পাঠ্যবইয়ে ভুল: অভিযুক্তদের রাজনৈতিক পরিচয় খুঁজছে গোয়েন্দা সংস্থা
পাঠ্যবইয়ে ভুল-ক্রটি, বির্তকিত পাঠ ও ছবি সংযোজনের ঘটনায় চটেছেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। এমনকি খোদ সরকার প্রধানও অসস্তুষ্ট হয়েছেন। বিশেষ করে দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী মূল পাণ্ডুলিপি থেকে কিছু বিষয় বাদ দিতে বলেছিলেন। কিন্তু রহস্যজনক কারণে বাদ দেওয়া হয়নি সেগুলো। এ নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছে সরকার। এ অবস্থায় এরই মধ্যে পাঠ্যবইয়ে চলে আসা অপ্রাসঙ্গিক বিষয় বাদ দেওয়ার চিন্তা শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলন ডেকেছেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি।
সংশোধনের অংশ হিসেবে বিশেষজ্ঞদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবই পর্যালোচনার। পাশাপাশি অসংগতি রেখে দেওয়া ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে কাজ করছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এছাড়া লেখকদের রাজনৈতিক পরিচয় অনুসন্ধানেও নেমেছে গোয়েন্দা সংস্থা। তারাও আলাদাভাবে কাজ করছে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে এসব তথ্য।
এদিকে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অষ্টম শ্রেণির নতুন পাঠ্যবই তৈরিতে সতর্কতা অবলম্বন করছে এনসিটিবি। এ ক্ষেত্রে বইয়ের পাঠ নির্বাচনের পাশাপাশি লেখক এবং সম্পাদক নির্বাচনেও অবলম্বন করা হচ্ছে সতর্কতা। এবারের ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির সামাজিক বিজ্ঞান বই যারা লিখেছেন, ভবিষ্যতে এনসিটিবির আর কোনো বই প্রণয়নের দায়িত্ব তাদের না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম জাগো নিউজকে জানান, এ পর্যন্ত পাঠ্যবইতে যেসব ভুল চিহ্নিত হয়েছে তার সংশোধনী পাঠানো হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। বইয়ে আরও ভুল আছে কি না বা সাধারণ মানুষ যেমন বই চাচ্ছে, তেমন হয়নি- এসব বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে। মূলত প্রাথমিকের প্রথম শ্রেণির ও মাধ্যমিকের ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির বইগুলো এবার নতুন দেওয়া হয়েছে। এগুলোই পর্যালোচনা করতে দেওয়া হয়েছে শিক্ষাবিদদের কাছে।
তিনি আরও বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমে অষ্টম শ্রেণির বই কি বর্তমান ধারায় লেখা হবে, নাকি পরিবর্তন আনা হবে, সেসবও পর্যালোচনা করা হবে। এ নিয়ে সোমবার শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। এ বিষয়ে এখনই সিদ্ধান্ত বলা যাচ্ছে না।
এনসিটিবির একাধিক কর্মকর্তা জানান, মাধ্যমিকের নতুন কারিকুলামের বইয়ের পাণ্ডুলিপি প্রণয়ন কমিটিতে যারা ছিলেন, তাদের মধ্যে বেশি ছিলেন বামপন্থি শিক্ষকরা। সংশ্লিষ্ট সদস্য ছাত্র জীবনে যুক্ত ছিলেন জাসদের রাজনীতির সঙ্গে। বইয়ের লেখক প্যানেল তিনিই তৈরি করেছেন। ওই প্যানেল অনুমোদন ছাড়াই বই লেখার কাজ শুরু করে দেয়। কাজ অনেক দূর এগোনোর পর তা এনসিটিবি (বোর্ড) এবং মন্ত্রণালয়কে দেখায়। অনেক সময় চলে যাওয়ায় প্যানেলে আর পরিবর্তন আনা হয়নি।
আরও পড়ুন: পাঠ্যবইয়ে বিবর্তনবাদ: ব্লাসফেমি আইন করে বিচার দাবি জাপা এমপির
ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরির পর তা শিক্ষামন্ত্রীকে দেখানো হয়। তিনি বিশেষ করে পরামর্শ দেন সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের কিছু ছবি ও পাঠ বাদ দেওয়ার। পাশাপাশি ইতিহাসের বর্ণনার ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা বজায় রাখার পরামর্শ দেন। কিন্তু এবার সামাজিক বিজ্ঞানের জন্য যে দুটি বই শিক্ষার্থীদের হাতে দেওয়া হয়েছে, তার একটি থেকে কিছু ছবি বাদ দেওয়া হলেও পাঠ সংশোধন করা হয়নি। আর অপর বইটিতে ছবি এবং পাঠ কিছুই বাদ দেওয়া হয়নি।
সূত্র জানায়, এ বইটি একদম শেষ মুহূর্তে এনসিটিবিতে জমা দেওয়া হয়। সে কারণে কোনো ধরনের সম্পাদনা ছাড়াই মুদ্রণে পাঠানো হয়। ফলে অপ্রত্যাশিত বিষয় থেকে যাওয়ায় সমালোচকদের বির্তক সৃষ্টির পথ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আলাপ করলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান জাগো নিউজকে বলেন, শিক্ষামন্ত্রী নিজে কিছু ছবি বাতিল করে দিলেও সেগুলো রাখা হয়েছে। বিশেষ করে ‘অ্যাকটিভিটি’ (অনুশীলন) বই থেকে কিছু ছবি বাতিল করা হলেও ‘রেফারেন্স’ (সহায়ক) বইয়ে সেগুলো রাখা হয়েছে। যদি মন্ত্রীর পরামর্শ বাস্তবায়িত হতো তাহলে এখন বির্তক উঠতো না।
আরও পড়ুন: প্রাথমিকের পাঠ্যবই সহজভাবে লেখার আহ্বান
তিনি বলেন, যাদের কাজের জন্য ভুল-ভ্রান্তি ও বির্তক উঠেছে, তাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। তাদের চিহ্নিত করতে গোয়েন্দা সংস্থা মাঠে নেমেছে। যারা এসব বই তৈরিতে কাজ করেছেন, তাদের আমলনামা সংগ্রহ করা হচ্ছে।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান আরও বলেন, পাঠ্যবইয়ের অসঙ্গতিগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। সেগুলো আমলে নিয়ে নতুন কারিকুলামের বইয়ে পরিবর্তন আনার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। সেজন্য এ বছর দ্রুততার সঙ্গে বির্তক ওঠা বইগুলো পর্যবেক্ষণ কাজ শেষ করা হবে। এ বিষয়ে প্রধান শিক্ষক, শ্রেণি শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছে মতামত নেওয়া হবে। দেশের দুই হাজার থেকে তিন হাজার স্টেক হোল্ডারদের মতামত নেওয়া হবে। কোন কোন বিষয় কঠিন, অসঙ্গতি ও ভুল-ভ্রান্তির অভিযোগ পাওয়া গেছে, সেগুলো সংশোধন আনা হবে।
নবম শ্রেণির তিনটি বইয়ে ভুল থেকে যাওয়া প্রসঙ্গে চেয়ারম্যান বলেন, ২০১২ সালে লেখা বই ২০১৩ সালে শিক্ষার্থীদের হাতে গেছে। এরপর ২০১৭, ২০২০ এবং ২০২২ সালেও রিভিউ হয়েছে। বই একবার লেখানো হয়েছে, এরপর যৌক্তিক মুল্যায়ন করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের হাতে দেওয়ার পরও তিন বছর তিন দফায় পরিমার্জন করা হয়েছে। পরিমার্জন কমিটিতে লেখক কমিটির মতো ছয়জন করে সদস্য ছিলেন। সেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, দুজন ক্লাস শিক্ষক, এনসিটিবির কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ থাকেন। এরপরও কেন পুরাতন বইয়ের মধ্যে ভুল তথ্য রয়েছে, সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এতদিন ধরে পড়ানো হচ্ছে, কেন কারো চোখে পড়লো না, এমন প্রশ্নও তোলেন তিনি।
জানতে চাইলে এনসিটিবির সদস্য (কারিকুলাম) অধ্যাপক ড. মশিউজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, শুধু যে একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পাঠ্যবই হয় তা নয়। এর বাহিরেও বই তৈরি হয়ে থাকে। ২০১৭ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ১০টি বই সুখপাঠ্যকরণ করা হয়েছিল। এবারের তিন বই তার মধ্যে ছিল। তাতে বিজ্ঞান বিষয়ের বইগুলো ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল, পদার্থ বিজ্ঞান অধ্যাপক কায়কোবাদ, আনোয়ারা সৈয়দ হক ইতিহাস এবং বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. হারুন অর রশিদ পরিমার্জন করেছেন। আসলে যেসব বিষয় নিয়ে এখন বির্তক করা হচ্ছে, সেগুলো সংশ্লিষ্টদের চোখ এড়িয়ে গেছে। ১০ বছর ধরে থাকার পরও সুধি মহলের নজরেও আসেনি। নতুন শিক্ষাক্রমে এবার পাঠ্যবই সংশ্লিষ্টরা আগ্রহ নিয়ে পড়তে যাওয়ায় ভুল চিহ্নিত হয়েছে। এটি ইতিবাচক। যে কারণে সংশোধন করা সম্ভব হয়েছে।
তবে যেসব ভুল এখন চিহ্নিত করা হচ্ছে তার সব সঠিক নয় বলেও মনে করেন তিনি। দৃষ্টান্ত দিয়ে তিনি বলেন, সপ্তম শ্রেণির গণহত্যা দিবস ২৫ বা ২৬ মার্চ, এ বিষয়ে পুরো অধ্যায় পড়লে মনে হবে না, শুধু ‘অবরুদ্ধ বাংলাদেশ’ অধ্যায় পড়লে সেখানে ভুল মনে হবে। এগুলো শুধু দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়। সংসদের বিধান হচ্ছে ‘আইনসভা’ সংবিধানে সেটাই লেখা আছে। আমাদের দেশের আইনসভা হচ্ছে ‘জাতীয় সংসদ’। একেক দেশের আইনসভাকে ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকা হয়। সে কারণে বইয়ে আইনসভা লেখা হয়েছে। পরে আবার জাতীয় সংসদ উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সেখানে ভুল ধরা হচ্ছে। এগুলো আসলে ভুল বলা ঠিক হবে না।
তিনি বলেন, পাঠ্যবই রচনা-সম্পাদনার ক্ষেত্রে এ সংক্রান্ত কমিটিতে বাম বা ডানপন্থি ব্যক্তিদের নির্বাচন করার অভিযোগ সঠিক নয়।
এমএইচএম/এমএইচআর