বন্ধ হয়নি কোচিং, শিক্ষকদের বাসায় চলছে ব্যাচভিত্তিক প্রাইভেট
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে চালু রয়েছে রাজধানীর অধিকাংশ কোচিং সেন্টার। নামি স্কুলের শিক্ষকরাও নিজ বাসার মধ্যে চালু রেখেছেন কোচিংয়ের আদলে প্রাইভেট পড়ানো। সরেজমিনে ঢাকার বেশ কয়েকজন শিক্ষকের বাসা ও কোচিং সেন্টার ঘুরে দেখা যায়, বাসায় ব্যাচ পড়ানোর পাশাপাশি পুরোদমে চলছে কোচিংয়ে পাঠদান। কবে, কখন অনলাইনে-অফলাইনে ক্লাস হবে তা শিক্ষার্থীদের মেসেজে জানিয়ে দেন শিক্ষকরা। বাণিজ্যিক কোচিং সেন্টারে তো কোনো রাখঢাকেরই বালাই নেই।
রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বসুন্ধরা ব্র্যাঞ্চের ইংরেজির শিক্ষক আবু সুফিয়ান। আট বছর ধরে তিনি এ প্রতিষ্ঠানে রয়েছেন। পাশের একটি ব্লকে বাসা তার। বাসার একটি রুম কোচিং সেন্টার বানিয়ে পড়ান নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের। চলমান এসএসসি-সমমান পরীক্ষার মধ্যে দেশের সব কোচিং সেন্টার ও প্রাইভেট বন্ধ রাখতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নির্দেশনা দিলেও তিনি প্রতিদিন পড়াচ্ছেন ছয় থেকে আটটি ব্যাচ।
শুধু তাই নয়, এসএসসি পরীক্ষার্থীদের আগের দিন বিশেষ প্রস্তুতি হিসেবে প্রশ্ন তৈরি করে তা সমাধান করে দিচ্ছেন। সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক রাজধানীতে হাতেগোনা কয়েকটি কোচিং সেন্টার বন্ধ রাখা হলেও অধিকাংশই খোলা। সরেজমিনে শীর্ষ পর্যায়ের স্কুল-কলেজ শিক্ষকদেরও নিয়মিত কোচিং চালিয়ে যেতে দেখা যায়।
কোচিং করানোর বিষয়টি স্বীকার করে ভিকারুননিসার ইংরেজি শিক্ষক আবু সুফিয়ান জাগো নিউজকে বলেন, আমার বাসায় একটি রুমে কয়েকটি ব্যাচে প্রাইভেট পড়াই।
তবে এসএসসি পরীক্ষা শুরু হওয়ায় সরকারি নির্দেশনা মেনে অফলাইন-অনলাইন কোনো মাধ্যমে কোচিং করাচ্ছেন না বলে দাবি করলেও প্রতিদিন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মোবাইলে এসএমএস পাঠান। কোন ক্লাস অনলাইনে, কোন ক্লাস অফলাইনে নেওয়া হবে তা মেসেজে উল্লেখ করেন। এমন কয়েকটি মেসেজও জাগো নিউজের হাতে এসেছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ বসুন্ধরা ব্র্যাঞ্চের শিক্ষকদের বাসা প্রতিষ্ঠানের আশপাশের বিভিন্ন ব্লকে। গণিতের শিক্ষক নাইমুল ইসলাম, ইকবাল ফারুক ও মো. মোর্শেদুল আলম, বাংলার শিক্ষক আছিয়া কামাল, ইংরেজির শিক্ষক শাহনেওয়াজ পারভীন, তাহমিনা চৌধুরী, নিগার সুলতানা ও শরিফুল ইসলাম এবং পদার্থ বিজ্ঞানের আব্দুল জলিল নিজ বাসায় মিনি কোচিং বানিয়েছেন। বাসার ভেতরে একটি রুমে হোয়াইট বোর্ড ঝুলিয়ে সেখানে বেঞ্চ, টেবিলসহ ক্লাসরুমের আদলে গড়ে তুলেছেন কোচিং সেন্টার।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভিকারুননিসার বসুন্ধরা ব্র্যাঞ্চের অধিকাংশ শিক্ষকের বাসায় এমন মিনি কোচিং সেন্টার রয়েছে। প্রতিদিন সেখানে পাঁচ থেকে আটটি ব্যাচ পড়ানো হয়। প্রতি ব্যাচে পড়ে ২০ থেকে ৪০ জন শিক্ষার্থী। সকালে শুরু হয়ে বিরতি দিয়ে রাত ১০টা পর্যন্ত চলে কোচিং ক্লাস। এ প্রতিষ্ঠানের খণ্ডকালীন শিক্ষকরা আবার যৌথভাবে বাড়িভাড়া নিয়ে প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণির অধিকাংশ বিষয় পড়ান। এসব কোচিংয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যাও কম নয় বলে জানা যায়।
ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক নিগার সুলতানার বাসায় গিয়ে দেখা যায়, তিনি ব্যাচে পড়াচ্ছেন। জানতে চাইলে জাগো নিউজকে বলেন, ভিকারুননিসার সব শিক্ষক বাসায় প্রাইভেট পড়ান। বর্তমানে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের পড়ান না, ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রীদের পড়ানো হচ্ছে। কয়েকদিন পর মাধ্যমিকের সিটি পরীক্ষা শুরু হতে যাচ্ছে বলে ছাত্রীরা বাসায় পড়তে আসছে।
জানতে চাইলে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ কামরুন নাহার জাগো নিউজকে বলেন, এ বিষয়ে কেউ কেউ আমাকে তথ্য দিয়েছেন। তবে কে কোথায় পড়াচ্ছেন তা আমার জানা নেই। বিষয়টি খোঁজ নেবো।
চলমান এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস রোধে গত ১২ সেপ্টেম্বর থেকে আগামী ২ অক্টোবর পর্যন্ত দেশের সব কোচিং সেন্টার ও প্রাইভেট কোচিং বন্ধ রাখতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। এ সময়ের মধ্যে কোনো কোচিং সেন্টার খোলা হলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও ঘোষণা দেন শিক্ষামন্ত্রী।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মিরপুরের মনিপুর এলাকার আনাচে-কানাচে ফ্ল্যাট বাসা ভাড়া নিয়ে ও নিজ বাসায় একক-যৌথভাবে কোচিং সেন্টার গড়ে তুলেছেন মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষকরা। বর্তমানে অধিকাংশ শিক্ষক এসএসসি পরীক্ষার্থীদের বিশেষ প্রস্তুতি হিসেবে ‘মডেল প্রশ্ন’ তৈরি করে সমাধান করে দিচ্ছেন। সঙ্গে প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ পর্যন্ত নিয়মিত শিক্ষার্থীদের পড়ানো হচ্ছে। এসব কোচিং সেন্টার মনিপুর গ্রিন রোড স্কুল গলি, মার্কেট গলি, মোল্লা বাড়ির আশপাশে, কমিশনার গলিসহ এলাকাজুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে।
সরকারি নির্দেশনা মেনে হাতেগোনা কয়েকটি বড় কোচিং সেন্টার বন্ধ রাখা হলেও অধিকাংশই খোলা। মিরপুর-১০ নম্বর রোডের ১৯ নম্বর লেনে ১/৯ নম্বর বাড়িতে বর্ণমালা একাডেমিক কোচিংয়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চতুর্থ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াতে দেখা গেছে। ছোট আকারের কয়েকটি ক্লাসরুমের মধ্যে শিক্ষার্থীদের পড়ানো হচ্ছিল। মঙ্গলবার (২০ সেপ্টেম্বর) প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ শাহ আলম লিটনের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, পরীক্ষা শুরুর পর দুদিন বন্ধ ছিল। অভিভাবকদের অনুরোধে খোলা হয়েছে। এখানে শিক্ষার্থী শতাধিক।
পাশেই ১/৭ নম্বর বাড়িতে প্রত্যয় কোচিং সেন্টারও খোলা পাওয়া যায়। চারটি ক্লাসরুমে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয় পড়াতে দেখা গেছে। এখানকার ম্যানেজার মাহমুদা খানম জাগো নিউজকে বলেন, ডে-মর্নিং শিফটে দুই শতাধিক শিক্ষার্থী রয়েছে। কোচিং বন্ধ রাখলে শিক্ষার্থী চলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ এলাকায় এমন ৫০টির মতো কোচিং সেন্টার খোলা দেখা যায়। সেখানে মিরপুর আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, শহীদ স্মৃতি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বনফুল আদিবাসী স্কুল, হারম্যান মেইনার, মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিয়মিত ক্লাস নেন।
জানতে চাইলে উদ্ভাস কোচিং সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা মাহামুদুল হাসান সোহাগ জাগো নিউজকে বলেন, পাবলিক পরীক্ষার আগে কোচিং সেন্টার বন্ধ রাখতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা মোতাবেক আমরা বন্ধ রাখলেও অধিকাংশ কোচিং সেন্টার অনলাইন-অফলাইনে ক্লাস করাচ্ছে। স্কুল-কলেজ শিক্ষকদেরও কোচিং বন্ধ হচ্ছে না। যারা বন্ধ রাখছে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বন্ধ থাকলে অনেক শিক্ষার্থী চলে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, গত দুই বছরের প্রশ্নফাঁসে অভিযুক্তরা কেউ কোচিং সেন্টারের সঙ্গে জড়িত বলে প্রমাণিত হয়নি। যদি দু-একটি কোচিংয়ের সঙ্গে জড়িতও হয় তবে কেন পরীক্ষার আগে সব কোচিং সেন্টার বন্ধ রাখা হবে। পাবলিক পরীক্ষার আগে কোচিং বন্ধের প্রথা থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সরে আসা উচিত। অপরাধীদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে, তাই বলে একজন অপরাধ করলে সবাই তার শাস্তি ভোগ করতে পারে না।
‘শিক্ষকরা তাদের ঘরে নিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়ালে ধরা সম্ভব হয় না। তাদের নৈতিকতা ও প্রতিজ্ঞা ঠিক থাকছে না বলে এমন কাজ করছে।’ এমনটি মনে করেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আবু বকর ছিদ্দীক। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমরা অনেক আইন করি, অনেক নিয়ম করি, সেটি বাস্তবায়নে শক্ত কমিটমেন্ট (প্রতিজ্ঞা) থাকে না।
তিনি আরও বলেন, কোচিং সেন্টার বিষয়ে যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সেটি কার্যকর হচ্ছে না। একজন শিক্ষক নিজের আদর্শের জায়গায় ঠিক না থাকলে তার বাড়িতে পুলিশ পাঠিয়ে ধরে আনা যাবে না। এসব শিক্ষক নিয়ে আমরা বিপদের মধ্যে আছি। বড় কোচিং সেন্টার খোলা থাকলে সেখানে গিয়ে তালা লাগিয়ে দেওয়া যায়, বাড়িতে গিয়ে শিক্ষককে ধরা যায় না। এসব বিষয় নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। সরকারের একার পক্ষে এটি রোধ করা সম্ভব নয়।
এমএইচএম/এএসএ/এএসএম