এসএসসি পরীক্ষার খাতা পুনর্মূল্যায়নে ১১ বোর্ডের আয় ৬ কোটি টাকা
সম্প্রতি প্রকাশিত এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না পেয়ে খাতা পুনর্মূল্যায়নের আবেদন করেছেন ২ লাখ ৩৮ হাজার ৪৭১ জন পরীক্ষার্থী। তারা সর্বমোট ৪ লাখ ৮১ হাজার ২২২টি খাতা চ্যালেঞ্জ করেছেন। আর ১১টি শিক্ষা বোর্ডের এখাতে আয় হয়েছে ৬ কোটি ১ লাখ ৫২ হাজার ৭৫০ টাকা। আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটি থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
আন্তশিক্ষা বোর্ডের সংশ্লিষ্টরা জানান, এসএসসির ফল প্রকাশের পরের দিন থেকে গত ৭ জুন পর্যন্ত ফলাফল পুনর্মূল্যায়নের আবেদনের সুযোগ দেয়া হয়। পুনর্মূল্যায়ন আবেদনে প্রতিটি বিষয়ের জন্য বোর্ডগুলো ১২৫ টাকা করে নিয়েছে। শিক্ষার্থীদের এই ফল চ্যালেঞ্জের আবেদনে নতুন করে উত্তরপত্র মূল্যায়নের সুযোগ নেই। শুধুমাত্র পুনঃনিরীক্ষা করা হয়। উত্তরপত্র মূল্যায়নে শিক্ষকদের অবহেলার কারণে এ প্রক্রিয়ায়ও প্রতিবছর অসংখ্য শিক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়। এর জন্য উত্তরপত্র (খাতা) মূল্যায়নের দায়িত্বে থাকা পরীক্ষকরা দায়ী হলেও পরীক্ষার্থীদের টাকা গুনতে হয়।
দেখা গেছে, আবেদনের জন্য প্রতিটি বিষয় ও প্রতি পত্রের জন্য ১২৫ টাকা হারে ফি নেয়া হয়েছে। যেসব বিষয়ের দু’টি পত্র (প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র) রয়েছে সেসব বিষয়ের ফল পুনঃনিরীক্ষার আবেদন করলে মোট ২৫০ টাকা ফি দিতে হয়েছে। এবার খাতা পুনর্মূল্যায়নে মোট ২ লাখ ৩৮ হাজার ৪৭১ জন পরীক্ষার্থী ৪ লাখ ৮১ হাজার ২২২টি বিষয়ের খাতা চ্যালেঞ্জ করেছেন। সে হিসেবে ১১টি শিক্ষ বোর্ডের আয় হয়েছে ৬ কোটি ১ লাখ ৫২ হাজার ৭৫০ টাকা।
এ ব্যাপারে আন্তশিক্ষা বোর্ডে সমন্বয় সাব কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক বলেন, বরাবরের মতো অনেক পরীক্ষার্থী নিজেদের ফলে সন্তুষ্ট না হয়ে পুনঃনিরীক্ষার আবেদন করেছেন। ২০ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ২ শতাংশ আবেদন করেছে এটা অস্বাভাবিক না। নিময় অনুযায়ী এসব খাতা নতুনভাবে নিরীক্ষা করা হবে।
তিনি আরও বলেন, আবেদনকারীর মধ্যে যারা এক বা দুই কম পাওয়ায় জিপিএ-৫ পাননি অথবা কৌতুহলী হয়েও কেউ কেউ আবেদন করেছেন। তবে এবার তুলনামূলক গণিত বিষয়ের আবেদন বেশি। দায়িত্বে অবহেলা চিহ্নিত হলে পরীক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে বলে জানিয়েছেন তিনি।
বিভিন্ন বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকরা জানিয়েছেন, পুনঃনিরীক্ষণে সাধারণত চারটি বিষয় দেখা হয়। এগুলো হলো- উত্তরপত্রে সব প্রশ্নের সঠিকভাবে নম্বর দেয়া হয়েছে কিনা, প্রাপ্ত নম্বর গণনা ঠিক হয়েছে কিনা, প্রাপ্ত নম্বর ওএমআর শিটে ওঠানো হয়েছে কিনা এবং প্রাপ্ত নম্বর অনুযায়ী ওএমআর শিটে বৃত্ত ভরাট সঠিকভাবে করা হয়েছে কিনা। এসব বিষয় পরীক্ষা করেই পুনঃনিরীক্ষার ফল দেয়া হয়। অর্থাৎ শিক্ষার্থীর উত্তরপত্র পুনরায় মূল্যায়ণের সুযোগ নেই।
এরপরও বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর ফল পরিবর্তনের আবেদন রীতিমতো তুঘলকি কাণ্ড আখ্যায়িত করে শিক্ষাবিদরা বলেন, বোর্ডের প্রশ্ন পদ্ধতি ও খাতা দেখার নানা ত্রুটির কারণে দিন দিন ফল চ্যালেঞ্জ করার সংখ্যা বাড়ছে। তবে বোর্ডের কর্মকর্তারদের দাবি, উচ্চ আদালতের নির্দেশে শিক্ষার্থীদের বিষয় ভিত্তিক নম্বর জানিয়ে দেয়া হয়। যে কারণে আবেদনের সংখ্যা বাড়ছে। তারা মনে করে আবেদন করলেই ফল পরিবর্তন হবে। কারণ একজন শিক্ষার্থী যখন দেখছে সে ৭৯ কিংবা ৬৯ বা ৩২ নম্বর পেয়েছে। অর্থাৎ এক নম্বরের জন্য সে ফেল করেছে কিংবা পরবর্তী গ্রেড থেকে বাদ পড়েছে তখন সে খাতা চ্যালেঞ্জ করে আবেদন করে।
শিক্ষাবিদরা বলেন, উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় প্রতিবছর ফেল করা পরীক্ষার্থীও পাস করছে, এ-প্লাস পাচ্ছে। পুনর্মূল্যায়নে অসংখ্য শিক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হচ্ছে। ফলে পাবলিক পরীক্ষায় উত্তরপত্র যথাযথভাবে মূল্যায়িত হচ্ছে না। এসব ভুল হওয়ার অন্যতম কারণ স্বল্প সময় বেঁধে দেয়া এবং যথাযথ প্রক্ষিক্ষণ ছাড়াই একজন পরীক্ষককে দিয়ে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করানো। এতে গতানুগতিক মূল্যায়নের ফলে কিছু প্রকৃত মেধাবী প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়ছে।
বোর্ড সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব ভুল হওয়ার বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। যেমন- অতিমূল্যায়ন বা অবমূল্যায়ন অর্থাৎ নম্বর কম কিংবা বেশি নম্বর দেয়া, কোনো এক বা একাধিক প্রশ্নের উত্তর মূল্যায়ন থেকে বাদ পড়া, যোগফল ভুল হওয়া, কিছু উত্তরের নম্বর যোগফল থেকে বাদ পড়া, যোগফল ওএমআর শিটে তুলতে ভুল হওয়া এবং ওএমআর শিটে বৃত্ত ভরাট করতে ভুল হওয়া। এগুলোই মূলত সাদা চোখে বড় বড় ভুল। এর বাইরেও কিছু ছোট ছোট ভুল হতে পারে। তবে খাতা পুনর্মূল্যায়নে চারটি দিকের বাইরে কিছু দেখা হয় না।
আন্তশিক্ষা বোর্ডের তথ্যমতে, এ বছর ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে ৫৯ হাজার ৭৯০ জন পরীক্ষার্থী ১ লাখ ৪৬ হাজার ২৬০টি বিষয়ে খাতা পুনর্মূল্যায়নের আবেদন করেছেন। আবেদনের র্শীষে গণিত রয়েছে বলে বোর্ডের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। চট্টগ্রাম বোর্ডে ২০ হাজার ৫৫০ জন শিক্ষার্থী বিভিন্ন বিষয়ে মোট ৫২ হাজার ২৪৬টি আবেদন করেছেন। এর মধ্যে ইংরেজিতে ৬ হাজার ৭৩৯টি, গণিতে ৪ হাজার ৭২৮টি, বাংলায় ৩ হাজার ২২৮টি, বাংলাদেশে ও বিশ্বপরিচিতি বিষয়ে ৩ হাজার ৮৪টি, পদার্থে ২ হাজার ৭৬৫টি, জীব বিজ্ঞানে ৩ হাজার ৫১৬টি, ইসলাম ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা বিষয়ে ২ হাজার ৪০টি।
রাজশাহী বোর্ডে ২০ হাজার ৪১৩ জন শিক্ষার্থী মোট ৪৪ হাজার ৬১টি বিষয়ে খাতা পুনর্মূল্যায়নের আবেদন করেছেন। এর মধ্যে গণিতে ৮ হাজার ৩৭৫টি, ইংরেজিতে ৩ হাজার ৯৮০টি, পদার্থে ৩ হাজার ৫০২, জীব বিজ্ঞানে ৩ হাজার ৪৫৩টি, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচিতি বিষয়ে ২ হাজার ৩৯টি।
বরিশাল বোর্ডে ১০ হাজার ৫০ জন শিক্ষার্থী বিভিন্ন বিষয়ে মোট ২৩ হাজার ৮৫০টি খাতা পুনঃনিরীক্ষার আবেদন করেছেন। এর মধ্যে গণিতে ৪ হাজার ১৫৪টি, ইংরেজিতে ২ হাজার ৪৭১টি, রসায়নে ২ হাজার ৩৯৫টি, পদার্থে ১ হাজার ১৭০টি ও বাংলায় ১ হাজার ৫২৬টি আবেদন করেছেন শিক্ষার্থীরা।
সিলেট বোর্ডে ১১ হাজার ৮৭৪ জন শিক্ষার্থী মোট ২৩ হাজার ৭৯০টি বিষয়ে খাতা পুনর্মূল্যায়নের আবেদন করেছেন। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে গণিত বিষয়। এ বিষয়ে আবদেন পড়েছে ৪ হাজার ৯৫৪টি। ইসলাম ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা বিষয়ে ২ হাজার ৩০৫টি, ইংরেজিতে ২ হাজার ৫৮০টি, জীব বিজ্ঞানে ১ হাজার ৯৪০টি।
কুমিল্লা বোর্ডে ১৭ হাজার ৬৭৭ জন শিক্ষার্থী মোট ৩৯ হাজার ৩০৩টি খাতা পুনঃনিরীক্ষার আবেদন করেছেন। এর মধ্যে গণিতে ৮ হাজার ৬৩৮টি, বাংলায় ২ হাজার ৫০৫টি, ইংরেজিতে ২ হাজার ৮৯০টি, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচিতি বিষয়ে ৩ হাজার ৮৮৪টি, ইসলাম ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা বিষয়ে ৩ হাজার ৩৯৭টি।
দিনাজপুর বোর্ডে ১৭ হাজার ৮৮৭ জন শিক্ষার্থী ৪০ হাজার ৭৫টি বিষয়ের খাতা পুনঃনিরীক্ষার আবেদন করেছেন। এর মধ্যে গণিতে ৫ হাজার ১২টি, পদার্থে ৩ হাজার ৬৫৭টি, ইংরেজিতে ৩ হাজার ৩২টি।
ময়মনসিংহ বোর্ডে ৩১ হাজার ৩৩১টি আবেদন খাতা পুনর্মূল্যায়নের আবেদন পড়েছে। আর মাদ্রাসা বোর্ডে ১৪ হাজার ৭০৭ জন শিক্ষার্থী ২৩ হাজার ৪৫০টি খাতা পুনর্মূল্যায়নের আবেদন করেছেন। এর মধ্যে গণিতে ৭ হাজার ৯৩৯টি, কোরআন মজিদে ২ হাজার আবেদন পড়েছে। কারিগরি বোর্ডে ১৭ হাজার ৫৩৭টি আবেদন করেছেন শিক্ষার্থীরা।
এমএইচএম/এমএফ/পিআর