ভর্তিতে নিজেদের চাপ কমাতে মেধাবীদের স্বপ্ন ভাঙছে বুয়েট
অডিও শুনুন
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ভর্তিতে যোগ্যতা হিসেবে পদার্থ বিজ্ঞান ও রসায়ন বিষয়ে নম্বর বাড়ানো হয়েছে। এ বছর পদার্থ বিজ্ঞান ও রসায়ন বিষয়ে গড় নম্বর ৯৩ চাওয়া হয়েছে। ফলে মোট নম্বর বেশি থাকলেও পদার্থ বিজ্ঞান ও রসায়ন বিষয়ে গড়ে ৯৩ নম্বর না থাকায় অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারছেন না। এ অবস্থায় বুয়েটে ভর্তির স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ায় অনেক শিক্ষার্থী মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছেন।
করোনা পরিস্থিতিতে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ থাকায় ২০২১ সালের এইচএসসি-সমমান পরীক্ষা বিলম্ব করে আয়োজন করা হয়। সে কারণে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে এবং পরীক্ষার সময় ও নম্বর কমিয়ে পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়া হয়। অন্যান্য বিষয়ে এসএসসি-সমমান ও জেএসসি-সমমানের ফলের ওপর নম্বর ম্যাপিং করে ফলাফল দেওয়া হয়।
সে কারণে ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে নিতে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি আহ্বান জানান। এর পরিপ্রেক্ষিতে বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষা সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ।
জানা গেছে, বুয়েট ভর্তি পরীক্ষায় গণিত, পদার্থ বিজ্ঞান ও রসায়নে গড়ে ৯০ নম্বর চাওয়া হতো। তবে এবার গণিতে গড় নম্বর ৮৫ করে পদার্থ বিজ্ঞান ও রসায়ন বিষয়ে ৯৩ চাওয়া হয়েছে। সে কারণে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় বসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কারও কারও গড়ে এক বা দুই নম্বর কম থাকায় ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারছেন না।
রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে পাস করেন এক শিক্ষার্থী। গণিতে ২০০ নম্বরের মধ্যে ১৯৮ ও অন্যান্য বিষয়ে ৯৫ নম্বরের বেশি পেলেও রসায়নে ৯২ পাওয়ায় বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারছেন না তিনি। এ কারণে এই শিক্ষার্থীসহ তার পরিবারের সদস্যরা হতাশ হয়ে পড়েছেন।
এ বিষয়ে ওই শিক্ষার্থী বলেন, জীবনের প্রথম পছন্দ ছিল বুয়েটে ভর্তি হবো। সে কারণে মনোযোগ দিয়ে পড়ালেখা করেছি। করোনার কারণে গত দুই বছর আমাদের তেমন ক্লাস-পরীক্ষা হয়নি। প্রতিদিন চারদিকে করোনায় আক্রান্ত আর মৃত্যুর সংবাদের মধ্যে আতঙ্কে দিন পার করতে হয়েছে। সে কারণে পরীক্ষার জন্য ভালো প্রস্তুতি নিতে পারিনি।
তিনি বলেন, এমন পরিস্থিতির মধ্যে তিন বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছি। পরীক্ষায় ভালো ফল পেলেও বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পাচ্ছি না। ভর্তি পরীক্ষায় নম্বর বাড়িয়ে দেওয়ায় তার অনেক সহপাঠীর স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন সূচনা।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আরেক শিক্ষার্থী দিব্যজ্যোতি রায় দীয়া চার নম্বর কম থাকায় বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষায় বসতে পারছেন না। তিনি জানান, বুয়েটে তো নম্বরের ওপর ভিত্তি করে ভর্তি করাচ্ছে না। প্রথমে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হবে। সেখানে পাস করলে লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবে।
তবে কেন নম্বর বাড়ানো হলো? এমন প্রশ্ন তুলে দীয়া বলেন, নম্বর বাড়িয়ে আমার মতো হাজারো শিক্ষার্থীর স্বপ্ন ভেঙে দেওয়া হয়েছে। আমাদের সঙ্গে অবিচার করা হয়েছে। দেশে করোনা পরিস্থিতি থাকলে সব ভর্তিতে শর্ত কমিয়ে সুযোগ বাড়ানো হলেও বুয়েটে তার উল্টোটা করা হয়েছে। এতে অনেকের পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মেধাবীদের পড়ালেখায় ধরে রাখতে এবারও বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণে বিষয়ভিত্তিক গড় নম্বর ৯০ করার দাবি জানান তিনি।
শুধু এই দুই শিক্ষার্থী নন, তাদের মতো এমন অনেকে সর্বোচ্চ ফল পেলেও বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারছেন না। দুই বিষয়ে গড় নম্বর বাড়ানোর কারণে তারা বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বুয়েটের ভর্তি কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবু সিদ্দিক বুধবার (২০ এপ্রিল) জাগো নিউজকে বলেন, আমরা এ বছরের ফলাফল বিশ্লেষণ করে পদার্থ বিজ্ঞান ও রসায়ন বিষয়ে নম্বর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যেহেতু এবার এইচএসসি পরীক্ষায় গণিতে সব শিক্ষার্থী পরীক্ষা দেয়নি সে কারণে এ বিষয়ে আগের চাইতে নম্বর কমানো হয়েছে। এছাড়া বুয়েটে গত বছরের তুলনায় এবার ৬০টি আসন বাড়িয়ে এক হাজার ২৭৫টি করা হয়েছে।
তিনি বলেন, জিপিএ-৫ পাওয়া ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী এখানে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেন। পরীক্ষার্থী বেশি হলে আমাদের ওপর চাপ তৈরি হয়, সে কারণে এবার নম্বর বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ভর্তি পরীক্ষা বাবদ আদায় করা অর্থ ফেরত দেওয়া হয়। সে কারণে একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় নম্বর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়।
তবে ভর্তি পরীক্ষার চাপ কমাতে বুয়েটের এ সিদ্ধান্তে অনেক অভিভাবক ও শিক্ষার্থী হতাশ হয়ে পড়েছেন। এমনকি ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে না পেরে গতকাল (মঙ্গলবার) আজিমপুরের এক শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
আমার সন্তান তার বন্ধুদের কাছে মুখ দেখাতে পারছে না এমন দাবি করে এক অভিভাবক জানান, অনেক স্বপ্ন ছিল ছেলেটা বুয়েটে ভর্তি হবে। সেজন্য দিনরাত পড়ালেখা করেছে। এখন ভর্তি পরীক্ষায়ও অংশ নিতে পারছে না।
তিনি আরও বলেন, যোগ্যতা না থাকলে ভর্তি পরীক্ষায় সুযোগ পেলেই কেউ চান্স পায় না, মেধা দিয়ে টিকতে হয়। অথচ দেশের দুর্যোগকালীন বুয়েটের এমন সিদ্ধান্ত কাঙ্ক্ষিত নয়। তারা দ্রুত এটি পরিবর্তন করে গত বছরের মতো বিষয়ভিত্তিক গড় নম্বর ৯০ করার দাবি জানান। না হলে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী পড়ালোখায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এসব বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বুয়েটের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সত্য প্রসাদ মজুমদার জানান, একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় ভর্তি পরীক্ষায় নম্বর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এখানে বুয়েট ভিসির কিছু করার নেই। তারা সবকিছু বিশ্লেষণ করে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলেও জানান উপাচার্য।
এদিকে, বুয়েট ভর্তির জন্য এইচএসসি বা সমমান পরীক্ষায় পদার্থবিদ্যা ও রসায়নের প্রতিটিতে অন্তত ৯৩ শতাংশ নম্বর পেতে হবে মর্মে যে শর্ত দেওয়া হয়েছে, তার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদন করা হয়েছে হাইকোর্টে। রিটে বুয়েটের উপাচার্য, রেজিস্ট্রার ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবকে বিবাদী করা হয়েছে। জনস্বার্থে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় মঙ্গলবার (১৯ এপ্রিল) সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. ইউনুস আলী আকন্দ এ রিট করেন।
বুয়েটে ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষার প্রাথমিক ধাপ হবে আগামী ৪ জুন। এবার দুই ধাপে অনুষ্ঠিত হবে পরীক্ষা। প্রাথমিক ধাপে উত্তীর্ণদের নিয়ে চূড়ান্ত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে ১৮ জুন।
এমএইচএম/কেএসআর/এএসএম