ডলার ও জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্যে পাঠ্যবই ছাপানো অনিশ্চিত
ডলার ও জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং বিদ্যুৎ ঘাটতির প্রভাব পড়েছে পাঠ্যবই মুদ্রণেও। বই ছাপানোর মূল উপাদান কাগজসহ কালি ও অন্যান্য পণ্যের দাম বেশ চড়া। বেড়েছে পরিবহন খরচ ও শ্রম মজুরিও। চলমান এই ঊর্ধ্বমূল্যের বাজারে নতুন বই ছাপানোর বিষয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে না ছাপাখানাগুলো। এরই মধ্যে নতুন বই না ছাপানোর বিষয়ে নিজেদের অনাগ্রহের কথা জানিয়ে দিয়েছে নয়টি প্রেস।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কার্যাদেশ পাওয়া নয়টি প্রতিষ্ঠান চিঠি দিয়ে বিষয়টি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে (এনসিটিবি) জানিয়ে দিয়েছে। ফলে টেন্ডার ডেকেও বিপাকে পড়েছে সংস্থাটি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, কাগজসহ বিভিন্ন উপাদানের মূল্যবৃদ্ধি বিশেষত ডলার ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণ দেখিয়ে কয়েকটি প্রেস বই মুদ্রণের বিষয়ে অনীহার কথা জানিয়েছে। কিন্তু আজ যে সংতট এর দায় অনেকটাই প্রিন্টারদেরই। কেননা, তারা আমাদের বেঁধে দেওয়া দামের (প্রাক্কলন) চেয়েও অনেক কম দামে টেন্ডার জমা দিয়েছিল। যদি তারা সরকার নির্ধারিত দামে ডাক দিতেন তাহলে আজ এ সংকটে পড়তেন না। এখন সংকট থেকে উত্তরণের পথ খোঁজার বিকল্প নেই।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এনসিটিবি আগামী বছরের জন্য এবার প্রায় ৩৫ কোটি বই ছাপানোর উদ্যোগ নিয়েছে। মোট পাঁচটি টেন্ডারে এসব বই ছাপানোর কাজ দেওয়া হবে। এর মধ্যে গত জুন-জুলাইয়ে প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের একটি অংশের টেন্ডার ডাকা হয়। প্রাক-প্রাথমিকের টেন্ডার নিষ্পত্তি হয়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ক্ষেত্রে ডলার ও জ্বালানির বর্ধিত মূল্যের চেয়েও বড় সমস্যা ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত কম দরে কাজ করতে চান প্রিন্টাররা। সে লক্ষ্যে তারা টেন্ডার দাখিল করেন।
এনসিটিবি কর্মকর্তারা জানান, প্রাথমিকের বই প্রতি ফর্মা ২ টাকা ৯০ পয়সা প্রাক্কলন করা হয়েছিল। এসব বই ৮০ জিএসএমে ছাপানো হয়। কিন্তু প্রিন্টাররা সর্বনিম্ন ১ টাকা ৯০ পয়সা পর্যন্ত দর দিয়েছেন, যা সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে ৩৫ শতাংশ কম। তবে বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে এনসিটিবি ১৮ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কম দর দিয়েছেন। এ নিয়ে আগামীকাল সোমবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।
অন্যদিকে মাধ্যমিকের কিছু বই ৭০ জিএসএমে ছাপানো হয়। কালার প্রিন্টের এসব বইয়ের প্রাক্কলিত দর ২ টাকা ৬৮ পয়সা। আর কিছু বই ৬০ জিএসএমে ছাপানো হয়। এগুলোর প্রাক্কলন ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রতি ফর্মায় ১ টাকা ৯৩ পয়সা। এখানেও প্রিন্টাররা সর্বনিম্ন ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত কম দর দিয়েছেন।
প্রিন্টার্স মালিকরা জানান, বাজারে বিভিন্ন উপাদানের দাম বেড়ে গেছে। টেন্ডার দেওয়ার সময়ে যে কাগজের দর ছিল ৯০ থেকে ৯৫ হাজার টাকা প্রতি মেট্রিক টন, এখন তা ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা। কভারের আর্ট কার্ডের দাম প্রতি মেট্রিক টন ১ লাখ ১০ হাজার টাকা ছিল, যা বেড়ে ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা হয়েছে। পাঠ্যবইয়ের কাগজ তৈরি হয় ভার্জিন পাল্পে, যা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। টেন্ডার দেওয়ার সময় টাকার হিসাবে প্রতি ডলারের দাম ছিল ৯২ টাকা। যা এখন খোলাবাজারে ১২০ টাকা। কালি তৈরি হয় ডিজেল থেকে। ডিজেলের দামও অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। বই বাঁধাইয়ের কাগজ আসে তাইওয়ান থেকে। এ পণ্যটির দাম ৫০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। আগে যে দূরত্বে ট্রাকের ভাড়া ছিল ১০ হাজার টাকা, এখন তা ১৫ হাজার। জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ায় শ্রমিকরাও মজুরি বাড়িয়ে দিয়েছেন। এ অবস্থায় ছাপাখানাগুলোর সার্বিক ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান জাগো নিউজকে বলেন, মাধ্যমিকের ২৭০ লটের মূল্যায়ন বর্তমানে চলছে। এ টেন্ডারের দর অনুযায়ী এখন বই ছাপানো হলে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ লোকসান হবে। সব পণ্যের বাজার ঊর্ধ্বমুখী। এটা কোথায় গিয়ে ঠেকবে কেউ বলতে পারে না। ফলে ক্ষতির হার আরও বাড়তে পারে। এ অবস্থায় নিশ্চয়ই কেউ ভর্তুকি দিয়ে কাজ করবে না।
তিনি বলেন, বছর শেষ হওয়ার আগে এনসিটিবির বই লাগবে, যদিও সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নেই এখনো। চলতি বছর শিক্ষার্থীরা মার্চ-এপ্রিলে নতুন বই হাতে পেলেও আগামী বছর সেটি হয়তো সম্ভব হবে না। নতুন কারিকুলামের প্রথম-দ্বিতীয় ও ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির বই ছাপানোর এখনো দরপত্রই আহ্বান করা হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত পাঁচটি প্রতিষ্ঠান প্রাথমিকের বই ছাপানোর কাজ পেয়েও ছেড়ে দিয়েছে। আর মাধ্যমিকে অন্তত ৯টি প্রতিষ্ঠান কাজ না নেওয়ার বিষয়ে এনসিটিবিকে চিঠি দিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে- নয়ন মনি প্রিন্টার্স, মুছা প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স, তায়েবা প্রিন্টার্স, বর্ণমালা প্রেস ও দোহার প্রিন্টিং প্রেস। এ স্তরে মোট ৪৪টি প্রতিষ্ঠান নতুন বই ছাপানোর কাজ পেয়েছে।
এমএইচএম/এমকেআর/এএসএম