মান উন্নয়নের নামে কারিগরি শিক্ষা প্রকল্পে হরিলুট


প্রকাশিত: ০২:৪৭ এএম, ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

মান উন্নয়নের নামে কারিগরি শিক্ষা প্রকল্পে হরিলুট করা হয়েছে। যার প্রমাণ পেয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ। নানা কৌশলে প্রকল্পের অর্থ গায়েব করা হয়েছে।

ডিটেইল প্রজেক্ট পরিকল্পনা (ডিপিপি) অনুযায়ী খাত ভিত্তিক বরাদ্দকৃত অর্থ খরচ করা হয়নি। বাজেটের চেয়ে বেশি যন্ত্রপাতি ক্রয় এবং অবঠাকামো নির্মাণ দেখিয়ে প্রকল্পের অর্থ ব্যয় দেখানো হয়েছে। ফলে আট কোটি টাকার কোন হদিস পাওয়া যাচ্ছে না বলে প্রকল্প সমাপ্ত প্রতিবেদনে (পিসিআর) বলা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রশিক্ষণকে যুগোপযোগী, লাখসই ও অধিক শিল্প সম্পর্কিত করার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘স্কিলস ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টে’ নামে একটি প্রকল্প নেয়। কারিগরি অধিদফতর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে। সুইডিস ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশনের অনুদান, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ঋণ সহায়তা ও বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে ৪ শত ৬০ কোটি ৭০ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়। এর মধ্যে জিওবি ৭৩ কোটি ৬০ লাখ ৭০ হাজার টাকা। ২০০৮ সালের জুলাই হতে ২০১৩ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়। পরবর্তীতে ব্যয় অপরিবর্তিত রেখে প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বাড়ানো হয়।

দ্বিতীয় দফায় প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এ সময় প্রকল্প ব্যয় কমিয়ে ১ শত ৬২ কোটি ৬৮ লাখ ৯০ হাজার টাকা ব্যয় ধরা হয়। তবে খরচ হয়েছে ১ শত ৫৪ কোট ৫৪ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। অব্যয়িত ৮ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার নিয়ম থাকলেও পিসিআর কমিটি কোন হদিস পায়নি।

প্রকল্প মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে খরচ হয়েছে ১ শত ৫৪ কোটি ৫৪ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। খরচের শতকরা হার ৯৫ ভাগ। তবে পিসিআর কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী বাস্তব অগ্রগতি ৩০ দশমিক ৮৫ ভাগ।

সবচেয়ে দুর্নীতি হয়েছে যন্ত্রপাতি ক্রয়ে। এ খাতে ডিপিপি অনুযায়ী ২২ কোটি ৬২ লাখ ১৩ হাজার টাকা বরাদ্দের বিপরীতে ২০ কোটি ৮৩ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। বরাদ্দের ৯২ ভাগ খরচ দেখানো হয়েছে। তবে ৩ হাজার ৯৩৩টি সেট ক্রয়ের কথা থাকলেও ৭ হাজার ৯৫৮ সেট যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হয়েছে। ব্যয়ের হিসেবে শতকরা হার ২৩২ ভাগ। নির্মাণ কাজে ৬৩ কোটি ৩৪ লাখ ২ হাজার টাকা বরাদ্দের বিপরীতে ৫৭ কোটি ৭৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। বরাদ্দের শতকরা ৯২ দশমিক ২৭ ভাগ অর্থ ব্যয় দেখানো হয়েছে। তবে ১১ হাজার ৬৫ বর্গমিটার নির্মাণ করার কথা থাকলেও ২১ হাজার ৮৬৯ বর্গমিটার নির্মাণ করা হয়েছে। শতকরা হিসেবে ব্যয়ের হার ১০৮ ভাগ। দুর্নীতির জন্যই এই বাড়তি নির্মাণ কাজ করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

আসবাবপত্র ক্রয়ে ২ কোটি ৭১ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বরাদ্দের বিপরীতে খরচ দেখানো হয়েছে ২ কোটি ৭৯ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। বিষয়গুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে খতিয়ে দেখার জন্য প্রতিবেদনে সুুপারিশ করা হয়েছে।
 
ডিপিপি অনুযায়ী প্রকল্পের জনবল খাতে ২ কোটি ৭৩ লাখ ৮২ হাজার টাকা বরাদ্দের বিপরীতে ২ কোটি ৮৮ লাখ ৬৪ হাজার টাকা খরচ করা করেছে। শতকরা হিসেবে ১০৫ দশমিক ৪১ ভাগ দেখানো হয়েছে। বাস্তবে এক হাজার ৯শ ২০ জনের বিপরীতে কাজ করেছে এক হাজার পাঁচশ ৯৬ জন। এ খাতে কাজ হয়েছে ৮৩ দশমিক ১২ ভাগ। মার্কেটিং ও প্রচার খাতে ১ কোটি ১৯ লাখ বরাদ্দ থাকলেও খরচ করা হয়েছে ১ কোটি ১৮ লাখ ৬৫ হাজার।

খণ্ডকালীন শিক্ষকের জন্য ৭ কোটি ১৪ লাখ ৬৯ হাজার টাকা খরচ করা হয়েছে। ৩ হাজার ৮৪০ জন শিক্ষক নিয়োগের কথা থাকলেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ৩ হাজার ৮৪০ জন। অর্থাৎ এ খাতে ৯৩ ভাগ কাজ হয়েছে। এ হিসেবে বরাদ্দে ৭ শতাংশ অর্থ দুর্নীতি হয়েছে।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, প্রকল্পে অর্থ সাহায্য কমানোর কারণে প্রকল্প ব্যয় কমেছে। ফলে প্রকল্পের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। প্রকল্প পরিচালক বার বার পরিবর্তন এবং পরামর্শক নিয়োগ বিলম্বের কারণে প্রকল্পের কাজ সুষ্ঠুভাবে শেষ হয়নি। বরাদ্দকৃত অর্থ সব খরচ না হওয়া এবং প্রকল্পের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জিত না হওয়ার জন্য প্রকল্পের কর্মকর্তাদের অদক্ষতাকে দায়ী করা হয়েছে। যন্ত্রপাতি ক্রয়ে বরাদ্দকৃত অর্থের ব্যয় না বাড়লেও সংখ্যা বৃদ্ধি, নির্মাণ কাজে বাজেটের চেয়ে আর্থিক মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে এসব বিষয়ে খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে।

জানা গেছে, প্রকল্প ২০১৫ সালের জুন মাসে শেষ হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী প্রকল্প শেষ হওয়ার তিন মাসের মধ্যে আইএমইডিতে প্রকল্পের পিপিআর জমা দেওয়ার কথা। কিন্তু ১ বছর ৪ মাস পরে জমা দেওয়া হয়েছে। বিলম্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। প্রকল্পের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে সরেজমিন প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন, পিসিআর, ডিপিপি, মনিটরিং রিপোর্টসহ প্রকল্পের বিভিন্ন সভার প্রতিবেদনের আলোকে মূল্যায়ন প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে বলে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে।

এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদরাসা বিভাগের সচিব মো. আলমগীরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সম্প্রতি দায়িত্ব নেওয়ায় কিছুই জানেন না দাবি করে অতিরিক্ত সচিব (কারিগরি) অশোক বিশ্বাসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। অশোক চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, প্রতিবেদনটি পেয়েছি। তবে বিস্তারিত দেখা হয়নি। ঘটনার সত্যতা পেলে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এমএইচএম/এআরএস/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।