‘শিক্ষার আলো পাব তা কখনো ভাবিনি’
‘আমরা পড়াশোনা করতে চাই, শিক্ষিত হতে চাই। কুরআন শিক্ষার পাশাপাশি বাংলা ইংরেজি শিখতে চাই।’ সব ধরনের শিক্ষাগ্রহণের জন্য মিনতির সুরে এসব কথা বলছিলেন ‘দাওয়াতুল কুরআন তৃতীয় লিঙ্গের মাদরাসা’র একাধিক শিক্ষার্থী।
তাদেরই একজন সোনালী জাগো নিউজকে বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ! আমাদের কাছে মাদরাসায় পড়ে অনেক ভালো লাগছে। শিক্ষার আলো পাব তা কখনো ভাবিনি। কিন্তু এই মাদরাসার মাধ্যমে আমরা কুরআন শিখতে পারছি। আগে আমরা মানুষকে পথে ঘাটে কটূ কথা বলতাম, বিশ্রী ভাষায় নিজেদের কথা বলতাম। এখন আর সেগুলো করতে পারি না। আগে মানুষ আমাদেরকে দেখলে খারাপ দৃষ্টিতে দেখতো, এখন আর সেটা করে না। আমরা এখন মানুষের মাঝে যেতে পারি। আবার কাছে গেলে সালাম দেই, তারাও আমাদেরকে সালাম দেয়।’
২০২০ সালের ৬ নভেম্বর ‘দাওয়াতুল কুরআন তৃতীয় লিঙ্গের মাদরাসা’র কার্যক্রম শুরু হয়
দেশের তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর জন্য প্রতিষ্ঠিত এই মাদরাসা অবস্থিত রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে। ২০২০ সালের ৬ নভেম্বর ‘মরহুম আহমেদ ফেরদৌস বারী চৌধুরী ফাউন্ডেশন’র উদ্যোগে ও প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মুফতি মোহাম্মদ আবদুর রহমান আজাদের তত্ত্বাবধানে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীকে কুরআন শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে মাদরাসাটির কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে এই মাদরাসায় নিয়মিত ২০ থেকে ৩০ জন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ পড়াশোনা করছেন।
মাদরাসার সহকারী প্রধান শিক্ষক মাওলানা মাহমুদ আল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি দীর্ঘ ছয় মাস ধরে তৃতীয় লিঙ্গের এই জনগোষ্ঠীকে পড়াচ্ছি। তারা পড়াশোনার ব্যাপারে অনেক আন্তরিক। এখানে আসার পর তাদের আচরণের যে প্রভাব লক্ষ্য করছি, তা তাদের বাইরের মানুষের আচরণের সঙ্গে কোনো মিল নেই। ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি তাদের আবেগ খুবই লক্ষণীয়। আশা করছি, শিক্ষার ক্ষেত্রে তাদের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দেয়া হলে তারা অনেক এগিয়ে যাবে।’
প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত ‘দাওয়াতুল কুরআন তৃতীয় লিঙ্গের মাদ্রাসা’য় পড়ানো হয় বলে জানান
এই শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘তৃতীয় লিঙ্গের এই মানুষরা তাদের দলনেতার অধীনে এখানে এসে পড়াশোনা করেন। দলনেতা ছাড়া বা তার অনুমতি ব্যতীত এখানে পড়তে আসতে চান না, খুবই সুশৃঙ্খল তারা।’
গত ৮ জানুয়ারি মাদরাসার নতুন বর্ষের সবক প্রদান অনুষ্ঠান হয়
স্থানীয়রা বলছেন, তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর জন্য মাদরাসার উদ্যোগ খুবই প্রশংসনীয়। এই মাদরাসায় অবহেলিত জনগোষ্ঠীটির মানুষ পড়তে আসেন, কিন্তু তা এলাকার অনেকে জানেন না। এই মাদরাসায় আরও অনেকে পড়বেন, এটাই আশা স্থানীয়দের।
মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মুফতি মোহাম্মাদ আব্দুর রহমান আজাদ বলেন, ‘আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে এদের ধর্মীয় জ্ঞান দেয়া। সেই হিসেবে আমরা কুরআন শিক্ষার মাধ্যমে তাদের হাতেখড়ি দিচ্ছি। আমাদের শুরুর পথচলা একটু কঠিন ছিল। আমাদের দেশের তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ তাদের দলনেতার অধীনে চলেন। দলনেতাকে তারা গুরু মা বলে ডাকেন। গুরু মায়ের নির্দেশনা অনুযায়ী যে কোনো কিছু করেন। আমরা প্রথমে তাদের আমাদের শিক্ষার আওতায় আনার জন্য দলনেতার সঙ্গে কথা বলি। পরে তারা সম্মত হলে দল বেঁধে পড়তে আসেন। আমরা অনেক সময় দলনেতার সঙ্গে কথা বলে সাড়া পাই না। যেখানে যেখানে পেয়েছি তাদের আমাদের মাদরাসায় নিয়ে এসেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ অনেক সময় হুজুরদের কাছে পড়তে লজ্জা পান। আমরা চাইছি, তারা এখান থেকে হাফেজ, মুফতি হয়ে পরে নিজেরাই সারাদেশের স্বগোষ্ঠীর লোকদের ধর্মীয় শিক্ষা দেবেন। আর আগামী বছরের জানুয়ারি থেকে আমরা তাদের বাংলা ও ইংরেজি শিক্ষা দেব। ইনশাআল্লাহ!’
কুরআন শিক্ষার পাশাপাশি বাংলা-ইংরেজি বিষয়ে পড়াশোনায়ও আগ্রহী তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী
কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় এই মাদরাসার কয়েকটি শাখা রয়েছে। প্রতিদিন ঢাকার এ মাদরাসাগুলোতে প্রায় ২০০ জন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ কুরআন শিক্ষা গ্রহণ করেন। ঢাকার মধ্যে জুরাইন, মতিঝিল, কমলাপুর, গোপীবাগ, মান্ডাসহ ১৪টি এলাকায় মাদরাসাটির কার্যক্রম চলছে। এছাড়া ঢাকার বাইরে সিলেট এবং ময়মনসিংহেও এর কার্যক্রম শুরু হয়েছে। খুলনা এবং গোপালগঞ্জেও প্রতিষ্ঠানটির শাখা চালু করার চেষ্টা চলছে। এমনকি দেশের প্রতিটি জেলায় তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর জন্য মাদরাসা শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে চায় প্রতিষ্ঠানটি।
এখানে কুরআন শিক্ষা গ্রহণের জন্য আসা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে কোনো অর্থ দিতে হয় না। মাদরাসার শিক্ষকদের ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকেই সম্মানী দেয়া হয়।
জেডএইচ/এইচএ/এমকেএইচ