বিশেষজ্ঞদের অভিমত
শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া দেশগুলো এসডিজি বাস্তবায়নে পিছিয়ে পড়বে
কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বিশ্বজুড়ে শিক্ষা কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। পরবর্তীকালে উন্নত দেশগুলো শিক্ষার এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হলেও পিছিয়ে পড়ে উন্নয়নশীল ও অনুন্নত অনেক দেশ। এরপর বহু দেশে শিক্ষাখাতে ব্যয় হ্রাস করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ অবস্থায় শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া দেশগুলো আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নেও পিছিয়ে পড়তে পারে।
উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোর শিক্ষাখাতে ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে যুগোপযোগী পদক্ষেপসহ জাতীয় বাজেটের দুই-শতাংশ এ খাতে বরাদ্দ রাখার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে পিছিয়ে পড়া এসব দেশে জীবনমুখী শিক্ষার প্রশিক্ষণ বাড়ানো, যুব ও জনগোষ্ঠীর মাঝে যৌন ও প্রজনন খাতে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সঠিক শিক্ষা এবং ডিজিটাল দক্ষতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন তারা।
স্থানীয় সময় বুধবার (১২ এপ্রিল) যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে অবস্থিত জাতিসংঘ সদরদপ্তরে আয়োজিত ‘জনসংখ্যা ও টেকসই উন্নয়ন’ বিষয়ক সিপিডি-৫৬ সপ্তম সম্মেলনে এসব অভিমত তুলে ধরা হয়েছে।
আরও পড়ুন: শিক্ষায় মেগা বাজেটের প্রত্যাশা বিশেষজ্ঞদের
অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞ প্যানেলে উপস্থিত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ট্যুলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনাসতা সিয়া গেইজ, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জন সানটেলি, কোস্টারিকার জাতীয় প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিটের নির্বাহী পরিচালক জুয়ান আল ফেডো লোপেজ, কমনওয়েলথ যুব কাউন্সিলের প্রতিনিধি কিস্টিনা ইউলিয়ামস ও মিশরের কায়রো আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আয়মান জহুরী।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, করোনা মহামারির কারণে বিশ্বব্যাপী শিক্ষাখাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ক্ষতি পরবর্তী ১০-১২ বছর বা আরও বেশি সময় ধরে প্রভাব ফেলতে পারে। তা কাটিয়ে উঠতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়ন, ডিজিটাল অ্যাক্সেস, আধুনিক পাঠদান পদ্ধতি এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ শিক্ষক তৈরি করতে হবে। বিগত বছরগুলোতে নিম্ন এবং নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে শিক্ষাক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ব্যয় উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। এতে করে যে শিখন ক্ষতি হয়েছে, তা থেকে শিক্ষাব্যবস্থাকে পুনরুদ্ধার করা আরও কঠিন হয়ে পড়বে।
আরও পড়ুন: এডিপি বরাদ্দ কমছে বিদ্যুৎ-জ্বালানি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবহনে
সম্মেলনে তারা আরও বলেন, ২০২১ সালে করোনা মহামারিতে উন্নত দেশগুলোর প্রায় ৯০ শতাংশ জনগোষ্ঠী ইন্টারনেট ব্যবহার করেছে। শিক্ষাখাতে ব্যাপকভাবে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারের মাধ্যমে তারা এগিয়ে রয়েছে। সে তুলনায় স্বল্পোন্নত দেশে মাত্র ২৭ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছে। ফলে এসব দেশে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষত, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের ঝরে পড়ার হার বেশি। বক্তারা নারীদের অর্থনৈতিক সুরক্ষা ও সামাজিক ক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেন।
জাতিসংঘে মলদোভা প্রজাতন্ত্রের স্থায়ী প্রতিনিধি এবং সিপিডি চেয়ারম্যান জর্জ লিউকা বলেন, ১৯৯৪ সালে আইসিপিডি সম্মেলনে (জনসংখ্যা ও উন্নয়নবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন) সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে মহামারি পরবর্তী বিশ্বে উত্তরণে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং টেকসই উন্নয়নের লক্ষমাত্রা (এসডিজি) ছয়, সাত, নয়, এগারো এবং সতেরো সম্বলিত বাস্তবায়নের বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
আসন্ন এসডিজি সামিটে মানবসম্পদ বিষয়ক বিনিয়োগে শিক্ষার পাঠ্যক্রম উন্নয়ন, লিঙ্গ সমতা এবং আধুনিকায়ন বাস্তবায়নের বিষয়টি আমলে নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
সম্মেলনে এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মাধ্যমিক পর্যায় থেকে শিক্ষার্থীদের সমন্বিত যৌন শিক্ষা মানুষের স্বাস্থ্য এবং অধিকার রক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যৌনতা, লিঙ্গ বিষয়ে ব্যাপক শিক্ষা প্রদানের জন্য সুপরিকল্পিত পাঠ্যক্রম, অংশগ্রহণমূলক, শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক বয়স-উপযুক্ত এবং সাংস্কৃতিকভাবে প্রাসঙ্গিক উপায়ে সম্পর্ক এবং অধিকার ইতিবাচক সামাজিক নিয়ম পালন, লিঙ্গ সমতা প্রচার এবং লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা হ্রাস করতে সহায়তা করা প্রয়োজন।
আরও পড়ুন: শিক্ষার ১৭৮ প্রকল্পে ২৩.৬১ বিলিয়ন ডলার দেবে বিশ্বব্যাংক
এতে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী ৭৭০ মিলিয়নেরও বেশি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। যাদের অধিকাংশই নিরক্ষর। তাদের মধ্যে নারীর সংখ্যা বেশি। তাদের সাক্ষরতার আওতায় আনতে কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশের শিক্ষা বাজেটে ২ শতাংশ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০২০ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তির হার বিশ্বব্যাপী ৮৭ শতাংশ। আফ্রিকায় মাত্র ৬৩ শতাংশ। একই বছর নিম্ন ও উচ্চ-মাধ্যমিক স্তরে বিশ্বব্যাপী শিক্ষা সমাপ্তির হার যথাক্রমে ৭৭ এবং ৫৮ শতাংশ। যেখানে নিম্ন-আয়ের দেশগুলোর এ হার অনেক কম। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য অর্ধেকের বেশি এবং নিম্ন-মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য এক-তৃতীয়াংশের কিছু বেশি। এই দেশগুলোর জন্য টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এখনো দূরবর্তী বাস্তবতা রয়ে গেছে।
আরও পড়ুন: করোনায় স্কুল বন্ধের ক্ষতি প্রজন্মান্তরে চলতে থাকবে
এতে বলা হয়, এছাড়া ২০২০ সালে বিশ্বজুড়ে নথিভুক্ত ছাত্রদের অর্ধেকেরও কম নিম্ন-মাধ্যমিক স্তরে পড়ালেখার ক্ষেত্রে ন্যূনতম দক্ষতায় পৌঁছেছে। সাব-সাহারান আফ্রিকায় নিম্ন-মাধ্যমিক স্কুল শেষ করা প্রায় ১০ শতাংশ শিশু পড়ালেখার ক্ষেত্রে ন্যূনতম দক্ষতা অর্জন করেছিল।
এমএইচএম/এমকেআর