আলোচিত সমালোচিত মেডিকেলের ‘বিতর্কিত’ ভর্তি পরীক্ষা


প্রকাশিত: ০৬:৩৪ এএম, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৫

স্বাস্থ্য সেক্টরে বছরের বহুল আলোচিত সমালোচিত ঘটনা ছিল মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের ‘বিতর্কিত’ ভর্তি পরীক্ষা। গত ১৮ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধীনে কেন্দ্রীয়ভাবে রাজধানীসহ সারাদেশে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের গুরুতর অভিযোগ ওঠে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপসহ বিভিন্ন ডিজিটাল মাধ্যমে পরীক্ষার আগের রাতেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে হওয়ার অভিযোগ তুলে শিক্ষার্থীরা। ভর্তি পরীক্ষার আগে ও পরে ঢাকা ও  রংপুরে ডাক্তার, শিক্ষক, কোচিং সেন্টারের পরিচালক, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের একজন সহকারি পরিচালককে আটক করে র‌্যাব। র‌্যাবের হাতে আটক মঞ্জুরী কমিশনের পরিচালকের মৃত্যুও হলে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ আরো দৃঢ় হয়।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতর অস্বীকার করলেও এ নিয়ে উচ্চ আদালতে রিট ও পাল্টা রিট মামলা, পরীক্ষা বাতিল করে পুনরায় ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের দাবিতে একমাসেরও বেশি সময় রাজপথ ছিল উত্তাল। শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সচেতন নাগরিকরা এ ভর্তি পরীক্ষাকে ‘কলংকিত ও বিতর্কিত’ বলে চিহ্নিত করেন।

রাজধানীসহ সারাদেশে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান, মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল, প্রতিবাদ সমাবেশ, সংবাদ সম্মেলন, মেডিকেল কলেজ ঘেরাও কর্মসূচী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি পেশ এবং আমরণ অনশনসহ লাগাতার বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করেন।

কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বিক্ষুব্ধ আন্দোলনে রাজপথ উত্তাল হয়ে ওঠে। আন্দোলন চলাকালে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা পুলিশী হামলার শিকারও হন। বিএনপি, জাতীয় পার্টি, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশ (টিআইবি) ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা ভর্তি পরীক্ষা বাতিলের দাবি জানান।

সমাজের বিভিন্ন স্তরের নাগরিকদের সমন্বয়ে মোট ১৭ সদস্যের ‘মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস বিষয়ক গণতদন্ত কমিটি’ গঠিত হয়। গণতদন্ত কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ তদন্ত শেষে প্রতিবেদন দাখিল করে বলেন, “সকল তথ্য-প্রমাণ সাক্ষ্য ও পরিস্থিতি নানা দিক বিবেচনায় মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ ২০১৫-১৬ সেশনের ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। নতুনভাবে মেডিকেল পরীক্ষা নেওয়ার সুপারিশ করছি।”

এদিকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দীর্ঘ মেয়াদে চললেও শুরু থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি বলে দাবি করে আসছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বিভিন্ন দফায় গণমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাতকারে বলেন, তারা বিভিন্ন উপায়ে তদন্ত করে দেখেছেন পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের কোনো ঘটনা ঘটেনি।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তৎকালিন পরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা ও জনশক্তি উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল হান্নান একাধিকবার জাগো নিউজকে বলেছিলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে এমন প্রমাণ তারা কারও কাছ থেকে পাননি। র‌্যাব ও অন্যান্যরা যে সব প্রশ্নপত্র উদ্ধার করেছে সেগুলোর সঙ্গে মূল প্রশ্নপত্রের কোনো মিল পাওয়া যায়নি। শিক্ষার্থী কিংবা তাদের অভিভাবকরা মুখে মুখে বললেও সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ কেউ দিতে পারেনি।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) নেতারা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে শিক্ষার্থীদের কাছে পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার ব্যাপারে তথ্যপ্রমান চাইলেও শিক্ষার্থীরা তাদের ডাকে সাড়া দেয়নি। বিএমএ তদন্ত প্রতিবেদনে তথ্যপ্রমান ফাঁস হয়নি বলে উল্লেখ করা হয়।

গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীসহ সারাদেশের ২৩টি কেন্দ্রের ৪৪টি ভেন্যুতে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ভর্তি পরীক্ষায় মোট ৮২ হাজার ৯৬৪ জন পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে। তাদের মধ্যে পাস করে মোট ৪৮ হাজার ৪৪৮ জন পরীক্ষার্থী, অর্থাৎ ৫৮ দশমিক ৪ শতাংশ। ১০০ নম্বরের নৈব্যক্তিক প্রশ্নপত্রে এ বছর ভর্তি পরীক্ষায় সর্বোচ্চ প্রাপ্ত নম্বর ৯৪ দশমিক ৭৫। সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ মিলিয়ে মোট আসন সংখ্যা ১১ হাজার ৩৯টি। তন্মধ্যে সরকারি মেডিকেল কলেজে আসন সংখ্যা ৩ হাজার ৬৯৪টি।

গণতদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে যা বলা হয় :
গত কয়েক বছরে বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস প্রায় নিয়মিত ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে তার বিভিন্ন আলামতও পাওয়া গেছে। এরসঙ্গে শক্তিশালী বাণিজ্যিক জাল ও ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর যোগাযোগের বিষয়েও বিভিন্ন খবর পাওয়া গেছে। মেডিকেল ও ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষার আগে প্রাপ্ত বা ফাঁসকৃত প্রশ্নপত্রের সঙ্গে পরীক্ষার হলে দেয়া প্রশ্নপত্রের প্রায় সর্বাংশে মিল পাওয়া যাচ্ছে।

গণতদন্ত কমিটির আহবায়ক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, পরীক্ষার আগে বিভিন্ন অঞ্চলের পরীক্ষার্থীরা টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন পাওয়র প্রস্তাব পায়। যারা টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন নিয়েছে তাদের ভর্তি নিশ্চিত হয়েছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিরুদ্ধে সারাদেশে আন্দোলন চলাকালে প্রশ্নপত্র ফাঁসেরই অভিযোগে র‌্যাব কর্তৃক অভিযুক্ত ও ধৃত ইউজিসি কর্মকর্তার রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে এবং তার থেকে প্রাপ্ত কোনো তথ্য বা বক্তব্য জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। এছাড়া যাদেরকে আটক করা হয়েছে তাদের কোনো বক্তব্য বা তথ্যও প্রকাশ করা হয়নি।   

একই ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলেও অনেকরকম অসঙ্গতি পাওয়া গেছে। যেমন কেউ কম নম্বর পেয়ে মেধা তালিকায় স্থান পেয়েছে, আবার বেশি নম্বর পাওয়া সত্ত্বেও কাউকে অপেক্ষমাণ তালিকায় রাখা হয়েছে। একই নম্বর পেয়ে কেউ মেধা তালিকায় কেউ অপেক্ষমাণ তালিকায়।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ নিয়ে কোনো তদন্ত না করে তড়িঘড়ি ভর্তির উদ্যোগ নিয়েছে। সেহেতু এসব ভর্তি পরীক্ষায় ব্যাপক অনিয়ম ও বাণিজ্যিক তৎপরতা হয়েছে। টাকার বিনিময়ে ভর্তি নিশ্চিত করার জন্য প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ বিভিন্ন পথ অবলম্বন করা হয়েছে।

তদন্ত প্রতিবেদনে মোটে ১১টি সুপারিশ করে কমিটির সদস্যরা। তাৎক্ষণিক সুপারিশে বলা হয়- ‘অনিয়ম, দুর্নীতি, প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় এই বছরের মেডিকেল ও ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষা তার নৈতিক ও আইনগত ভিত্তি হারিয়েছে। আমরা বাধ্য হচ্ছি এই ভর্তি পরীক্ষা বাতিল করে নতুনভাবে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের সুপারিশ করতে।’

সামগ্রিক ভবিষ্যতের সুপারিশসমূহ হলো- ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করে মেডিকেল ও ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের দায়িত্ব চিকিৎসক শিক্ষকদের সমন্বয়ে একটি ‘মেডিকেল শিক্ষা কমিশন’ গঠন করা, গণপরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রকাশ ও প্রচার নিয়ন্ত্রণে নতুন বিধি/প্রবিধান প্রণয়ন করা সেইসঙ্গে পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইন- ১৯৮০ ও অপরাধী ধরতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন-২০০৬ প্রয়োগ নিশ্চিত করা ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের পরীক্ষায় একটি সমন্বিত পদ্ধতি অনুসরণ করা।

এমইউ/আরএস/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।