‘শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ক্ষতিগ্রস্ত করছে বিসিএস পরীক্ষা’
‘গ্রন্থাগারগুলোতে সাধারণত বাইরে থেকে বই নিয়ে গিয়ে পড়ার সুযোগ থাকে না অথবা পড়ার প্রয়োজনও নেই। যে কোনো লাইব্রেরিতে হাজার হাজার বই সুসজ্জিত থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে লাখ লাখ বই রয়েছে পড়ার জন্য। কিন্তু আমরা ইদানীং দেখতে পাচ্ছি শিক্ষার্থীরা এসব গ্রন্থাগারকে পাঠচক্র হিসেবে ব্যবহার করছেন এবং তারা গ্রন্থাগারের বই না পড়ে বাইরে থেকে চাকরির বই নিয়ে পড়ছেন। গ্রন্থাগারে গিয়ে বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি দুঃখজনক।’
কথাগুলো বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। জাগো নিউজের সঙ্গে তিনি কথা বলেন বর্তমান সময়ের পড়াশোনার ধরন, চাকরিব্যবস্থা, বিসিএস প্রভৃতি বিষয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ: সরকারি কর্ম কমিশন (বিসিএস) পরীক্ষায় ঝুঁকছে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরাও। সব শিক্ষার্থীই এখন এই পরীক্ষামুখী। ৪০তম বিসিএস পরীক্ষার ফলাফলে জনপ্রশাসন ক্যাডারে ২৪৫ জনের মধ্যে ৫৫ জন কৃতকার্য হয়েছেন বুয়েট থেকেই। বিষয়টি নিয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।
আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক: বিসিএস পরীক্ষায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাই অংশ নিতে পারেন। আর ফলাফল নিয়ে আসলে তো কিছু বলার থাকে না অভিনন্দন জানানো ছাড়া।
আরও পড়ুন>> ‘শিক্ষার গলদ জাতিকে মূর্খ বানাচ্ছে’
বিসিএস প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ চাকরি। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি প্রকৌশল, চিকিৎসা, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও অংশ নেন। মেধাবী সব শিক্ষার্থীই এমন চাকরির প্রত্যাশা করতে পারেন। নিয়মের মধ্যে থেকে কৃতকার্য হলে তাদের সফলতা কামনা করতেই হয়। এর বাইরেও শিক্ষার্থীরা বিভিন্নভাবে সফলতার সাক্ষর রাখছেন। দেশের বাইরেও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা অধ্যয়ন করছেন।
জাগো নিউজ: পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সমৃদ্ধ লাইব্রেরি আছে। লাখ লাখ বই আছে সেখানে। শিক্ষার্থীরা সে সব বইয়ে হাত না দিয়ে চাকরির বই পড়ছে সেখানে গিয়ে।
আরেফিন সিদ্দিক: গ্রন্থাগারগুলোতে সাধারণত বাইরে থেকে বই নিয়ে গিয়ে পড়ার সুযোগ থাকে না অথবা পড়ার প্রয়োজনও নেই। যে কোনো লাইব্রেরিতে হাজার হাজার বই সুসজ্জিত থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে লাখ লাখ বই রয়েছে পড়ার জন্য।
কিন্তু আমরা ইদানীং দেখতে পাচ্ছি শিক্ষার্থীরা এসব গ্রন্থাগারকে পাঠচক্র হিসেবে ব্যবহার করছেন এবং তারা গ্রন্থাগারের বই না পড়ে বাইরে থেকে চাকরির বই নিয়ে পড়ছেন। গ্রন্থাগারে গিয়ে বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি দুঃখজনক। সেখানে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে বই কেনা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের মেধার উৎকর্ষ সাধনের জন্য। চাকরির জন্য বাজারের গাইড বই নিয়ে সেখানে পড়বে কেন? কেন সত্যিকার পড়ুয়ারা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
আরও পড়ুন>> ‘সম্মান দিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবীরাই প্রাইমারির শিক্ষক হবেন’
বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী রয়েছেন, যারা একাডেমিক বই লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়েন। অথচ চাকরিপ্রত্যাশীদের জন্য এসব শিক্ষার্থী সেখানে গিয়ে জায়গা পান না। ভোর থেকেই সিরিয়াল ধরে জায়গা বুক দেওয়া হয়। আমি মনে করি, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
তবে চাকরিপ্রত্যাশীদের অভিযোগ হচ্ছে, তারা পাঠচক্র করার মতো উপযুক্ত জায়গা পান না। তাদের এ অভিযোগও সত্য। কিন্ত তাই বলে তো লাইব্রেরির জায়গা গণহারে দখল করে পাঠচক্র চলতে পারে না।
জাগো নিউজ: সব শিক্ষার্থী চাকরিমুখী। পরিবার থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সবাই ঠেলে দিচ্ছে চাকরির দিকে। আমরা যাচ্ছি কোথায়?
আরেফিন সিদ্দিক: চাকরির ক্ষেত্রে বেশ অসমতা রয়েছে। এ অসমতা থাকার কারণেই তীব্র প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হচ্ছে। একজন বিসিএস ক্যাডার যে সম্মান, সুযোগ-সুবিধা পান তা অন্য পেশার লোকেরা সাধারণত পান না।
আরও পড়ুন>> ‘সব সুবিধা আমলারা পান, শিক্ষার উন্নয়ন ঘটবে কীভাবে?’
সব পেশার সম্মান আর সুবিধা কাছাকাছি করা সময়ের দাবি। বিসিএসের মতো অন্য পেশার মর্যাদা বাড়াতে হবে। তাহলে এই ঝোঁক এমনিতেই কমে যাবে।
জাগো নিউজ: এই যে সম্মানের অসমতা, এর জন্য মূলত কোন বিষয়কে দায়ী করবেন? শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি নাকি রাষ্ট্র ব্যবস্থার?
আরেফিন সিদ্দিক: শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটিকে এর জন্য দায়ী করা যায় না। শিক্ষা তো নির্ধারণ করে দিচ্ছে না, তুমি বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিও। রাষ্ট্র, সমাজ এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে। একজন পুলিশ কর্তা যে সম্মান পাচ্ছেন, একজন শিক্ষক সে সম্মান পাচ্ছেন না। এর জন্য তো শিক্ষাকে দায়ী করা যায় না।
জাগো নিউজ: এই সম্মান তৈরি করে দিলো কে? অর্থ?
আরেফিন সিদ্দিক: একজন চিকিৎসক দেখছেন তার প্রশাসনিক কর্মকর্তা হচ্ছেন বিসিএস ক্যাডার। একজন প্রকৌশলী দেখছেন তার চেয়ে কম মেধাবী তার প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং তাকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। তখন ওই চিকিৎসক নিজেও বিসিএস ক্যাডার হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। অর্থ একটি কারণ। তবে অর্থই মূল কারণ নয়। ক্ষমতার কাঠামো মূল কারণ।
জাগো নিউজ: আজ থেকে দুই দশক আগেও মানুষ এমন চাকরির জন্য মরিয়া হয়নি। কী ঘটলো এখন?
আরেফিন সিদ্দিক: মানুষ তার দায়িত্ববোধ থেকে সরে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে পাকিস্তান আমলেও সরকারি কর্ম কমিশনে যোগদান করেছেন। কিন্ত এখন এই প্রবণতা বেড়েছে। সবাই ব্যস্ত সরকারি চাকরির জন্য।
সম্মান সবাইকে করতে হবে। প্রত্যেক পেশার মানুষকে সম্মান জানাতে পারলে বিসিএস প্রস্তুতি নিয়ে শিক্ষার্থীরা মরিয়া হবে না। সার্ভিস ক্যাডার নিয়ে আমরা পরিবর্তন আনতে পারিনি। এই কাঠামোর পরিবর্তন দরকার।
জাগো নিউজ: বিসিএস ঘোরে আট থেকে দশ বছর কাটিয়ে দিচ্ছেন লাখ লাখ শিক্ষার্থী। ক্যাডার হচ্ছেন হাতে গোনা কয়েকশ। মেধার এই অপচয়ে জাতির ভবিষ্যৎ?
আরেফিন সিদ্দিক: চাকরির এমন বাজার শিক্ষার মৌলিক জায়গা ভয়ংকরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। যে উদ্দেশ্যে ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দিলাম, তা আর দেখতে পাচ্ছি না। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ক্ষতিগ্রস্ত করছে বিসিএস পরীক্ষা। আমরা সব পেশাকে সম্মান জানাতে পারলে এমন হতো না। মানুষের স্বাধীনতা থাকতেই পারে। কিন্তু এভাবে ঝুঁকে পড়াটা জাতির জন্য বড় ক্ষতি বয়ে আনছে। বিসিএস ক্যাডার হতেই হবে এ মানসিকতা থেকে শিক্ষার্থীরা বেরিয়ে আসতে না পারলে মেধার আরও অপচয় হবে।
এএসএস/এএসএ/এএসএম