পুতুলনাট্যের শক্তি মানুষের সচেতনতার প্রসারে কাজ করবে
বাংলাদেশে পুতুলনাট্যের ঐতিহ্য হাজার বছরের। পৃথিবীর নানা গবেষক ও পুতুলনাট্য শিল্পীরা গবেষণা করে দেখেছেন যে ভারতবর্ষ হচ্ছে পুতুলনাট্যের আদিভূমি। প্রাচীন হরোপ্পা, মহেঞ্জোদারো সভ্যতার মধ্যেও পুতুলনাট্যের কিছু নমুনা পাওয়া গেছে। ধর্মীয় কথা প্রকাশ করার জন্যই সে সময় পুতুলনাট্যকে ব্যবহার করা হত। পাশাপাশি যাত্রাগান, পালাগান বিভিন্ন উপাখ্যান যেমন অশ্ব মেধযজ্ঞ, কৃষ্ণলীলা, রামযাত্রা ইত্যাদি গল্প পুতুলনাট্যের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হত।
অশোকের সময়ও পুতুলনাট্যে ছিল এ কথা প্রমাণিত। গবেষকগণ প্রমাণ করেছেন যে, বাংলাদেশেও রামায়ণ, মহাভারত, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন পতুলনাট্যের মধ্য দিয়ে পরিবেশিত হত। অবশ্য ভারতবর্ষে পুতুলনাট্য প্রাচীণকাল থেকে পুতুলনাচ নামে পরিচিত হয়ে আসছে।
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পুতুলনাট্যকে সময়োপযোগী করে সম্ভাবনার দিকটা কাজে লাগিয়ে শিক্ষা, গবেষণা, সচেতনতা, সামজিক দায়বদ্ধতা, চিকিৎসা, প্রচারণা, দেশীয় চেতনা ইত্যাদি বিষয়গুলোকে ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরার উদ্দেশ্য কাজ শুরু করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. রশীদ হারুন। আর এ লক্ষ্যেই ‘বাংলাদেশে পুতুলনাট্য গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্র’ এই নামে একটি গবেষণা কেন্দ্র সৃজন করেছেন অধ্যাপক ড. রশীদ হারুন। বাংলাদেশের পুতুলনাট্য নিয়ে প্রায় ১৫ বছর ধরে গবেষণা করছেন তিনি।
ইতোমধ্যে বাংলা একাডেমি থেকে বাংলাদেশে ঐতিহ্যবাহী পুতুলনাট্য নামে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশের শিল্পকলা একাডেমি থেকে ঐতিহ্যবাহী পুতুলনাট্যের প্রায় ৫০টি দলের শিল্পীদের চার থেকে পাঁচটি উৎসব ও একাধিক কর্মশালা সমন্বয় করেছেন তিনি। এছাড়া ২১ মার্চ বিশ্ব পুতুলনাট্য দিবস শিল্পকলা একাডেমি থেকে গত চার বছর ধরে পালন করা হচ্ছে। প্রতিবছর একজন ট্রাডিশনাল পুতুলনাট্য শিল্পীকে সম্মাননা জানানো হয়। এরই ধারবাহিকতায় ২০১৬ সালেও অনুষ্ঠানটি হবে। এর মধ্য দিয়ে ঐতিহ্যবাহী পুতুলনাট্যের যে আঙ্গিক সুতা পুতুলনাট্যের উন্নয়ন ঘটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে বলে তিনি জানান। ড. রশীদ হারুনের সঙ্গে পুতুলনাট্যের নানা বিষয় কথা হয় ‘জাগো নিউজের’।
জাগো নিউজ : পুতুলনাট্য গবেষণা কেন্দ্র কবে থেকে শুরু করলেন?
ড. রশীদ হারুন : ২০০০ সালে ঢাকার ৪০০ বছর পূর্তি উৎসবে সংসদে ভবনের চত্বরে ঐতিব্যহী পুতুলনাট্য শিল্পীদের নিয়ে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পুতুলনাট্য গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্র সৃজনের ঘোষণা করা হয়েছিল। সে সময় এত ব্যাপকভাবে এর উন্নয়নের জন্য কাজ করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু ২০১৩ সালে ইন্দোনেশিয়াতে ওয়ার্ল্ড পাপেট কার্নিভাল অংশগ্রহণ করার পর মাথায় আসে যে এটিকে একটি স্থায়ী রূপ দেয়া যায় কিনা। তারপর থেকে পুরোদমে কাজ শুরু করেছি।
জাগো নিউজ : পুতুলনাট্য শিল্পীদের কি ধরনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে?
ড. রশীদ হারুন : কর্মশালা যাদের করানো হয়েছে তাদেরকে মূলত বর্তমানে পুতুলনাট্যের যে উপকরণগুলো আছে সেগুলো দিয়ে তারা নিজেরাই যাতে নতুন পুতুল বানাতে পারে, নতুন গল্প তারা উপস্থাপন করতে পারে সে বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে লক্ষ্য করেছি যে অধিকাংশ শিল্পীর হচ্ছে একদম নিম্নবর্গের। তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা খুব দৈন্য। পুতুলনাট্য শিল্পীদের মধ্যে শিক্ষিত বা সৃজনশীল লোকের সংখ্যা নেই বললেই চলে। তাদের শিল্প চিন্তার উন্নয়নে আমরা গত ৫/৭ বছর চেষ্টা করেছি। বলা চলে এখন পর্যন্ত খুব উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি।
জাগো নিউজ : বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের জন্য পুতুলনাটক নিয়ে কী ধরনের শিক্ষা দেয়ার চেষ্টা করছেন?
ড. রশীদ হারুন : যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে তাদের এবং যারা থিয়েটার চর্চা করছে বিভিন্ন জেলা বা বিভাগীয় পর্যায়ে তাদেরকেও আমরা এই কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করছি। সেই অংশ হিসেবেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে ইতোমধ্যে এমএ ক্লাসে পুতুলনাট্যের ঐচ্ছিক একটি কোর্স চালু হয়েছে গত ৩ বছর ধরে। আমি চেষ্টা করছি যে সমস্ত ছেলে মেয়েরা- যাদের উৎসাহ আছে আগ্রহ আছে তাদের সৃজনশীলতা কাজে লাগিয়ে, মেধা কাজে লাগিয়ে এই শিল্পটির সঙ্গে সম্পৃক্ত করে এটাকে পেশাগতভাবে একটা স্থায়ী কাঠামোয় নিয়ে যাওয়া।
জাগো নিউজ : পুতুলনাটকের ক্ষেত্রে কী ধরনের গল্প আপনি বেছে নিচ্ছেন?
ড. রশীদ হারুন : কিছু কিছু খণ্ড খণ্ড গল্প আমরা বেছে নিয়েছি উপস্থাপনের জন্য। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘টুনটুনি ও রাজার গল্প’। টুনটুনির গল্প অনেক লেখকের আছে। উপেন্দ্রকিশোর রায় এর ‘নাককাটা রাজার গল্প’ জসীম উদদীন এর ‘টুনটুনির গল্প’ এর সমন্বয় করে ‘টুনটুনি ও রাজার গল্প’ আমরা বেছে নিয়েছি। এ ছাড়া মুনীর চোধুরীর একটি সুন্দর নাটক আছে ‘কুপোকাত’। যেখানে একটা হিংস্র বাঘ নির্বিশেষে নিরীহ প্রাণীদের খেয়ে ফেলে এবং কীভাবে তাকে প্রতিরোধ করা হয় সেটা নিয়ে একটা গল্প আছে পশুদের। সেই গল্পটা আমরা বেছে নিয়েছি। ইতোমধ্যে সেই আলোকে বাঘ, মহিষ, হরিণ, ভালুক, সজারু, ব্যাঙ, ঘোড়া, খরগোশ, মহিষ ইত্যাদি আমরা তৈরি করেছি। এ ছাড়া সমকালীন কিছু বিষয় আমরা উপস্থাপন করার উদ্যোগ নিয়েছি; যেমন কোরবানির গরুর সাক্ষাৎকার। যার মধ্য দিয়ে ওষুধ খাইয়ে গরু মোটাতাজাকরণের কুফলের মত বিষয়গুলো সামনে চলে আসবে। আরো আছে আমাদের বাউল শিল্পীদের গান, নানী-নাতির গল্পকথন ইত্যাদি। এসব তুলে আনার মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন আমাদের শিশু নারী বয়স্ক সবাই পুতুলনাট্য উপভোগ করবে তেমনি লোকশিক্ষার ও সচেতনতার বিষয়ে পুতুলনাট্যের অমিত শক্তি সম্পর্কে অবগত হবেন দর্শক। পুতুলনাট্যের সেই শক্তিকে আমরা প্রতিষ্ঠা দিতে চাই।
জাগো নিউজ : পুতুল নাটকের মাধ্যমে কী ধরনের তথ্য জনসাধারণের কাছে পৌঁছাতে চাইছেন?
ড. রশীদ হারুন : আমরা দেখেছি বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রসার এবং এর অমিত শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞানচর্চা, বৈশ্বিক অস্থিরতা, দুর্নীতি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা, শারীরিক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী চিকিৎসা ও শিক্ষা, পরিবেশক বিষয়ক সচেতনতা ইত্যাদি বিষয়গুলোতে পুতুলনাট্যের শক্তিকে কাজে লাগানো হচ্ছে। পুতুলনাট্যের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে শিশুশিক্ষাসহ মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করার মত জায়গাগুলোতে যাতে পুতুলনাট্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে সেই উদ্দেশ্য শিক্ষিত ও মেধাবীরা এগিয়ে আসবে। আমাদের ইচ্ছা মেধাবী ছেলেমেয়েরা এই শিল্পকে অবলম্বন করে একদিন পেশাগতভাবে নিজেদের জায়গা করে নিতে পারবে।
জাগো নিউজ : এর বাস্তবায়নে কী ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন?
ড. রশীদ হারুন : বাস্তবতা হচ্ছে যে পুতুলগুলো তৈরি করা হচ্ছে এর নির্মাণ, পোশাক তৈরি, পুতুল চালনা প্রশিক্ষণ, অভিনয় প্রস্তুতি, মঞ্চায়ন ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি করার জন্য ব্যাপক অর্থ বিনিয়োগের প্রয়োজন। আমি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে এটাকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছি। যদি এর পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থা এগিয়ে আসে তাহলে এটাকে ভালোভাবে তৈরি করতে পারব।
জাগো নিউজ : দেশের বাইরে এর অবস্থা কোন কোন দেশে অনেক ভাল?
ড. রশীদ হারুন : ইন্টারনেটে পাপেট থিয়েটার সার্চ দিলেই অনেক তথ্য ও ভিডিও দেখা যায়। এ ছাড়া প্রতিবছরই ওয়ার্ল্ড পাপেট কার্নিভাল নামে বিভিন্ন দেশে কার্নিভাল হয়ে থাকে। নানা দেশে পুতুলনাট্য বিষয়ে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত অধ্যয়ন ও গবেষণা ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। এছাড়াও আছে স্বল্পমেয়াদী বিভিন্ন কর্মশালা বা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় সিঙ্গাপুরে রাষ্ট্রী উদ্যোগে প্রতিবছর দুই শতাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পুতুলনাট্য প্রদর্শনী এবং পুতুলদের সঙ্গে শিশুদের সময় কাটানোর কর্মসূচি চালু রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। এর ফলে সেখানে স্কুলে যাওয়া এবং শিক্ষার প্রতি শিশুদের আগ্রহের মাত্রা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে তার প্রমাণ বিভিন্ন সমীক্ষায়।
জাগো নিউজ : আপনাদের পুতুলনাট্যের প্রদর্শনী কবে হবে?
ড. রশীদ হারুন : শিল্পকলা একাডেমিতে ২০১৬ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের অনুষ্ঠানে ১৩ জানুয়ারি ও ২১ শে মার্চ বিশ্ব পুতুলনাট্য দিবসে শিল্পকলা একাডেমিতে প্রদর্শনী করা হবে। তার আগে ডিসেম্বরের তৃতীয় অথবা চতুর্থ সপ্তাহে জাহাঙ্গীরনগরে প্রস্তুতি প্রদর্শনী করার ইচ্ছা আছে। এছাড়া শিল্পকলা একাডেমিতে প্রতিমাসে প্রদর্শনী করার ইচ্ছা আছে এবং পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বিভিন্ন স্কুলে প্রদর্শনী করা যেতে পারে।
জাগো নিউজ : ধন্যবাদ আপনাকে সময় দেয়ার জন্য।
ড. রশীদ হারুন : আপনাকেও ধন্যবাদ এবং জাগো নিউজের জন্য শুভকামনা।
হাফিজুর রহমান/জেডএইচ/এমএস