ফটিকছড়ির চা বাগান থেকে বছরে অর্ধকোটি টাকা চাঁদা নেয় সন্ত্রাসীরা
ফটিকছড়ির সাতটি চা বাগান থেকে বছরে প্রায় ৫০ লাখ টাকারও অধিক চাঁদা আদায় করে পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সংগঠনের সন্ত্রাসীরা। পূর্ব নির্ধারিত চাঁদা সময়মতো পরিশোধ না করলে বাগান ম্যানেজারকে অপহরণসহ মারধরের ঘটনাও ঘটে। বাৎসরিক নির্ধারিত চাঁদা ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে ‘বিশেষ উৎসব অনুষ্ঠান’ উপলক্ষে ওই সন্ত্রাসী গ্রুপ বাগানগুলো থেকে চাঁদা আদায় করে। চা বাগান সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, উপজেলার কাঞ্চননগর, ভূজপুর ও দাঁতমারার পার্শ্ববর্তী পাহাড় এলাকায় এসব চাঁদা পৌঁছে দিতে হয়। বর্তমানে এসব বাগান কর্তৃপক্ষকে নতুন বছরের চাঁদা পৌঁছে দিতে নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করছে সন্ত্রাসী গ্রুপটি।
গত রোববার উপজেলার কর্ণফুলী চা বাগানের দুই ম্যানেজারের উপর হামলার ঘটনার পর এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। সেনাবাহিনীর বাইন্যেছোলা ক্যাম্পের কর্পোরাল সরোয়ার বলেন, চা বাগানের ম্যানেজারের উপর সন্ত্রাসী হামলা, উপজাতিদের ঘর পোড়ানোর ঘটনায় এলাকাগুলোতে সেনাবাহিনীর টহল টিম জোরদার করা হয়েছে। সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার রামগড়, মানিকছড়ি ও লক্ষ্মীছড়ি সীমানা ঘেঁষে ফটিকছড়ির দাঁতমারা, নিউ দাঁতমারা, নাছেহা, আছিয়া, নেপচুন, ডলু কৈয়াছড়া ও কর্ণফুলী চা বাগান অবস্থিত। দুর্গম ও গভীর বনাঞ্চল ঘেরা পার্বত্য এলাকা লাগোয়া হওয়ায় চা বাগানগুলোর উপর প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পায় পাবর্ত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সংগঠনগুলো। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সংগঠনগুলো এসব বাগান থেকে নিয়মিত মোটা অংকের চাঁদা আদায় করে থাকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বাগানের ব্যবস্থাপক জানান, বাগানের আয়তন ও অবস্থা ভেদে তারা চাঁদার হার ধার্য করে দেয়া হয়। বছরের প্রথম দিকেই চাঁদার টাকা পরিশোধ করতে হয়। নির্দিষ্ট করা চাঁদার বাইরেও পার্টির বিশেষ কোনো প্রোগ্রাম উপলক্ষেও চাঁদা আদায় করা হয় বাগানগুলো থেকে। চাঁদা নিয়ে বিরোধের জের ধরে ইতোপূর্বে নেপচুন বাগানের ব্যবস্থাপক অপহৃত হয়েছিলেন বলেও জানান তিনি।
সূত্র মতে, দুর্গম ও জনশূশ্য হওয়ায় এলাকাগুলো তাদের কাছে অনেকটা মুক্তাঞ্চলে পরিণত হয়েছে। অন্য বাগানগুলোর মতো কর্ণফুলী চা বাগান কর্তৃপক্ষও পাহাড়ি সংগঠনগুলোকে নিয়মিত চাঁদ দিয়ে থাকে। ওই এলাকাটি ইউপিডিএফ ও জেএসএস (সংস্কার) এর নিয়ন্ত্রণে থাকায় বাৎসরিক চাঁদা তারাই আদায় করে।
স্থানীয় একটি সূত্র জানায়, লক্ষ্মীছড়ির সীমানার লাগোয়া কর্ণফুলী চা বাগানের বিশাল এলাকা তারা জোরপূর্বক দখল করে সেখানে কিছু নিরীহ উপজাতি পরিবারকে ঘর বানিয়ে বসিয়েছে। সেখানে কমপক্ষে ৫শ একর জমি তারা দখল করেছে। এরমধ্যে জাফরাবাদ, দুইদ্যেখোলা, ট্যাকবাড়িয়া, সরকারি ডেবা, রক্তছড়ি, মানিকপুর এলাকা রয়েছে।
সরকারের কাছ থেকে লিজ নেয়া এ জায়গাগুলোর ভূমি কর পরিশোধ করলেও সন্ত্রাসীদের বাধারমুখে সেখানে চা আবাদ করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ চা সংসদের চেয়ারম্যান ও আছিয়া চা বাগানের ব্যবস্থাপক মমতাজুল হাসান মন্টু পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের চাঁদা আদায় সম্পর্কে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম ঘেঁষা বাগানগুলো নিয়মিতই তাদের চাঁদা দিতে হয়। তবে কে কতো টাকা চাঁদা দেয় কেউ তা প্রকাশ করেন না।
তিনি বলেন, সমতল জেলায় হলেও ভৌগলিক কারণে বাগানগুলোর কর্তৃপক্ষ পাহাড়ি সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর হাতে অনেকটা জিম্মি। এদিকে রোববার কর্ণফুলী চা বাগানের দুই কর্মকর্তা মো. শাহনেওয়াজ ও মো. ইলিয়াছ পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের হামলায় গুরুতর আহত হওয়ার ঘটনায় ফটিকছড়ির ১৭টি চা বাগানে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
হালদা ভ্যালি চা বাগানের সিনিয়র ব্যবস্থাপক ও বাংলাদেশীয় চা সংসদের ভাইস চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ফটিকছড়ির ১৭টি চা বাগানে প্রায় ২৫-৩০ হাজার ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী শ্রমিক নিয়োজিত। তারা চা বাগানের কর্মসংস্থানে জীবিকা নির্বাহ করছেন। কর্ণফুলী চা বাগানের দুই সিনিয়র কর্মকর্তাকে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা অমানুষিক নির্যাতন করে আহত করার ঘটনায় এসব শ্রমিকরাও বিক্ষুব্ধ।
তিনি বলেন, বাগানগুলোর কর্তৃপক্ষ সরকারকে কোটি কোটি টাকার ভ্যাট ও ভূমি কর দিচ্ছে। নিরাপদে ও অবাধে বাগানগুলোতে চা উৎপাদনের পরিবেশ নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব।
সরকার চা সংশ্লিষ্টদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করলে দেশের জাতীয় এ চা শিল্পের প্রসার বাধাগ্রস্ত হবে। এদিকে, কর্ণফুলী চা বাগানের ব্যবস্থাপক মো. শাহ নেওয়াজ ও মো. ইলিয়াছের উপর পাহাড়ি সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় বাংলাদেশীয় চা সংসদের কর্মকর্তারা সোমবার ফটিকছড়িতে এক জরুরি বৈঠক করেছেন।
বৈঠকে ঘটনার জন্য তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়। বৈঠকে বাংলাদেশীয় চা সংসদের চেয়ারম্যান মমতাজুল হাসান মন্টু, সাবেক চেয়ারম্যান সরওয়ার কামাল, ভাইস চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীল আলম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
জীবন মুছা/এসকেডি/বিএ