করোনায় থেমে আছে ১৪ ভিসির অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্ত

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৭:১২ পিএম, ১২ জুলাই ২০২০

দেশের ১৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের (ভিসি) বিরুদ্ধে পাওয়া অনিয়মের তদন্ত থেমে আছে। নিয়োগ বাণিজ্য, অর্থ আত্মসাৎ ও অনিয়মের মাধ্যমে পদোন্নতি-পদায়নসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে এসব ভিসির বিরুদ্ধে। গত ছয় মাস আগে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ খতিয়ে দেখার কাজ শুরু করলেও করোনা পরিস্থিতিতে তদন্তের কাজ ফাইলবন্দি।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ১৪ ভিসির বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ থাকলেও করোনা পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে তদন্তকাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। কয়েকজন ভিসির অভিযোগ সরেজমিনে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে আনা হলেও প্রতিবেদন তৈরি না করে তা ফাইলবন্দি করে রাখা হয়েছে। এতে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি করে পার পেয়ে যাচ্ছেন।

ইউজিসি সূত্র জানায়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে বড় বিতর্ক সৃষ্টি হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামকে নিয়ে। উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ নিয়ে ছাত্রলীগ নেতাদের আর্থিক সুবিধা দেয়ার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। ফারজানা ইসলামের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনে নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একাংশ। উপাচার্যের উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ ছাত্রলীগকে দেয়া নিয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতা পদও হারান। এমন ১৪ ভিসির অনিয়মের তদন্তকাজ বন্ধ হয়ে গেছে। তাদের মধ্যে দুজন উপাচার্য ইতোমধ্যে অবসরে গেছেন। তাদের বিরুদ্ধেও নানা ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, সেগুলোর তদন্ত চলছে।

জানতে চাইলে ইউজিসি সদস্য ড. মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, দুর্নীতি-অনিয়ম, ইউজিসির নিয়ম না মানা, শিক্ষার্থীদের চাপ সৃষ্টিসহ বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত কার্যক্রম চলমান। বর্তমান পরিস্থিতিতে তদন্ত কার্যক্রম ধীরগতিতে চলছে। এছাড়া ইউজিসির যে জনবল রয়েছে সেটি দিয়ে তদন্ত কার্যক্রম দ্রুত এগিয়ে নেয়া কষ্টসাধ্য। এজন্য প্রয়োজন বাইরের কোনো সংস্থা ইউজিসির সাথে যুক্ত করা অথবা বাইরের কোনো সংস্থা দিয়ে এসব তদন্তকাজ শেষ করালে দ্রুত প্রতিবেদন পাওয়া সম্ভব হবে।

জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান দায়িত্ব গ্রহণের পর কোটা সংস্কার আন্দোলন ও ডাকসু নির্বাচনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে দ্বিচারিতা ও উসকানিমূলক মন্তব্য করে বিতর্ক সৃষ্টি করেন। সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রত্ব না থাকা ছাত্রলীগ নেতাদের অনিয়মের মাধ্যমে ভর্তির অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীদের একাংশ।

এছাড়া অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি, অনৈতিক কর্মকাণ্ড, ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বজনপ্রীতি, প্রকল্পের কাজে অর্থ লেনদেন, অবৈধ ভর্তি ও অশোভন আচরণসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে।

গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) বিতর্কিত উপাচার্য অধ্যাপক ড. খোন্দকার নাসির উদ্দিনের পদত্যাগ দাবিতে ক্যাম্পাস উত্তাল হয়ে ওঠে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেয়া স্ট্যাটাস ও ব্যক্তিগত আলাপ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফাতেমা তুজ জিনিয়াকে বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। উপাচার্যের বিরুদ্ধে শিক্ষক ও কর্মকর্তা নিয়োগে বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে।

টাঙ্গাইলে অবস্থিত মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (মাভাবিপ্রবি) উপাচার্য মো. আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, ভর্তি পরীক্ষা পরিচালনার জন্য তিনবার সম্মানী নিয়েছেন তিনি। কেবল অতিরিক্ত সম্মানী নেয়া নয়, শিক্ষকদের পদোন্নতি, কর্মকর্তা নিয়োগসহ বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় নিয়মকানুনের চেয়ে ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছাই প্রধান করে দেখেন এই উপাচার্য।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে নিয়োগ বাণিজ্য, জমি ক্রয়ে অর্থ আত্মসাৎসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (প্রাবিপ্রবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম রোস্তম আলী নিয়মনীতি ভঙ্গ করে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে তার আপন ভাগনেসহ ২২ জন নিকটাত্মীয়কে চাকরি দিয়েছেন। এছাড়া আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) উপাচার্য অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ ক্যাম্পাসে অবস্থান না করাসহ ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতি, ইউজিসির নির্দেশনা অমান্য করে জনবল নিয়োগ, শিক্ষক ও জনবল নিয়োগে দুর্নীতি ও অনিয়ম, সভাপতি হয়েও নিয়োগ বোর্ডে অনুপস্থিত থাকা, অবৈধভাবে গাড়ি বিলাসিতা, নিয়োগ-বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ রয়েছে।

এদিকে শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে বিতর্কের সৃষ্টি করেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এস এম ইমামুল হক। ঘটনার প্রতিবাদে উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয় ক্যাম্পাস। পরে শিক্ষার্থীদের লাগাতার আন্দোলনের মুখে উপাচার্যকে ছুটিতে পাঠানো হয়। ছুটিতে থাকা অবস্থায় তার মেয়াদ শেষ হয়। এছাড়া তার বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।

এছাড়া শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্য, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আবুল কাশেমের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ, একই অভিযোগ নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) উপাচার্য অহিদুজ্জামানের বিরুদ্ধে। ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হিসেবে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আহসান উল্লাহর বিরুদ্ধে সব অনিয়ম, দুনীতিসহ নৈতিক স্খলনের অভিযোগ খতিয়ে দেখছে ইউজিসি।

তদন্ত কমিটির সমন্বয়ক ইউজিসির সদস্য দিল আফরোজা বেগম বলেন, ভিসিদের অভিযোগের তদন্ত চলছে। এ নিয়ে এখনই কোনো মন্তব্য করতে পারব না। করোনা পরিস্থিতির কারণে তদন্ত কাজে ধীরগতি সৃষ্টি হয়েছে, তবে তদন্ত চলমান। এখনো কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি। এটা খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। তদন্ত শেষে অবশ্যই গণমাধ্যমকে জানানো হবে বলে জানান তিনি।

ভিসিদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগের বিষয়ে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক কাজী শহীদুল্লাহ বলেন, করোনা পরিস্থিতি ও ইউজিসিতে সদস্যপদ শূন্য থাকায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের গতি কমে গেছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ তদন্তকাজ শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না।

অপরাধীকে ছাড় দেয়া হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে সরেজমিনে গিয়ে তদন্ত কমিটির সদস্যরা তথ্য সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে বলে তদন্তকাজ এগুচ্ছে না। তদন্ত শেষ না হলে সে প্রতিবেদন তৈরি করে আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে পারছি না। চলতি সপ্তাহে নতুন সদস্য নিয়োগ হওয়ার কথা। সদস্য নিয়োগ হলে বিশেষভাবে একজনকে দায়িত্ব দিয়ে তদন্তকাজ দ্রুত শেষ করা হবে বলে জানান ইউজিসি চেয়ারম্যান।

এমএইচএম/এমএসএইচ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।