হাটহাজারী মাদরাসায় মহাপরিচালক নেই এক বছর ধরে
দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসা। দেশের কওমি অঙনের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক পদে ছিলেন আল্লামা শাহ আহমদ শফী। বছরখানেক আগে ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে তিনি পদত্যাগ করেন। সেই থেকে মাদরাসাটির মহাপরিচালক পদে কাউকে নিয়োগ দেয়া হয়নি। শিক্ষকদের তিন সদস্যের একটি কমিটির মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে মাদরাসা। কখন মহাপরিচালক পদে নিয়োগ দেয়া হবে সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু জানাতে পারছেন না মাদরাসা পরিচালনার দায়িত্বে থাকা শুরা সদস্যরা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ১৯৮৬ সাল থেকে টানা ৩৪ বছর হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক ছিলেন আহমদ শফী। দীর্ঘদিন শুধু মাদরাসাটি নয়, পুরো কওমি অঙনে তার একচ্ছত্র প্রভাব ছিল। পাশাপাশি মাদরাসাটির নায়েবে মোহতামিম ছিলেন আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী। শফী-পরবর্তী মহাপরিচালক পদের অন্যতম দাবিদার ছিলেন বাবুনগরী। এরই মধ্যে ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয় অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। সংগঠনটির আমির ছিলেন আহমদ শফী ও মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে হেফাজতে দেশের ধর্মীয়সহ নানা ইস্যুতে আন্দোলন করে। ২০১৩ সালে এসে ইসলাম ও রাসুল (সা.)-কে কটূক্তিকারীদের ফাঁসি চেয়ে আন্দোলন শুরু করে। ওই বছর ১৩ দফা দাবি উত্থাপন করে ৫ মে সারাদেশ থেকে ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ করে। ওই সময় রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। শাহবাগে থাকা গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীদের সঙ্গেও তাদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরদিন ৬ মে হেফাজতের তৎকালীন মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর আহমদ শফীর সঙ্গে সমঝোতা করে কৌশলে তাদের সহিংস আন্দোলন থামায় সরকার।
এ ঘটনার পর থেকে শাহ আহমদ শফী এবং বাবুনগরীর মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব মাদরাসার বিভিন্ন ইস্যুতেও প্রভাব ফেলে। বাবুনগরীপন্থিদের দাবি, আহমদ শফীর ছেলে আনাস মাদানি বাবুনগরীর বিষয়ে তার বাবাকে ভুল বোঝায়। বাবাকে দিয়ে কৌশলে ২০২০ সালের ১৭ জুন এক বৈঠকের মাধ্যমে বাবুনগরীকে মাদরাসার সহযোগী পরিচালকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তার স্থলে নিয়োগ দেওয়া হয় শেখ আহমদকে। এরপর থেকে সংকট আরও ঘনীভূত হতে থাকে। একই বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর শফীর অব্যাহতি এবং তার ছেলে মাদরাসার সহকারী পরিচালক আনাস মাদানির বহিষ্কার দাবিতে ছাত্রবিক্ষোভ শুরু হয়। আন্দোলনের সময় মাদরাসায় ব্যাপক ভাঙচুর চলে। এর পরিপ্রেক্ষিতে একদিন পর ১৭ সেপ্টেম্বর শফী নিজে মহাপরিচালক পদ থেকে অব্যাহতি নেন এবং ছেলে আনাস মাদানিকেও সহকারী পরিচালক (শিক্ষা) থেকে বাদ দেন। এরপর ১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আহমদ শফীর মৃত্যু হয়।
শফীর মৃত্যুর পর থেকে হাটহাজারী মাদরাসার দৃশ্যপট আবার পাল্টাতে শুরু করে। তার দাফনের দিন হাটহাজারী মাদরাসায় শুরা বৈঠক বসে। বৈঠকে আবার জুনায়েদ বাবুনগরীকে শিক্ষা সচিব ও প্রধান শায়খুল হাদিস হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় এবং মাদরাসা পরিচালনার জন্য তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটিতে রাখা হয়- মাওলানা আবদুস সালাম চাটগামী, আল্লামা শেখ আহমেদ ও মাওলানা ইয়াহিয়াকে। অদৃশ্যভাবে বাবুনগরীই মাদরাসার পরিচালনাসহ সার্বিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতেন বলে জানা যায়। যে কারণে মহাপরিচালক পদে কেউ না থাকলেও শূন্যতা অনুভব করেনি মাদরাসা কর্তৃপক্ষ।
এদিকে গত ১৯ আগস্ট বাবুনগরী মারা যান। এর মধ্য দিয়ে মাদরাসা পরিচালনায় আবার নতুন করে সংকট দেখা দেয়। মাদরাসা পরিচালনা সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে শফীপন্থি ও বাবুনগরীপন্থি বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। মাদরাসার সবাই শফী-বাবুনগরী দুজনকেই সম্মান করেন। মৃত্যুর আগে এসে আহমদ শফী ছেলের পরামর্শে বাবুনগরীকে সহযোগী পরিচালক থেকে বাদ দেয়ার পর কিছুটা সংকট তৈরি হয়েছিল। আনাস মাদানিকে বাদ দেয়া এবং শায়খুল হাদিস পদে বাবুনগরী ফিরে আসার পর থেকে সংকট কেটে যায়। সবকিছু স্বাভাবিকভাবে পরিচালিত হতে থাকে।
জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাটহাজারী মাদরাসার এক শিক্ষার্থী জাগো নিউজকে বলেন, ‘শফী হুজুর ছেলের পরামর্শে বাবুনগরী হুজুরকে বাদ দেওয়ায় আন্দোলন হয়েছিল। মাদরাসায় আসলে শফীপন্থি ও বাবুনগরীপন্থি বলে কিছুই নেই। তারা দুজনই আমাদের ওস্তাদ। এখন দুজনই মারা গেছেন। মাদরাসা স্বাভাবিক নিয়মে পরিচালিত হবে।’
হাটহাজারী মাদরাসার শুরা কমিটির সদস্য ও ফটিকছড়ির জামিয়া উবাইদিয়া নানুপুর মাদরাসার পরিচালক মাওলানা সালাহউদ্দিন নানুপুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘মাসখানেকের মধ্যে শুরা বৈঠক হতে পারে। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হবে, মাদরাসায় নতুন মহাপরিচালক দেয়া হবে নাকি আগের তিন সদস্য দিয়ে পরিচালিত হবে। শুরা বৈঠক যেটি ভালো মনে করবে সেটিই সিদ্ধান্ত নেবে। তবে বৈঠকে বাবুনগরীর মৃত্যুতে শূন্য হওয়া পদে নিয়োগ হতে পারে।’
বাবুনগরীর মৃত্যুতে মাদরাসা পরিচালনায় কোনো সংকট তৈরি হয়েছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জুনায়েদ বাবুনগরী একসময় মাদরাসার সহযোগী পরিচালক ছিলেন। কিন্তু মৃত্যুর আগে তিনি পরিচালনার কোনো দায়িত্বে ছিলেন না। তিনি শুধু প্রধান শায়খুল হাদিস ও শিক্ষা সচিবের দায়িত্বে ছিলেন। সুতরাং তার মৃত্যুতে পরিচালনা পর্ষদের কোনো পদ খালি হয়নি। দ্বীনি এ প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিক নিয়মে পরিচালিত হবে। তবে বাবুনগরী ছিলেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। তার মৃত্যুতে দেশের এবং কওমি অঙনের যে শূন্যতা তা পূরণ হওয়ার নয়।’
এসএইচএস/জেআইএম