বিএনপির প্রয়োজন দূরদর্শী সিদ্ধান্ত
সরকারের দমনপীড়নের মুখে বিএনপি চুপসে গেল। বারবার চেষ্টা করেও ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। অনেকবারই তোড়জোর করে ঘুরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিল দল, কিন্তু মামলা-মোকদ্দমা আর গ্রেপ্তার-শাস্তির চাপে হাল ছেড়ে দিতে দেখা যাচ্ছে।
আমরা নিশ্চয় বিরোধী দলের ওপর সরকারের এই বলপ্রয়োগের নীতিকে সমর্থন করি না। গণতন্ত্রে বিরোধী মত এবং বহুমত থাকবেই। ফলে সরকারের এই অসহিষ্ণুতা নিন্দনীয়। এই নিন্দা প্রকাশের সাথে সাথে একটু বিস্ময়ও বোধ না করে পারি না যে বিএনপি কেন কোনো আন্দোলন তৈরি করতে পারল না। বিএনপি নেতৃত্ব এ নিয়ে নিশ্চয় ভাবেন, তবে তাঁদের ভাবনা যেন মূলত সরকারের ভূমিকা ও বক্তব্যেই সীমাবদ্ধ। অর্থাৎ সরকারি বেপরোয়া পীড়নের মুখে মাঠে নামতে পারছে না কর্মীরা এই অভিযোগই তারা জানাচ্ছে, জনসম্পৃক্ত কোনো ইস্যুতেই তারা মাঠে নামছে না।
অতীতে বাংলাদেশ এরকম পরিস্থিতি দেখেছে। ছয় দফার আন্দোলনের সময় আইয়ুব-মোনেম আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের প্রায় সকল প্রধান নেতাকেই জেলে ঢুকিয়েছিল, মামলা-মোকদ্দমায় ফাঁসিয়ে রেখেছিল। তখন দলের মহিলা নেত্রীরা, তরুণ নেতা, ছাত্র সংগঠন ও অন্যান্য অঙ্গ সংগঠন নানা কৌশলী কর্মসূচি দিয়ে তাদের রাজনীতিকে চাঙ্গা রেখেছিল। বিএনপির এসবই আছে, কিন্তু তারা নিষ্ক্রিয়, কেবল ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে তাদের চেহারা ও কণ্ঠস্বরটুকু পাওয়া যাচ্ছে। রাজনীতিতে এটুকুতে কাজ হবে না। হচ্ছেও না।
এর মূল কারণটা বলা দরকার।
বাংলাদেশের ইতিহাসে দুটি পর্ব কেবল গৌরবময় তা নয়, দেশের স্বাধীনতার পেছনে মূল ভূমিকা এ দুটিরই- একটি ভাষা আন্দোলন ও ভাষা-ভিত্তিক জাতীয়তার পক্ষে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন আর অন্যটি হানাদার-দখলদার পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালির সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। এই দুটি সংগ্রামেই আওয়ামী লীগ কেবল ওতপ্রোতভাবে যুক্ত থাকে নি, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে। এ হল বাস্তবতা। বিএনপি স্বাধীনতা-পরবর্তী দল, ফলে স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী আন্দোলনে তার যুক্ত থাকার সুযোগ ছিল না। কিন্তু আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে রাজনীতি দাঁড় করাতে গিয়ে তারা দেশের ইতিহাসের গৌরবময় দুই পর্ব সম্পর্কে নিজেদের অবস্থানকে দুর্বল তো রেখেছেই, ক্ষেত্রবিশেষে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। একুশে ফেব্রুয়ারি বা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার সাথে সম্পৃক্ত বাংলা নববর্ষ, রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী, লালন উৎসব ইত্যাদিতে এ দলের ভূমিকা নেই বললেই চলে। অথচ স্বাধীনতার পূর্ব বা পরবর্তী যে কোনো সামরিক-স্বৈরাচারের আমলে যখন প্রত্যক্ষ রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা চলে বা রাজনীতিকদের পক্ষে কাজ করা মুশকিল হয় তখন এসব উপলক্ষকে ঘিরে ছাত্র সংগঠন ও বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানই মাঠে সক্রিয় থেকেছে ও রাজনৈতিক ইস্যুগুলোকে জিইয়ে রেখেছে। আর এসব উদ্যোগের রাজনৈতিক সুফল একচেটিয়াভাবে পেয়েছে আওয়ামী লীগ।
বিএনপির ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে একদিকে বাংলাভাষা, বাংলা সাহিত্য, রবীন্দ্র-নজরুল-বাউলের গানসহ বাঙালি সংস্কৃতি এবং অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত আদর্শ ও চেতনা এবং বঙ্গবন্ধুসহ এর নেতৃত্ব সম্পর্কে কী ভাবনা তা স্পষ্ট নয়। স্পষ্ট হল একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামির সাথে গাঁটছড়া, এবং তারই সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি পক্ষপাত, এমনকি দেশের ধর্মান্ধ রাজনৈতিক শক্তিগুলোর প্রতি সহানুভূতি।
একটা বিষয় স্পষ্ট, এদেশের সিংহভাগ মানুষ ধর্মে মুসলমান এবং যথেষ্ট ধর্মভীরু বটে কিন্তু ভাষা, সাহিত্য ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অতীতের বিভ্রান্তি তারা কাটিয়ে উঠেছে। আর যে দেশের সিংহভাগ মানুষ তরুণ তাদের মনোভাবটাও বোঝা দরকার। তাদের কেউ কেউ জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকছে বটে কিন্তু তা-ও ঘটছে সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমা বিশ্বের ইরাক-লিবিয়া-আফগানিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্য নীতির কারণে। অধিকাংশ তরুণ তার মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি এবং মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের অংশীদার হতেই ভালোবাসে। বাংলাদেশ এ দুটি অধ্যায় ও অর্জনকে কী করে অস্বীকার করবে?
তদুপরি নাগরিকসমাজের সচেতন ও সৃজনশীল অংশ আপোসহীন আবেগের সাথে এ দুটি বিষয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ। বিএনপি নেতৃত্ব এ বিষয়টি হয় অনুধাবন করছে না অথবা বাংলাদেশের রাজনীতিতে এর গুরুত্ব স্বীকার করছে না।
এর ফলে সাধারণভাবেই ছাত্র ও সচেতন নাগরিকদের কাছে বিএনপির আবেদন কমে গেছে। বরং জামায়াত, যুদ্ধাপরাধী ইস্যুতে বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়েছে। আর একুশের বইমেলা, বাংলা নববর্ষ, রবীন্দ্রজয়ন্তী, নজরুলজয়ন্তী, লালনমেলা, বাউল উৎসব ইত্যাদি বাঙালির প্রাণের উৎসবে কোথাও বিএনপি নেতা বা বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবীদের সক্রিয়তা বা অংশগ্রহণ দেখা যায় না। এভাবে সমাজের সচেতন সক্রিয় সৃজনশীল অংশের কাছে বিএনপি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে।
এভাবে সমাজের মূলধারার বিপরীতে বা বাইরে থাকতে গিয়ে, অনেকের সন্দিগ্ধ মনে প্রশ্ন জাগছে, দলটি কি নানা ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে পড়ছে না?
সরকারের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র চলছে সত্য। সাধারণত সরাসরি মাঠের রাজনীতি সম্ভব না হলে যেসব বিকল্পের সন্ধান করে বিরোধী শক্তিগুলো তার একটি ষড়যন্ত্র। অতীতে আওয়ামী লীগ বিকল্প হিসেবে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও ছাত্র আন্দোলনের সহায়তা নিয়েছিল ও পেয়েছিল। ফলে তারা পাক সরকারের ষড়যন্ত্রের শিকার হলেও নিজেরা ষড়যন্ত্রে জড়ায় নি। এতে আখেরে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মাথা উঁচু করে বিজয়ী বেশে বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে দলটির পক্ষে। বিএনপি এ ধরনের প্রকাশ্য প্রত্যক্ষ রাজনীতি বা রাজনৈতিক কার্যক্রম দাঁড় করাতে পারছে না। মাঝে মাঝে তাদের কোনো কোনো নেতা বা জোটভুক্ত সংগঠনের নেতা-কর্মী কিংবা সমর্থক নাগরিকদের গোপন তৎপরতার সন্ধান মিলছে। এতে রাজনৈতিক আন্দোলন দাঁড় করানো আরও কঠিন হয়ে পড়বে বিএনপির জন্যে।
আমার মনে হয় মাঠের অবস্থা ও বাস্তবতা পর্যালোচনা করে বিএনপিকে তার নীতি-আদর্শ ও কার্যক্রম ঠিক করতে হবে। আজকের দিনে রাজনীতিতে ধর্ম ও ভারতবিরোধিতার ধুয়া তুলে ব্যাপক কোনো আন্দোলন বা সুবিধা আদায় করা যাবে না। নাগরিকসমাজ ও বামপন্থীরা পরিবেশ রক্ষার যে ধারাবাহিক আন্দোলন করছে তাতে বিএনপি নেই। সাম্প্রতিক ইস্যুভিত্তিক যেসব আন্দোলন যেমন নতুন পে স্কেল নিয়ে শিক্ষকদের আন্দোলন, তাতেও এ দলটি নেই, নেই তাদের কোনো বক্তব্য। যেখানে নাগরিকসমাজ অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে ভাষা-সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে একটি প্রগতিশীল অবস্থানেই রয়েছে সেখানে তাদের পক্ষে বিএনপিকে সহজাত বন্ধু ভাবা সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগের জন্যে এ অনেকটা সরকারকে নিজের ঘরের মানুষদের সামলানোর ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এ বাস্তবতায় বিএনপি দর্শকে পরিণত হচ্ছে।
আবার বিএনপির প্রতি সরকারি আচরণকে সমর্থন করতে না পারলেও বিএনপির অবস্থানের কারণে সচেতন জনগণ ও ছাত্রতরুণরা অধিকাংশই এসব ইস্যুতে দর্শকের ভূমিকাই পালন করে যাচ্ছে।
দর্শকের ভূমিকা থেকে খেলোয়াড়ের ভূমিকায় তারা কি এক হবে? সেটা নির্ভর করবে বিএনপির নেতৃত্বের দূরদর্শী সিদ্ধান্তের ওপর। সেটা কি অদূরভবিষ্যতে তারা নিতে পারবে?
লেখক : কবি, সাংবাদিক, চিন্তাবিদ
এইচআর/পিআর