষে জোরালো যুক্তি থাকার পরও বঞ্চিত হচ্ছেন শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা। ২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রী অর্জিত ছুটির বিষয়টি একমাসের মধ্যে নিষ্পত্তির আদেশ দেন। কিন্তু প্রশাসনের অনীহায় সেটি এখনও আলোর মুখ দেখেনি’ বলেন শওকত হোসেন মোল্যা।
শিক্ষা ক্যাডারে বিশৃঙ্খলার নেপথ্যে
শিক্ষা ক্যাডারে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কারণ হিসেবে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, অধ্যাপক পদটি তৃতীয় প্রেডে উন্নীত করা এবং আনুপাতিক হারে প্রথম ও দ্বিতীয় গ্রেডের পদ সৃষ্টি করা জরুরি। শিক্ষা ক্যাডারে গ্রেড-১-এর একটি পদ থাকলেও পদ সোপান না থাকার কারণে অর্থাৎ দ্বিতীয় ও তৃতীয় গ্রেডের পদ সৃষ্টি না হওয়াতে সেখানে এসএসবি করে পদোন্নতির মাধ্যমে পদায়ন করা যাচ্ছে না। দ্বিতীয় গ্রেডের তিনটি অতিরিক্ত মহাপরিচালকের পদ সৃজনের প্রক্রিয়া দীর্ঘসূত্রিতায় আটকে আছে।
বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির মহাসচিব বলেন, অন্য ক্যাডার কর্মকর্তারা পঞ্চম গ্রেড থেকে তৃতীয় গ্রেডে পদোন্নতি পান। কিন্তু শিক্ষা কাডারে সর্বোচ্চ পদ অধ্যাপক পদটি চতুর্থ গ্রেড হওয়ায় শিক্ষা ক্যাডারের পঞ্চম গ্রেড হতে তৃতীয় গ্রেডে পদোন্নতির সুযোগ নেই। চতুর্থ গ্রেডেই আটকে থাকছেন। ২০১৫ সালের পে-স্কেলের বিধান অনুযায়ী-সহকারী অধ্যাপক হতে অধ্যাপক পর্যন্ত অনেকেই চতুর্থ গ্রেডে আছেন। ফলে শিক্ষা ক্যাডারের বিশৃঙ্খলা তৈরি হচ্ছে।
‘ক্ষমতাহীন’ মাউশি
বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি মনে করে মাউশিকে ক্ষমতায়নের পরিবর্তে ক্ষমতাহীন করা হয়েছে। অধীনস্ত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি প্রদান, এমনকি অধীনস্ত কর্মকর্তাদের বদলির পূর্ণ ক্ষমতাও মাউশির নেই। ফলে পদোন্নতির জন্য মন্ত্রণায়ের ওপর নির্ভর করতে হয়। বদলি নীতিমালা থাকলেও তা কার্যকর হচ্ছে না।
বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের দাবি-মাউশিতে প্রয়োজনীয় পদসৃজনসহ মাউশিকে ক্ষমতায়ন করতে হবে। সব স্তরে পদোন্নতি ও বদলির ক্ষমতা মাউশিকে দিতে হবে। অন্য ক্যাডারের মতো বদলি নীতিমালা কার্যকর করতে হবে।
দ্রুত এসব পদোন্নতিজট, পদসৃজন, আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসনে পদক্ষেপ না নিলে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডাররা কঠোর কর্মসূচি দেবে বলেও হুঁশিয়ার করেন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির নেতারা।
এএএইচ/এমআইএইচএস