স্কুলে স্কুলে পাঠ্যপুস্তক সংকট, শিশুদের হাতে নিম্নমানের বই

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:৫০ পিএম, ০১ জানুয়ারি ২০২৩

রাজধানীর গেন্ডারিয়া মহিলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী তানজিলা আক্তার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে প্রাথমিকের কেন্দ্রীয় বই বিতরণ উৎসবে শিক্ষকদের সঙ্গে এসেছিল সে। চোখেমুখে ছিল তার নতুন বইয়ের অপেক্ষা। কিন্তু পরক্ষণেই মুখখানি তার মলিন হয়ে যায়। বই উৎসবে তার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় দ্বিতীয় শ্রেণির বাংলা বই। শুধু তানজিলা নয়, পঞ্চম শ্রেণির এমন অনেক শিক্ষার্থীকেই অন্য ক্লাসের বই দেওয়া হয়েছে। আর সে কারণে বই উৎসবে এসেও নতুন বই না পেয়ে অনেক শিক্ষার্থী মুখভার করে ঘরে ফিরেছে।

বছরের প্রথম দিন বই উৎসবে এসেও নতুন বই পায়নি শিশুরা। অনেকে অন্য ক্লাসের পুরোনো বই নিয়েই বাসায় ফিরেছে। কেউ কেউ ফিরেছে একেবারে খালি হাতে। কোনো কোনো শিক্ষার্থী একটি-দুটি নতুন বই পেলেও সে বইয়ের নিম্নমানের কাগজ নিয়ে ওঠেছে প্রশ্ন। অভিভাবকদের অভিযোগ, নিম্নমানের কাগজে তৈরি এসব বই বছরের অর্ধেক সময় না যেতেই নষ্ট হয়ে যাবে। এছাড়া বছরের শুরু থেকে নতুন বই হাতে না পাওয়ায় অনেক শিক্ষার্থীর পড়াশোনাও ব্যাহত হবে।

এদিন তানজিলার সঙ্গে বই উৎসবে আসেন তার মা মানসুরা আক্তার। মেয়ে নতুন বই না পাওয়ার আক্ষেপ প্রকাশ করে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, মেয়ের নতুন বই নিয়ে বাসায় যাবো বলে বই উৎসবে এলাম। এসে দেখি আসায় গুড়েবালি। দ্বিতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের একটি করে নতুন বই দিলেও পঞ্চম শ্রেণির কোনো শিক্ষার্থী বছরের প্রথম দিন নতুন বইয়ের ঘ্রাণ পায়নি। তাদের খালি হাতেই ঘরে ফিরতে হয়েছে।

jagonews24

সরেজমিনে রোববার (১ জানুয়ারি) দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক শ্রেণির শিক্ষার্থীর হাতে অন্য শ্রেণির বই তুলে দেওয়া হয়েছে। গেন্ডারিয়া মহিলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী ফাতেমা আক্তারের হাতে ছিল প্রথম শ্রেণির বই। একই শ্রেণির রিয়া মনি, আফরিন আক্তার আনহারের হাতে চতুর্থ শ্রেণির বই দেখা যায়।

গেন্ডারিয়া মহিলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক জাগো নিউজকে বলেন, গত ২৬ ডিসেম্বর বিদ্যালয়ে কিছু বই পাঠানো হয়েছে। এখনো অনেক বই বাকি রয়েছে। এর মধ্যে দ্বিতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির অধিকাংশ বই এলেও প্রাক-প্রাথমিক, প্রথম, তৃতীয় ও পঞ্চম শ্রেণির বই আসেনি। যে কারণে আমরা শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই দিতে পারছি না। বই উৎসবে এসেও শিক্ষার্থীদের মন খারাপ। তাদের হাতে অন্য ক্লাসের বই তুলে দেওয়া হয়েছে। কবে নাগাদ নতুন বই আসবে সেটিও জানা নেই।

পুরান ঢাকায় দক্ষিণ মুহসেন্দী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক উম্মে কুলসুম জাগো নিউজকে জানান, তাদের বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিকের শুধু খাতা, প্রথম শ্রেণির গণিত বই, দ্বিতীয় শ্রেণির তিনটি বই, তৃতীয় শ্রেণির ছয়টির মধ্যে চারটি, চতুর্থ শ্রেণির সব বই পেলেও পঞ্চম শ্রেণি শিক্ষার্থীরা কোনো বই পায়নি। যে কারণে তারা বছরের প্রথম দিন সব শিক্ষার্থীর হাতে বই তুলে দিতে পারেননি।

নতুন বই এলে শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করা হবে বলে জানান একই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নুসরাত জাহান।

তিনি বলেন, এবার অনেক খারাপ কাগজ দিয়ে বই তৈরি করা হয়েছে। এসব বই শিক্ষার্থীরা বেশি দিন পড়তে পারবে না। বছরের মাঝামাঝি বই নষ্ট হলে নতুন করে দেওয়া কঠিন। সে কারণে নতুন বই দেওয়ার আগে সব শিক্ষার্থীর কাছ থেকে পুরোনো বই জমা নেওয়া হচ্ছে। কারও বই নষ্ট হলে বছরের বাকি সময় এসব পুরোনো বই দিয়ে চালানো হবে।

বই সংকট

চলতি বছর সারাদেশে প্রায় ৩৫ কোটি বই বিতরণ করার কথা রয়েছে। এর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক থেকে প্রাথমিক পর্যায়ে মোট ৯ কোটি ৬৬ লাখ ৮ হাজার ২৪৫টি আর বাকি ২৫ কোটি বই মাধ্যমিক ও অন্যান্য পর্যায়ে বিতরণ করা হবে।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) দাবি, এরই মধ্যে সারাদেশে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে প্রাথমিকের ৮০ শতাংশ বই পৌঁছে গেছে। মাধ্যমিকের ৯০ শতাংশ বই পৌঁছেছে। তবে এর চেয়ে অনেক কম নতুন বই সরবরাহ করা হয়েছে বলে দাবি মুদ্রণ শিল্প সমিতির।

সরেজমিনে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিভিন্ন স্থানে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বই সরবরাহ করা হয়েছে। বছরের প্রথম দিন রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও বই সংকটের চিত্র দেখা গেছে। সারাদেশে প্রায় ৯ কোটি বই এখনো পৌঁছায়নি বলে জানা গেছে।

jagonews24

নিউজপ্রিন্টের বইয়ে সয়লাব

কেন্দ্রীয় বই বিতরণ উৎসবে আসা বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হাতে ছিল বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত নতুন পাঠ্যপুস্তক। এর মধ্যে কিছু প্রকাশনীর বইয়ের মান কিছুটা ভালো হলেও অধিকাংশ শিক্ষার্থীর হাতেই দেখা গেছে নিম্নমানের কাগজের বই।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব কাগজ নিজউপ্রিন্টের চেয়ে কোনোভাবে ভালো হতে পারে না। আবার এর উজ্জ্বলতাও কাঙ্ক্ষিত মানের অনেক নিচে। এসব বইয়ের উজ্জ্বলতা কোনোভাবেই ৬৫ শতাংশের বেশি হবে না। এনসিটিবির নির্ধারিত মান ৮৫ শতাংশ হলেও বিভিন্ন সংকটের কারণে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য বলে জানানো হয়।

এ বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ জাগো নিউজকে বলেন, বইয়ের কোনো সংকট নেই। টেন্ডার জটিলতার কারণে এবং ভার্জিন পাল্প (কাগজ তৈরির মন্ড) আমদানিতে সমস্যা এবং কাগজ না পাওয়ার কারণে কয়েকটি প্যাকেজের কাজে দেরি হয়েছে। সব বিদ্যালয়ে তিন থেকে চারটি বিষয়ের বই পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। বাকিগুলো সরবরাহের অপেক্ষায় রয়েছে। ১০ জানুয়ারির মধ্যে সব বিদ্যালয়ে শতভাগ বই পৌঁছে দেওয়া হবে।

নতুন বইয়ের মান নিয়ে তিনি বলেন, মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে এবছর স্বাধীন এজেন্সি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মান যাচাইয়ে পরিদর্শন টিম আরও ছয় মাস সময় পাবে। টেন্ডার অনুযায়ী নির্ধারিত মানের বই সরবরাহ করতে হবে। কোথাও নিম্নমানের বই পাওয়া গেলে পরিদর্শন টিম এনসিটিবি, মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরে জানাবে। ফলে এর বাইরে বই সরবরাহের কোনো সুযোগ নেই।

পুরনো বই ভরসা

শিশু শিক্ষার্থীদের হাতে যেন দ্রুত পাঠ্যবই নষ্ট না হয় এবং বইয়ের প্রতি তাদের আকৃষ্ট করতে অফসেট পেপারে চার রংয়ের (আরজিবি কালার) বই দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। সেখানে ৮২ শতাংশ উজ্জ্বলতা থাকার কথা থাাকলেও নিউজপ্রিন্টের কালো কাগজে প্রাথমিকের অধিকাংশ বই পাওয়া গেছে। এবছর যেসব বই শিশুদের বিতরণ করা হয়েছে তা দিয়ে বছর পার করা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন অভিভাবক ও শিক্ষকরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ বছর পুরনো বইয়ের ওপরই ভরসা করতে হবে।

jagonews24

আজিমপুর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফারজানা আক্তার বলেন, যেসব শিক্ষার্থী চলে যায় তাদের বই রেখে দিই। কারও বই নষ্ট হলে এসব পুরোনো বই দিয়ে বছরের বাকি সময় চালানো হবে। সে কারণে নতুন বই দেওয়ার আগে শতভাগ পুরোনো বই সংগ্রহ করা হচ্ছে।

শুধু প্রাথমিকে নয়, এ বছর মাধ্যমিক পর্যায়েও বইয়ের সংকট দেখা দিয়েছে। আসিফ শওকত কল্লোল নামের একজন অভিভাবক তার মেয়েকে নিয়ে আজ মতিঝিল বাংলাদেশ ব্যাংক হাইস্কুলে আসেন। মেয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। কিন্তু বই উৎসবের দিনে মেয়ের হাতে একটিও নতুন বই ওঠেনি। তবে অন্যান্য ক্লাসের শিক্ষার্থীদের হাতে দুটি-তিনটি করে বই তুলে দেওয়া হয়েছে। ওই অভিভাবক মেয়ের বই আনতে স্কুলে গেলে বই এখনো আসেনি বলে তাকে জানিয়ে দেন শিক্ষকরা।

আসিফ শওকত তিনি জাগো নিউজকে বলেন, সারাদেশে সরকার বই উৎসব করলেও প্রকৃতপক্ষে শিক্ষার্থীদের অনেকে নতুন বই পাচ্ছে না। অনেকে পুরোনো বই পাচ্ছে। তবে সেটিও পর্যাপ্ত নয়। কবে নতুন বই দেওয়া হবে সে বিষয়েও কিছু বলা হচ্ছে না। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের নতুন ক্লাসের পড়াশোনা ব্যাহত হতে পারে।

এমএইচএম/এমকেআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।