শেরপুরে নারীকে বিবস্ত্র : আদালতে বখাটেদের সনাক্ত করলেন নির্যাতিতা
শেরপুরের মধুটিলা ইকোপার্কে নববধুর শ্লীলতাহানি ও চাঁদা দাবি করে না পেয়ে ইন্টারনেটে অশ্লীল ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় দায়েরকৃত চাঞ্চল্যকর মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে।
শেরপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদালতে সাক্ষ্য দিয়ে আসামিদের সনাক্ত করে কান্নায় ভেঙে পড়েন মধুটিলা ইকোপার্কে স্বামীর সাথে বেড়াতে গিয়ে শ্লীলতাহানির শিকার হওয়া নববধু।
ওই ঘটনায় তিনি স্বামীর ষড়যন্ত্রের শিকার বলেও আদালতকে জানান।
ওই নববধু বলেন, ওরা আমার জীবনটাকে বিষিয়ে তুলেছে, কলংকিত করেছে। আমি ওদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা দেখতে চাই। যাতে আর কেউ কোনোদিন কোনো নারীর ইজ্জত নিয়ে বেইজ্জতি করার সাহস না পায়।
২৫ জুন বৃহস্পতিবার শ্লীলতাহানির চাঞ্চল্যকর ওই মামলার বাদী নির্যাতিতা নববধু, তার বড় বোন ও ভাইয়ের সাক্ষ্যগ্রহণ করে আদালত।
গত বছরের ১৭ জুলাই নালিতাবাড়ী উপজেলার মধুটিলা ইকোপার্কে স্বামীর সাথে বেড়াতে যাওয়া ওই নববধুকে বখাটেরা অস্ত্রের মুখে জোরপূর্বক শ্লীলতাহানি করে মোবাইল ফোনে অশ্লীল ভিডিও ধারণ করে। পরে ওই নববধুর পরিবারের কাছে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে না পেয়ে বখাটেরা মোবাইলে ও ইন্টারনেটে সেই অশ্লীল ভিডিও ছড়িয়ে দেয়। এ ঘটনায় ওই নববধু বাদী হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন এবং পর্নোগ্রাফী নিয়ন্ত্রণ আইনে ৫ জনকে আসামি করে নালিতাবাড়ী থানায় দু’টি পৃথক মামলা দায়ের করে।
এদিকে, চাঞ্চল্যকর এ মামলার সাাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হওয়ায় শেরপুরের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
এ ব্যাপারে রাষ্ট্রপক্ষের পিপি অ্যাডভোকেট গোলাম কিবরিয়া বুলু বলেন, চাঞ্চল্যকর এ মামলাটি দ্রুত নিস্পত্তি করতে সরকারপক্ষ কাজ করছে। ইতোমধ্যে বাদী ভিকটিম মেয়েটি এবং তার বড় বোন ও ভাই সাক্ষি দিয়েছে। আলামত হিসেবে জব্দকৃত ভিডিওটি আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে। আমরা এ ঘটনার সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে বলে আশা করছি।
এ ব্যাপারে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, আইন আইনের গতিতে চলবে। সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে আদালত দোষীদের সাজা নির্ধারণ করবে। তিনি বলেন, সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হওয়ায় আমরা সন্তোষ প্রকাশ করছি। নালিতাবাড়ীর মানুষ অত্যন্ত শান্তি প্রিয়। তারা এ মামলায় জড়িতদের দৃষ্টন্তমূলক শাস্তির আশা করছে।
মামলার বিবরণে জানা যায়, গত রমজানে ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই দুপুরে সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীকে ঈদের কেনাকাটা করে দেওয়ার কথা বলে বাবার বাড়ি থেকে মোটরসাইকেলে করে মধুটিলা ইকোপার্কে নিয়ে যায় নকলা উপজেলার চরবাছুর আলগা গ্রামের বাসিন্দা স্বামী নজরুল ইসলাম বুলবুল। ইকোপার্কের প্রধান ফটকে ইজারাদার প্রতিনিধি মোস্তফা কামালের কাছে মোটরসাইকেল রেখে স্বামী-স্ত্রী হাঁটতে হাঁটতে পাহাড়ি টিলায় উঠে ‘ওয়াচ টাওয়ারের’ সামনে বসে গল্প করতে থাকে। রমজান মাস হওয়ার কারণে ওই সময় মধুটিলা ইকোপার্কে দর্শনাথী ছিল না। কিন্তু হঠাৎ ওই স্থানে উপস্থিত হয়ে স্থানীয় বখাটে শফিকুল, মনু মিয়া ও ছালামসহ ৪ বখাটে অস্ত্র দেখিয়ে স্বামীর সামনেই নববধুকে টানাহেঁচড়া করতে থাকে। একপর্যায়ে বখাটের দল নববধুর শরীরের কাপড়-চোপড় খুলে মেয়েটিকে বিবস্ত্র করে মোবাইলে ছবি তুলতে থাকে। ছবি ও ভিডিও করা শেষে তাকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করলে মেয়েটি টিলা থেকে নিচে ঝাঁপ দেয়। এসময় স্থানীয় এক কৃষক ওই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় ঘটনাটি দেখতে পায় এবং বিবস্ত্র মেয়েটিকে উদ্ধার করে পার্কের ভেতরে রেঞ্জ অফিসে নিয়ে যায়। এ ঘটনার ঘণ্টা খানেক পর মেয়েটির স্বামী রেঞ্জ অফিসে গিয়ে ঘটনাটি কাউকে না বলার নির্দেশ দিয়ে স্ত্রীকে মোটর সাইকেলে করে নালিতাবাড়ী বাজারে রেখে বাড়ি চলে যায়।
লজ্জা ও পরিবারের সম্মানহানির ভয়ে স্থানীয় এক মাদ্রাসায় ফাজিল ক্লাশে পড়ুয়া ওই নববধু ঘটনাটি গোপন রাখে। কিন্তু ঘটনার কয়েকদিন পর গত বছরের ২১ জুলাই ইকোপার্কের ইজারাদার প্রতিনিধি মোস্তফা মোবাইল ফোনে মেয়েটির বোন মাকছুদা বেগমকে ফোন করে ঘটনাটি জানিয়ে ৫০ হাজার টাকা দাবি করে বখাটের দল। ওই টাকা না দেওয়ায় মোস্তফা, লিটন, শফিকুল ও মনু মিয়া ভিডিওটি বিভিন্ন মোবাইলে এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। বিষয়টি জানাজানি হলে ওই বছরের ১৩ আগস্ট নববধু বাদী হয়ে নালিতাবাড়ী থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন।
স্থানীয় এমপি কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ঘটনাটি জানার পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বখাটেদের ধরতে পুলিশকে নির্দেশ দেন। এরপর একে একে বখাটে শফিকুল, মনু মিয়াসহ ৪ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। আদালতে ১৬৪ ধারায় শফিকুল ঘটনার সাথে মোস্তফা ও মেয়েটির স্বামী বুলবুলের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে জবানবন্দী দিলে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন এবং পর্নোগ্রাফী নিয়ন্ত্রণ আইনে ৫ জনকে আসামি করে দু’টি মামলা হয়। ওই দু’টি মামলায় পুলিশ গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করে। ঘটনাটি এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে।
হাকিম বাবুল/ এমএএস/পিআর