‘শিক্ষার গলদ জাতিকে মূর্খ বানাচ্ছে’

সায়েম সাবু
সায়েম সাবু সায়েম সাবু , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১১:১৯ এএম, ২৪ জানুয়ারি ২০২৩

‘শিক্ষার উন্নয়নের কথা বলে সরকার বাহবা নিচ্ছে। কিন্তু মান নিয়ে কথা বলছে না। কী শিখছে শিক্ষার্থীরা, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে না। সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে লাখ লাখ। তারা আবার উচ্চশিক্ষায় গিয়ে ঝরে পড়ছে। শিক্ষার গলদ জাতিকে মূর্খ বানাচ্ছে।’

পাঠ্যবই বিতর্ক নিয়ে জাগো নিউজের মুখোমুখি হয়ে কথাগুলো বলছিলেন ইমেরিটাস অধ্যাপক, লেখক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু

জাগো নিউজ: পাঠ্যবইয়ের ভুল-ভ্রান্তি ফের আলোচনায়। দিন যাচ্ছে আর শিক্ষার এমন ব্যবস্থা নিয়ে হতাশা বাড়ছে। আপনি শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন নিয়ে সরব দীর্ঘকাল ধরে। জীবন সাহাহ্নে এসে এই অব্যবস্থাপনা কতটুকু পীড়া দিচ্ছে?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: শিক্ষাব্যবস্থার এই অবনতি দেখে এখন আর হতাশাও প্রকাশ করি না। লাভ কী? দিন যাচ্ছে আর শিক্ষাব্যবস্থা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। রাষ্ট্র নিজে এই খারাপ করার দায়িত্ব নিয়েছে। রাষ্ট্র দায়িত্বশীল হলে এত অবনতি হওয়ার কথা ছিল না।

ইংরেজি মাধ্যমে সাধারণত সমস্যা হয় না। সেখানে পাঠ্যবইয়ের এত পরিবর্তন হয় না। বছরের পর বছর ধরে একই পাঠ্যবই পড়ানো হয়। কিন্তু বাংলা মাধ্যমে তা হয় না।

আরও পড়ুন>> শিক্ষার বৈষম্যকে প্রতিপালন করছে রাষ্ট্রই

মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। এক ধারার শিক্ষা গড়ে তোলার কথা ছিল। কিন্তু তা আর হলো না। আবার গোটা শিক্ষাব্যবস্থাই পরীক্ষার চাদরে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে শিক্ষার্থীরা আর মুখ বের করতে পারছে না। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পাবলিক পরীক্ষার সম্মুখীন হচ্ছে! আবার কেন সে পরীক্ষা প্রত্যাহার করা হচ্ছে, তাও পরিষ্কার নয়।

জাগো নিউজ: দায় নিয়ে কী বলা যায়…

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: পাঠ্যবই রচিত হচ্ছে এখন বিভিন্ন পক্ষের স্বার্থের কথা বিবেচনায় রেখে। কে কে কতটুকু বরদাস্ত করবে তা হিসাবে নিয়ে সরকার বই প্রকাশ করছে। এখানে শিক্ষার্থীদের কথা মাথায় রেখে কোনো পাঠ্যবই রচিত হচ্ছে না। হেফাজতের দেওয়া শর্ত গুরুত্ব দিয়ে বইয়ের পাঠ্যসূচি সাজানো হয়। ধর্মীয় সংগঠনগুলো কী চায়, তারা কী ধরনের রাষ্ট্র চায়, তাই এখানে শেখানো হয়।

অথচ, বাংলাদেশ তৈরি হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা প্রতিষ্ঠার জন্য। সাম্প্রদায়িক চেতনার বিরুদ্ধে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়েছে। শিক্ষার প্রতিশ্রুতি ছিল একেবারেই ইহজাগতিক, যেখানে ধর্ম মুখ্য হয়ে ওঠার কথা নয়। হচ্ছে উল্টো।

আরও পড়ুন>> এখন দরকার সঠিক শিক্ষা!

সবচেয়ে বড় বিপদের কথা হচ্ছে, নকল করা রাষ্ট্র নিজেই উৎসাহ দিচ্ছে। পাঠ্যবই রচিত হচ্ছে নকল করে। সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নকল করা বই পড়ছে। তারা নকল করেই লিখতে চাইবে। নকলকে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। নকলের এই প্রবণতা শিক্ষাব্যবস্থার সর্বত্রই। এমন কোনো স্তর পাবেন না, যে স্তরে নকল বই নেই। শিক্ষকরা গবেষণাপত্র জমা দিচ্ছেন নকল করে! তাহলে কোনটা সৎ আর কোনটা অসৎ তা বোঝার উপায় থাকছে না।

যারা লিখছেন আর যারা সম্পাদনা করছেন, তারা তো দায়িত্ববান। তাহলে দায় নিচ্ছেন না কেন? রাষ্ট্র কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না? তার মানে রাষ্ট্র এমন নকল ব্যবস্থাকে বৈধতা দিচ্ছে। ধরা না পড়লে রাষ্ট্রের সবাই সৎ। ধরা পড়লেই কেবল অসুবিধা।

আরও পড়ুন>> প্রাথমিকে এক শিফটে পাঠদানে ভাগাভাগি হবে শিক্ষার্থী

শিক্ষার উন্নয়নের কথা বলে সরকার বাহবা নিচ্ছে। কিন্তু মান নিয়ে কথা বলছে না। কী শিখছে শিক্ষার্থীরা, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে না। সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে লাখ লাখ। তারা আবার উচ্চশিক্ষায় গিয়ে ঝরে পড়ছে। শিক্ষার গলদ জাতিকে মূর্খ বানাচ্ছে।

শিক্ষা ও স্বাস্থ্য হচ্ছে মানুষের মৌলিক চাহিদা। দুটোকেই পণ্য বানিয়ে ফেলা হলো। যার টাকা আছে সেই কিনতে পারছে। অন্যরা মৌলিক এ চাহিদা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই পরিস্থিতি তো যে কোনো সুস্থ মানুষকে হতাশ করে তুলবে।

জাগো নিউজ: সরকার শিক্ষানীতি, উন্নয়নের কথা বলছে। আপনি হতাশা প্রকাশ করছেন। তাহলে সরকার এক্ষেত্রে আপস করে চলছে?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: শিক্ষা নিয়ে হেফাজতের সঙ্গে সরকারের আপস প্রমাণিত। হেফাজতের আষ্ফালনের বিরুদ্ধে আমরা প্রতিবাদ করলাম, বিবৃতি দিলাম। সরকারপ্রধান গণভবনে ডেকে নিয়ে তাদের সঙ্গে বৈঠক করলেন। সেই শিক্ষানীতির আসলে কী ঘটলো, তা কেউ জানেন না। নির্দয়ভাবে হেফাজতের শর্ত মেনে নেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন>> হুমকির মুখে কারিগরি শিক্ষা!

হেফাজতে ইসলাম মাদরাসার শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন নিয়ে কথা বলতে পারতো। এখানে অনেক সমস্যা আছে। তা না করে সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে তারা মাঠে নামছে। সরকার তাদের ভয়ে সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায়ও হস্তক্ষেপ করছে। এগুলো অন্যায় এবং অপ্রত্যাশিত। মুক্তিযুদ্ধ ঠিক এ কারণে হয়নি। বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রশ্নে আমরা প্রতিনিয়ত আপস করছি এবং সেটা শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে তীব্র হচ্ছে।

জাগো নিউজ: এমন শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আমরা যাচ্ছি কোথায়?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: তিন ধারার শিক্ষাব্যবস্থা ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠা পায়। পাকিস্তান আমলে বিস্তার ঘটে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এক ধারায় ফেরার কথা। তা হলো না। আরও ব্যাপক আকার ধারণ করলো। উচ্চবিত্তরা ইংরেজি মাধ্যম, মধ্যবিত্তরা বাংলা মাধ্যম আর গরিবরা পড়ছে মাদরাসায়। শিক্ষায় নানা বৈচিত্র্য থাকবে। কিন্তু মাধ্যম হবে মাতৃভাষা। সর্বস্তরেই এমন হচ্ছে। আমাদের আন্দোলন তো এ কারণেই। রক্ত দিয়ে বাংলা ভাষা অর্জন করে আমরা ইংরেজি ভাষায় শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলছি। শিক্ষার একমাত্র মাধ্যম হওয়ার কথা বাংলা। ছাড় দিতে দিতে আমরা এক বিশৃঙ্খল জাতিতে রূপ নিচ্ছি। শিক্ষাই মানুষে মানুষে গভীর পার্থক্য করে তুলছে। অথচ শিক্ষা পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে তোলার কথা।

এএসএস/এএসএ/জেআইএম

এখানে শিক্ষার্থীদের কথা মাথায় রেখে কোনো পাঠ্যবই রচিত হচ্ছে না। হেফাজতের দেওয়া শর্ত গুরুত্ব দিয়ে বইয়ের পাঠ্যসূচি সাজানো হয়। ধর্মীয় সংগঠনগুলো কী চায়, তারা কী ধরনের রাষ্ট্র চায়, তাই এখানে শেখানো হয়।

শিক্ষা ও স্বাস্থ্য হচ্ছে মানুষের মৌলিক চাহিদা। দুটোকেই পণ্য বানিয়ে ফেলা হলো। যার টাকা আছে সেই কিনতে পারছে। অন্যরা মৌলিক এ চাহিদা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই পরিস্থিতি তো যে কোনো সুস্থ মানুষকে হতাশ করে তুলবে।

হেফাজতে ইসলাম মাদরাসার শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন নিয়ে কথা বলতে পারতো। এখানে অনেক সমস্যা আছে। তা না করে সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে তারা মাঠে নামছে। সরকার তাদের ভয়ে সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায়ও হস্তক্ষেপ করছে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।