‘সম্মান দিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবীরাই প্রাইমারির শিক্ষক হবেন’
যথাযথ মর্যাদা আর বেতন বাড়ালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেবেন বলে মন্তব্য করেছেন লেখক, প্রাবন্ধিক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। অপরদিকে, প্রাথমিক শিক্ষকের বেতন এক টাকা হলেও বিসিএস ক্যাডারের চেয়ে বেশি হওয়া উচিত বলে মনে করেন অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত।
শিক্ষা দিবস উপলক্ষে দেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে মতামত গ্রহণ করা হয় অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ও অধ্যাপক ড. আবুল বারকাতের।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত পরিস্থিতি থেকে আমরা খুব দ্রুতই বের হতে পেরেছিলাম। গত ৫০ বছরে আমাদের অর্জন কিন্তু কম নয়। জনসংখ্যার চাপ, দারিদ্র্য, সামাজিক প্রতিবন্ধকতা আছে। রাজনীতি দুই ভাগে বিভক্ত।
স্বাধীনতার সময় যারা বিরোধিতা করেছিলেন, তারাই এখন বড় একটি অংশ। তারা যে শিক্ষা চায়, সে শিক্ষা জাতির ভবিষ্যতের জন্য কল্যাণকর নয়। এরপরেও আমি মনে করি শিক্ষাকে বিশ্বমানের করার জন্য অন্তত ঐক্যমতে থাকতে হবে। শিক্ষাকে জীবনমুখী করতে হবে। বের করে আনতে হবে পরীক্ষা ও মুখস্তবিদ্যা থেকে। শিক্ষাকে প্রকৃত অর্থে ভবিষ্যৎমুখী করতে হবে। জোর দিতে হবে বিজ্ঞান, মানবিক শিক্ষায়।’
‘ভালো শিক্ষকের প্রয়োজন। আর এই তাগিদ থাকতে হবে প্রাইমারি স্কুল থেকে। এখানে প্রচুর বিনিয়োগ দরকার। এক সরকার এসে নীতি গ্রহণ করলো, আরেক সরকার এসে তা বাদ দিলে চলবে না। দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে, কোন ধরনের শিক্ষা মানুষের কল্যাণে আসবে, তা নিয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।’
‘এজন্য সবার আগে শিক্ষকের মর্যাদা, বেতন-ভাতা বাড়াতে হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক যেখান থেকে বাজার করেন, একজন ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারও সেখান থেকে বাজার করেন। কে কোন পণ্যটি কিনতে পারছেন, তা আপনাকে খেয়াল করতে হবে। শিক্ষককে কষ্টে রেখে আপনি তো ভালো শিক্ষার্থী তৈরি করতে পারবেন না। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক যোগ দেওয়ার সময় বেতন হওয়া উচিত ৫০ হাজার টাকা। ভালো শিক্ষক না হলে ভালো জাতি গঠন হবে না। এই প্রশ্নে কোনো আপস থাকতে পারে না। এ নিয়ে কোনো রাজনীতি হতে পারে না। সম্মান দিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরাই প্রাইমারির শিক্ষক হবে।’ যোগ করেন অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।
একই বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করে ড. আবুল বারকাত বলেন, ‘আমি বারবার বলেছি, প্রাথমিক শিক্ষকের বেতন এক টাকা হলেও বিসিএস ক্যাডারের চেয়ে বেশি হওয়া উচিত। বিসিএস ক্যাডারের চেয়ে বেতন বেশি হলে সমস্ত মেধাবীরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরির জন্য দরখাস্ত করবে। হ্যাঁ, করবেই। আর এক টাকা বেশি বলার আরেকটি অর্থও আছে। অন্তত সম্মানের প্রশ্নে।’
তিনি বলেন, ‘আপনাকে শিক্ষার উন্নয়নের কথা বলা হলো। আপনি প্রথমে একটি ভবন বানালেন। শিক্ষার্থীরাও তৈরি আছেন। স্কুল দিলেই শিক্ষার্থীরা আসবেন। শিক্ষক লাগবে। এই তিনটি হলেই শিক্ষার পরিবেশ হয়ে গেলো। এটিকে আমি বলি উন্নয়নের সফট পার্ট (সহজ অংশ)। কঠিন পার্টটি হচ্ছে পরের। অর্থাৎ জ্ঞানের পরিধি বাড়ানোর জন্য শিক্ষকদের যে মান তার কিন্তু ঘাটতি রয়ে গেলো। শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের এই এই জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য শিক্ষকের যে সক্ষমতা, তা নেই।’
প্রাথমিক শিক্ষার মানের ওপর জোর দিয়ে এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, ‘পঞ্চম শ্রেণি পাসের একজন শিক্ষার্থীর যে জ্ঞান থাকার কথা, তা নেই। পঞ্চম শ্রেণি পাস করা শতকরা ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী দ্বিতীয় শ্রেণি মানের জ্ঞান অর্জন করা।’
‘প্রাথমিকের বাচ্চারাই আমাদের সম্পদ। তাদের যদি আমরা সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে না পারি, তাহলে সবই হারাতে হবে। অর্থাৎ আমাদের সক্ষমতার ফাঁদে পড়তে হবে। প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন নিয়ে আমি জোর দিয়ে বলছি। সব সময়ই বলি। নীতিনির্ধারকরা বুঝতে চান না। কারণ বুঝলেই সমস্যা।’
‘ধরুন, একটি জেলায় শিক্ষা সপ্তাহের অনুষ্ঠান চলছে। জেলা প্রশাসক পায়রা ওড়াচ্ছেন। অথচ আবেদন রাখে ওই জেলার সবচেয়ে প্রবীণতম শিক্ষককে দিয়ে পায়রা ওড়ানো। আপনি সব কিছুই আমলাতান্ত্রিকতার মধ্যে প্রবেশ করালে সমাজে ভারসাম্য আসে না। শিক্ষার মান আমলারা বাড়াতে পারবে না। শিক্ষার মান বাড়াতে হলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সিদ্ধান্ত নিতে হবে’-যোগ করেন অধ্যাপক বারকাত।
এএসএস/এএসএ/জেআইএম