দিনমজুরির কাজে শিক্ষকরা
করোনায় বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছেন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা। প্রায় চারমাস বন্ধ থাকায় চাল কেনার টাকাও জুটছে না। এ কারণে দিনমজুরের কাজ শুরু করেছেন। পরিবারের সদস্যদের কথা চিন্তা করে শিক্ষকতা ছেড়ে নানা পেশায় যুক্ত হচ্ছেন, কেউ আবার সম্মানের কথা চিন্তা করে পরিবার নিয়ে অনাহারে দিন পার করছেন।
শিক্ষকরা সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেও বাধ্য হয়ে এসব করতে হচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে মাসিক ৫ হাজার টাকা দেয়ার ঘোষণা দেয়া হলেও তা এখন পাননি বলে জানান শিক্ষকরা।
সান সাইন কিন্ডারগার্টেন; শঠিবাড়ি, রংপুরের শিক্ষক নিশান মাহমুদ। করোনায় বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বন্ধ বেতনও। পরিবারের বড় ছেলে, বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা-মা থাকেন। বর্তমানে সংসারের হাল ধরতে তুলে নিয়েছেন কোদাল, করছেন দিন মজুরের কাজ।
নিশান মাহমুদ বলেন, স্কুল বন্ধ তাই আর কোনো উপায় দেখছি না, জীবনতো বাঁচাতে হবে, তাই বাধ্য হয়ে হাতে কোদাল নিয়েছি। এখন টিউশনিও নেই। খুব বিপদের মধ্যে আছি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে মাসিক আড়াই হাজার টাকা দেয়ার ঘোষণা দেয়া হলেও তা এখনও পাইনি।
কুড়িগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকা চিলমারী উপজেলার শিক্ষক শ্যামল কুমার বর্মন। ২০ বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন অধিকারীপাড়া নিম্ন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে। তিনি বলেন, ২০ বছর ধরে এমপিওভুক্তি হবে বলে আশায় বুক বেঁধে রয়েছি। টেনেটুনে ভিন্ন পেশার সঙ্গে যুক্ত হয়ে শিক্ষকরা জীবন-যাপন করছিলেন। কিন্তু করোনা আসার পরে ভিন্ন আয়ের পথটাও বন্ধ। খুব কষ্টের মাঝে দিন কাটছে আমাদের, দেখার যেন কেউ নেই।
দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলার শিক্ষক রাহেতুল ইসলাম। স্কুল বন্ধ হওয়ায় ইজিবাইক চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, স্কুলের বেতন ও টিউশনির টাকায় কোনো রকম চলতো জীবন। করোনার প্রকোপে সেটাও বন্ধ। বাধ্য হয়ে গত দুই মাস ধরে ইজি বাইক চালিয়ে সংসার চালাচ্ছি। প্রথমদিকে চালাতে পারতাম না হাত কাঁপতো। প্রশিক্ষণের জন্য যে একটা ইজিবাইক নেব সেটাও হচ্ছিল না, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চালানো শুরু করেছি, এতে করে পেটে চারটা ডাল ভাত জুটছে।
রাজধানীর শুক্রাবাদে থাকেন স্কুল শিক্ষিকা রেহানা আক্তার। তিনি বাধ্য হয়ে এখন বাড়িতে বানানো নাড়ু বিক্রি করে বেড়াচ্ছেন বিভিন্ন দোকানে। মোহাম্মদপুর গ্রিন লিফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের শিক্ষক কাওসার হোসেন। বাধ্য হয়ে বিক্রি করছেন মৌসুমী ফল। নিজের স্কুলের সামনেই পসরা সাজিয়ে বসেন এসব ফলের। করোনার প্রকোপে নাজেহাল অবস্থা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশে কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের মহাসচিব সাফায়েত হোসেন বলেন, চারমাস ধরে বাড়িভাড়া ও শিক্ষকদের বেতন পরিশোধ করতে না পারায় ব্যক্তিমালিকানাধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ৬০ হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুলের ৭০ শতাংশ শিগগিরই বন্ধ হয়ে যাবে। এ খাতকে বাঁচাতে চাই আর্থিক সহায়তা।
কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মনোয়ারা ভূঞা বলেন, অভিভাবকরা টিউশন ফি দিচ্ছেন না, তাই আমরাও শিক্ষকদের বেতন দিতে পারছি না। তিনিও আর্থিক সহায়তার কথা বলেন।
স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ মো. শাহজাহান আলম সাজু বলেন, শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থী, ১৪ লাখ শিক্ষক এবং আট লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে প্রায় ৯৭ শতাংশ শিক্ষা বেসরকারি খাতে পরিচালিত হয়। প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায়কৃত টিউশন ফি থেকে ব্যয় নির্বাহ হয়। এই আয় বন্ধ সঙ্গে টিউশনিও। ফলে মানবেতর জীবন যাপন করছেন শিক্ষকরা।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, শিক্ষকদের মানবেতন জীবন যাপনের কথা চিন্তা করে প্রধানমন্ত্রী এককালীন পাঁচ হাজার ও কর্মচারীদের দুই হাজার পাঁচশ’ করে টাকা দেয়া হবে। ইতোমধ্যে তালিকা চাওয়া প্রসঙ্গে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সৈয়দ গোলাম ফারুক চৌধুরী বলেন, প্রায় ৪৭ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। কলেজ পর্যায়ে দুই মাসের বেতন দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে সরকার।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মমিনুর রশিদ আমিন জাগো নিউজকে বলেন, আমরা জেলা প্রশাসকদের কাছে শিক্ষকের নামের তালিকা চেয়েছিলাম। তারা এটি পাঠানোর পর যাচাই বাছাই করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠাই। সেখান থেকে সরাসরি জেলা পর্যায়ে যায়। এই অর্থ প্রদানের জন্য ১ লাখ ৬০ হাজার চেক দেয়া হয়। এতে মধ্যসত্ত্বভোগীদের কোনো সুযোগ নেই। কেউ না পেয়ে থাকলে খুব শীঘ্রই সকলের হাতে পৌঁছে যাবে।
এমএইচএম/এমআরএম