ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পরিণত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:২২ পিএম, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। প্রতিবছর শিক্ষার্থী বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে আয় ও দুর্নীতি। নেই আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতা ও হিসাব-নিকাশ। আইনের তোয়াক্কা না করে নানা কৌশলে বিপুল অর্থ লুটছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের (বিওটি) সদস্যরা। আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রাষ্ট্রপতির নির্দেশে শিক্ষা মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিয়েও এসব ব্যবসা ঠেকাতে পারেনি।

দেখা গেছে, গত ডিসেম্বরের মধ্যে আয়-ব্যয়ের হিসাব নিরীক্ষা (অডিট) প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে চিঠি দিলে অর্ধেকের বেশি বিশ্ববিদ্যালয় পাত্তাই দেয়নি। যারা জমা দিয়েছেন তাও সঠিক নয় বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের যুগ্ম সচিব (অডিট) আহমদ শামীম আল রাজী বলেন, ‘নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় অডিট রিপোর্ট জমা দেয়নি। এটা খুবই দুঃখজনক। যারা জমা দিয়েছে তারাও যথাযথভাবে দেয়নি।’ অডিট আরও স্বচ্ছ করতে অডিট ফার্ম ও বিশ্ববিদ্যালগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা হবে বলে জানান তিনি।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা আইন ২০১০ এর ৪৫ ধারায় বলা আছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত অডিট ফার্ম দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক অডিট করাতে হবে। কিন্তু অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় আইনকে তোয়াক্কাই করছেন না। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরে কোনো অডিট রিপোর্ট মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে (ইউজিসি) জমা দেয়নি।

সূত্র জানায়, বর্তমানে ১০৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন রয়েছে। এর মধ্যে ৯০টি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। গত বছরের অডিট রিপোর্ট দেয়া শেষ সময় ছিল ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী মাত্র ৪১টি বিশ্ববিদ্যালয় অডিট রিপোর্ট মন্ত্রণালয়ের জমা দিয়েছে। বাকি ইউনিভার্সিটিগুলো কোনো সময়ও চায়নি। যারা অডিট রিপোর্ট দেয়নি তাদের সর্তক করে চিঠি দিয়ে জবাব চাওয়া হবে। এরপর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ অনুযায়ী এবার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নতুন মন্ত্রীকে অবহিত করা হবে।

মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির কর্মকর্তারা জানান, বিওটির সদস্যরা অনিয়ম ও দুর্নীতি আড়াল করতে অডিট রিপোর্ট জমা দেন না। আইনের তোয়াক্কা না করে বিওটি সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ তহবিলের অর্থ আত্মসাৎ করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে ভুয়া কাগজপত্র ও স্বাক্ষর জাল করে সংরক্ষিত তহবিলের (ফান্ড) বিপরীতে ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন।

প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আট ক্যাটাগরিতে মোট ১২ জন সিন্ডিকেট সদস্য রয়েছেন। মিটিংয়ে উপস্থিত থাকার জন্য একজন সিন্ডিকেট সদস্য মিটিং প্রতি সাড়ে চার লাখ টাকা পর্যন্ত সম্মানী নিচ্ছেন। প্রমোদ ভ্রমণের জন্য অনেক সময় বিদেশেও সিন্ডিকেট মিটিংয়ের আয়োজন করেন। বিভিন্ন বৈঠকের আয়োজন করে বিওটি সদস্যরা প্রতি বছর সম্মানীর নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।

কেনাকাটায়ও চলছে অনিয়ম, দুর্নীতি। নানা কৌশলে কোটি কোটি টাকা লুটপাট চলছে। ইউজিসির তদন্ত রিপোর্টেও এসব তথ্য উঠে এসেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে গত বছর জমা দেয়া প্রতিবেদনে এসব অভিযোগ তুলে ধরেছে ইউজিসি।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শৃঙ্খলা আনতে গত বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্যদের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বৈঠক করেন। বৈঠকের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে তিনি (রাষ্ট্রপতি) ১৬ দফা নির্দেশনাও দেন। এর মধ্যে আর্থিক স্বচ্ছতা ছিল অন্যতম। আচার্যের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের উপ-সচিব (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়) জিন্নাত রেহেনা স্বাক্ষরিত একটি নির্দেশনা জারি করা হয়। তাতে ১৪টি ক্যাটাগরিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিট করতে বলা হয়েছিল।

গত আগস্টে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের উপ-সচিব মো. রাহেদ হোসেন স্বাক্ষরিত নির্দেশনা সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের কাছে পাঠানো হয়। তাতে বলা হয়েছিল, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ অনুযায়ী সরকার কর্তৃক মনোনীত অডিট ফার্ম দিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিরীক্ষা করে প্রতিবেদন ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসিতে জমা দিতে হবে। আইন অনুযায়ী প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবে। কিন্তু অর্ধেকের বেশি বিশ্ববিদ্যালয় মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মানেনি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দেয়া তথ্যানুযায়ী, ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাত্র ৪১টি বিশ্ববিদ্যালয় অডিট রিপোর্ট জমা দিয়েছে। সেগুলো হলো-বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি, আশা ইউনিভার্সিটি, স্টামফোর্ড, এক্সিম ব্যাংক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, ব্র্যাক, মানারাত, পুন্ডু ইউনিভার্সিটি, মেট্রোপলিটন, সোনারগাঁও, ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়া, ইন্ডিপেন্ডেট ইউভার্সিটি, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং, এশিয়া প্যাসেফিক, ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি।

এ ছাড়া কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, প্রাইম এশিয়া, বিজিবি ট্রাস্ট, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, প্রাইম ইউনিভার্সিটি, উত্তরা ইউনিভার্সিটি, গণ বিশ্ববিদ্যালয়, দ্য পিপলস ইউনিভার্সিটি, লিডিং ইউনিভার্সিটি, পোর্টসিটি ইউনিভার্সিটি, হামর্দদ, ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি, আহসানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি, ফেনী ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ, দ্য মিলেনিয়ান ইউনিভার্সিটি, নর্থ ওয়েস্টার্ন, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি, ইউনিভার্সিটি গ্লোবাল ভিলেজ বরিশাল এবং নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় সম্পূর্ণ অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিওটি সদস্য বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো আর্থিক সুবিধা নিতে পারবেন না। আইনের ৪৫ (২) ধারায় বলা হয়েছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত অডিট ফার্ম দিয়ে প্রতি অর্থবছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব নিরীক্ষা করাতে হবে।

প্রতিবেদন পরবর্তী আর্থিক বছরের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ইউজিসি এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে হবে। এ ধারার নির্দেশনা লংঘন করলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা এবং প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ বাতিলের নির্দেশনা আছে। একই আইনের ৪৯ নম্বর ধারা অনুযায়ী পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান আছে।

আইনের ১৪, ২৫ ও ২৬ ধারা অনুযায়ী অর্থ কমিটি গঠন ও পরিচালনা করতে হবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অর্থ কমিটির কোনো সভা করে না। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ করেনি। আবার যেখানে কোষাধ্যক্ষ আছে, সেখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মালিকপক্ষের পছন্দের লোক নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

ইউজিসির সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, চট্টগ্রামের ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (ইউএসটিসি) ২৩ বছর ধরে অডিট রিপোর্ট ইউজিসিতে জমা দেয়নি। হিসাব নিরীক্ষা করানো হয় কিনা-সে তথ্যও ইজিসিতে নেই। প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক নুরুল ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন ইউএসটিসি। পাঁচ বছর আগে তিনি মারা যান।

নুরুল ইসলামের মেয়ে ডা. নীনা ইসলাম সম্প্রতি অভিযোগ করেন, বিওটি চেয়ারম্যানসহ কয়েকজন সদস্য প্রতিষ্ঠানের কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। প্রতিবাদ করায় তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে বের করে দেয়ার হুমকি দিয়েছেন বিওটির চেয়ারম্যান। এ নিয়ে থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন ডা. নীনা। শুধু এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম চলছে না। শুধু জমি কেনার নামে সাড়ে ছয় শত কোটি আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে নর্থ সাউথের বিওটি সদস্যদের বিরুদ্ধে।

এমএইচএম/এমআরএম/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।